একটি ছবি, অনেক প্রশ্ন by তারেক শামসুর রেহমান

একটি ছবি ছাপা হয়েছে যুগান্তরে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি। ছবিটির গুরুত্ব থাকলেও তা ছাপা হয়েছে ভেতরের পাতায়। ছবিটি যুগান্তরের কাউনিয়া (রংপুর) প্রতিনিধির পাঠানো। ছবির সঙ্গে একটি ছোট্ট প্রতিবেদনও আছে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে রংপুরের কাউনিয়ায় একসময়ের খরস্রোতা তিস্তা নদীর বুকজুড়ে বালুচর। প্রতিবেদক লিখেছেন, ‘বৈশাখ মাসে নয়, ফাল্গ–নেই তিস্তার বুকজুড়ে এখন ধু-ধু বালুচর, আর ফসলের মাঠ। খরস্রোতা তিস্তা এখন শীর্ণ মরা খালে পরিণত হয়েছে।’ প্রতিবেদক আরও লিখেছেন, ‘পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার গজলডোবায় বাঁধ নির্মাণ করে একটি খালের মাধ্যমে নদী থেকে দেড় থেকে দুই হাজার কিউসেক পানি মহানন্দা নদীতে নিয়ে যাওয়ার ফলে বাংলাদেশে তিস্তা বর্তমান কঙ্কালসার ধু-ধু বালুচরে পরিণত হয়েছে।’ যারা বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে প্রবাহিত নদী নিয়ে গবেষণা করেন, তারা জানেন তিস্তা নদীর বর্তমান হাল কী। তিস্তার পানিবণ্টনের বিষয়টি ঝুলে আছে দীর্ঘদিন ধরে। এমনকি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের আগ্রহ থাকলেও শুধু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির আপত্তির কারণে তিস্তার পানিবণ্টনের চুক্তিটি হচ্ছে না। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তিস্তার পানিবণ্টনের বিষয়টি নিয়ে একটি মন্তব্য করেছেন। বাংলাদেশ-ভারত মিডিয়া সম্মেলনে যোগ দিতে ঢাকায় আসা ভারতীয় সাংবাদিকরা তার সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি বলেন, ‘দিদিমণি পানি (জল) দেন না।’
মমতা ব্যানার্জি বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে ঢোকা আত্রেয়ী ও চূর্নীর পানি বাংলাদেশ প্রত্যাহার করে নিয়েছে বলে যে অভিযোগ করেছেন, প্রধানমন্ত্রী তাও ভিত্তিহীন বলে উল্লেখ করেছেন। শুধু তিস্তার পানিবণ্টনের কথা কেন বলি, গঙ্গার পানি চুক্তি হলেও ওই চুক্তি নিয়েও কথা আছে। চুক্তি অনুযায়ী আমরা পানি পাচ্ছি না, শুষ্ক মৌসুমে পদ্মায় পানি কমে যাচ্ছে, এ ধরনের সংবাদ প্রায়ই ছাপা হয়। প্রস্তাবিত গঙ্গা ব্যারাজ নিয়ে একটি সম্ভাবনা তৈরি হলেও সেখানে অনিশ্চয়তা এখনও কাটেনি। গঙ্গা ব্যারাজটি নির্মিত হলে পানি ধরে রাখা সম্ভব হতো এবং শুষ্ক মৌসুমে এ পানি ব্যবহার করা যেত। একসময় পাংশায় এটি নির্মিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেই পরিকল্পনা বাতিল করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি উপযুক্ত স্থান দেখার জন্য মমতা ব্যানার্জিকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু এ ব্যাপারেও তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। ফলে আগামীতে বাংলাদেশ যে একটি বড় ধরনের পানি সংকটের মুখে থাকবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এরই মাঝে আরও একটি উদ্বেগজনক সংবাদ ছাপা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়া একটি বড় ধরনের পানি সংকটের মুখে পড়তে যাচ্ছে। এশিয়া ফাউন্ডেশনের এক রিপোর্টে একথা উল্লেখ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে ভারতের কোনো কোনো রাজ্যের খরার খবর আমরা সংবাদপত্র থেকে পাচ্ছি। খরায় মৃত্যুর খবরও আছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের দিকে বিশ্ব বড় ধরনের পানি সংকটের মুখে পড়বে। তখন মাত্র ৬০ ভাগ জনগোষ্ঠী পানি পাবে, বাকি ৪০ ভাগের ক্ষেত্রে পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত হবে না। জাতিসংঘের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিশ্ব পানি উন্নয়ন সংস্থার এক রিপোর্টেও দক্ষিণ এশিয়ার ভয়াবহ পানি সংকটের বিষয়টি উঠে এসেছে। বলা হচ্ছে, ‘ভারতের ২২ থেকে ৩২টি শহর ভয়াবহ পানি সংকটের মুখে পড়বে। কাঠমান্ডু ও করাচির মতো শহরও পানি সংকটের মধ্যে পড়বে।
বাংলাদেশের পরিস্থিতি খুব ভালো, তা বলা যাবে না। ভারতের ‘পানি রাজনীতির’ শিকার হয়েছে বাংলাদেশ। তিস্তা যখন ‘মরা খালে’ পরিণত হয় তখন একটি উদ্বেগের কথা পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছিল : বাংলাদেশের আপত্তি সত্ত্বেও ভারত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পটি শেষ পর্যন্ত চালু করতে যাচ্ছে। স্বয়ং পানিসম্পদমন্ত্রী উমা ভারতী বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এ কথা জানিয়েছিলেন। অথচ বাংলাদেশ প্রথম থেকেই এ ব্যাপারে আপত্তি জানিয়ে আসছিল। ২০১৫ সালে ভারতের প্রধানন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময় যে ৬৫ দফা সংবলিত যৌথ ঘোষণা স্বাক্ষরিত হয়েছিল, সেখানে ২১নং দফায় অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছিল, ‘ভারত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের ব্যাপারে এমন কিছু করবে না, যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়।’ কিন্তু উমা ভারতীর বক্তব্য কি ওই প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ? যৌথ ঘোষণায় যখন কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়, তখন তা রক্ষা করার দায়িত্ব ওই রাষ্ট্রের। ভারতের এ ‘আচরণ’ কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয় এবং তা দু’দেশের সম্পর্ককে একটি বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেবে। বাংলাদেশ সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এর ব্যাখ্যা চাইবে। কিন্তু শুধু ‘ব্যাখ্যা চাওয়াই’ যথেষ্ট নয়। এখানে বলা ভালো, খোদ ভারতেই এ আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প নিয়ে বিতর্ক আছে। ভারতের পরিবেশবাদীরা প্রথম থেকেই এর বিরোধিতা করে আসছেন। এ নিয়ে তারা সেখানে আন্দোলন পর্যন্ত করেছেন।ভারতে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প, অর্থাৎ হিমালয় অঞ্চল থেকে উৎপন্ন নদীগুলোর পানি ৩০ খালের মাধ্যমে ভারতের খরাপীড়িত দক্ষিণাঞ্চলে সরিয়ে নেয়া এবং বিভিন্ন নদীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করার এই যে মহাপরিকল্পনা, তার ইতিহাস অনেক পুরনো। ১৯৮০ সালে এ পরিকল্পনার কথা প্রথম জানা যায়। ২০০২ সালে বিজেপি নেতা অটল বিহারি বাজপেয়ি যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে উচ্চ আদালতের একটি রায়ও তাদের পক্ষে আছে। তবে সাম্প্রতিককালে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করার পেছনে কাজ করছে ভারতের কয়েকটি অঞ্চলে প্রচণ্ড পানির অভাব ও খরা দেখা দেয়ার বিষয়টি। কৃষক পানি পাচ্ছে না। পানির অভাবে কৃষকের আত্মহত্যার খবরও সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। সম্ভবত এটি বিবেচনায় নিয়েই ভারতের নীতিনির্ধারকরা দ্রুত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিচ্ছেন। কিন্তু এটি যে মারাত্মক পরিবেশগত সমস্যা সৃষ্টি করবে এবং পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটাবে, এটি তারা বিবেচনায় নেননি।
ভারতের এ পানি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশে মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে এবং দু’দেশের সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বলা হয়, ভারতের খরা এলাকার জন্য পানি দরকার। কিন্তু এক নদী থেকে পানি প্রত্যাহার করে খালের মাধ্যমে অন্য এলাকায় (দক্ষিণে) নিয়ে যাওয়া কোনো সমাধান নয়। ভারতের ভাকরা বাঁধ নিয়ে এক গবেষণায় দেখানো হয়েছিল, পাঞ্জাব ও হরিয়ানা ুপ্রদেশের জন্য ভাকরা থেকে পাওয়া পানি নয়, বরং ভূগর্ভস্থ পানি ও উন্নত কৃষি ব্যবস্থা বেশি জরুরি। পাঞ্জাবের মোট ২০ শতাংশ এবং হরিয়ানার ৩১ শতাংশ চাষযোগ্য জমি বাঁধ নিয়ন্ত্রিত। এমনকি ৫০ বছর পর আজও সেখানকার বাস্তুহারা মানুষ কঠোর সংগ্রাম করে যাচ্ছে মাথাগোঁজার ঠাঁইটুকুর জন্য। ওই গবেষণার ফলাফলই বলে দিচ্ছে নর্মদা বাঁধের উচ্চতা না বাড়িয়ে কীভাবে আরও বেশি পানি ও বিদ্যুৎ পাওয়া যেতে পারে। সে বিষয়ে মাথা ঘামানো দরকার। নর্মদা বাঁধসংলগ্ন অঞ্চলের বাস্তুহারা ৫০ হাজার ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে কীভাবে ক্ষতিপূরণ দেবে গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্র, যখন কিনা ওইসব রাজ্যে বাড়তি কোনো জমি নেই তাদের পুনর্বাসনের জন্য? তিহরি বাঁধের শিকার হয়েছে যারা, তারাই সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার। কারণ ইউপি বা কেন্দ্রীয় সরকার কোনোরূপ সহানুভূতি নিয়ে এগিয়ে আসেনি তাদের সাহায্যার্থে। এখন আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প যে শুধু বাংলাদেশকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে তা নয়, খোদ ভারতও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু ভারতের নীতিনির্ধারকরা এটি বিবেচনায় নিচ্ছেন না। এখানে আরও একটা কথা বলা প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পটি অবৈধ। আন্তর্জাতিক আইনবিশারদ অধ্যাপক ওপেনহেইম বলেছেন, কোনো রাষ্ট্রকে নিজ ভূখণ্ডের প্রাকৃতিক অবস্থা এমনভাবে পরিবর্তন করতে দেয়া যাবে না, যার ফলে তা প্রতিবেশী কোনো রাষ্ট্রের ভূখণ্ডের প্রাকৃতিক অবস্থার কোনো অসুবিধা সৃষ্টি করে। এ আলোকেই আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পটি অবৈধ। যখন কোনো রাষ্ট্র একটি অভিন্ন সম্পত্তির উন্নতি, পরিবর্তন বা ধ্বংস সাধনের জন্য কোনো প্রকল্প গ্রহণ করে, তখন ওই রাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে কিছু নীতিমালা অনুসরণ করতে হয়। আন্তর্জাতিক আইন আরও বেশি সুনির্দিষ্ট যখন তা আন্তর্জাতিক নদী সম্পর্কিত হয়।
আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের সবক’টি নদীই আন্তর্জাতিক নদী। এসব নদীর একতরফা পরিবর্তন, পরিবর্ধন বা পানি প্রত্যাহার আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে বেআইনি ও অগ্রহণযোগ্য। আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহার সংক্রান্ত ১৯৬৬ সালের আন্তর্জাতিক আইন সমিতির হেলসিংকি নীতিমালার ৪ ও ৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রতিটি অববাহিকাভুক্ত রাষ্ট্র অভিন্ন নদীগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই অন্য রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজনকে বিবেচনায় নেবে। তা অবশ্যই অন্য রাষ্ট্রের কোনো ক্ষতি না করেই হতে হবে। কিন্তু ভারতের এ উদ্যোগে একটা বিষয় স্পষ্ট, বাংলাদেশের ওপর এ প্রকল্পের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণভাবেই উপেক্ষা করছে ভারত। হেলসিংকি নীতিমালার অনুচ্ছেদ ২৯-এ বলা হয়েছে, এক অববাহিকাভুক্ত রাষ্ট্র অপর অববাহিকাভুক্ত রাষ্ট্রকে অবশ্যই আন্তর্জাতিক নিষ্কাশন অববাহিকার পানির ব্যবহারের ব্যাপারে কৃত পদক্ষেপ সম্পর্কে অবহিত করবে। ১৯৯২ সালের ডাবলিন নীতিমালার (আন্তর্জাতিক নদী ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত) ২নং নীতিতে বলা হয়েছে, পানি উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা অবশ্যই সবার অংশগ্রহণমূলক হতে হবে। কিন্তু আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের ক্ষেত্রে ভারত একটি অস্বচ্ছ ও স্বেচ্ছাচারমূলক পদ্ধতিতে অগ্রসর হচ্ছে। ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে জলপ্রবাহ কনভেনশনটি গ্রহণ করা হয়। এ কনভেনশনে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও সৎ প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্কের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। কনভেনশনের ৬ অনুচ্ছেদে যুক্তি ও ন্যায়পরায়ণতার ব্যবহার নির্দিষ্টকরণে কতগুলো শর্ত নির্ধারণ করা হয়েছে। যুক্তি ও ন্যায়পরায়ণতার ব্যবহার নির্ধারণে এ অনুচ্ছেদে উল্লেখিত সবক’টি শর্তকে একইসঙ্গে বিবেচনা করতে হবে এবং সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে বিবদমান দেশগুলোকে আলোচনার মাধ্যমে একটি ঐকমত্যে পৌঁছতে হবে। জলপ্রবাহ কনভেনশনে উল্লেখিত নীতিমালাগুলোর আলোকে প্রস্তাবিত নদী সংযোগ প্রকল্পকে বিচার করলে দেখা যাবে, ভারত কনভেনশনে বিধিবদ্ধ প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করছে। এমনকি জলাভূমিবিষয়ক রামসার কনভেনশনের ৫নং অনুচ্ছেদ অনুসারে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলো পরস্পর পরামর্শ করবে এবং একইসঙ্গে জলাভূমি এবং সেখানকার উদ্ভিদ ও প্রাণী সংরক্ষণের স্বার্থে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নীতিমালা ও বিধিবিধান প্রণয়ন করবে।
কিন্তু আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পে ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জলাভূমিগুলোকে ধ্বংস করার নামান্তর; যা কিনা রামসার কনভেনশনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। আমরা ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তির ৯ অনুচ্ছেদের কথাও উল্লেখ করতে পারি। ওই অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘উভয়পক্ষ সমতা, ন্যায়পরায়ণতা এবং পারস্পরিক ক্ষতি না করার নীতির ভিত্ততে পরিচালিত হবে।’ আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করা হলে তা হবে ওই চুক্তির বাধ্যবাধকতা ও অঙ্গীকারের চরম লঙ্ঘন। তিস্তার পানি প্রত্যাহার ও আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের পাশাপাশি টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্পের কথাও আমরা উল্লেখ করতে পারি। ভারতের মনিপুর রাজ্যের চোরাচাঁদপুর জেলার তুইভাই ও বরাক নদীর মোহনায় টিপাইমুখ এলাকায় একটি বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছিল ২০১১ সালে। এ নিয়ে খোদ মনিপুরেই বিতর্ক আছে। সেখানে পরিবেশবাদীরা এর বিরোধিতা করে আসছেন। এ বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। কিন্তু এটি নিয়ে একধরনের লুকোচুরি চলছে। বলা হচ্ছে, সেখানে কোনো বাঁধ নির্মিত হচ্ছে না। কিন্তু বাস্তবে খুব ধীরগতিতে সেখানে কাজ চলছে। এ অঞ্চলে শেষ পর্যন্ত বাঁধটি যদি নির্মিত হয়, তাহলে বৃহত্তর সিলেট পানিশূন্য হয়ে যাবে। খরা দেখা দেবে। সৃষ্টি হবে পরিবেশগত সমস্যা। তাই শুধু তিস্তার পানিবণ্টন সমস্যা নয়, সামগ্রিকভাবে প্রাপ্য পানির সুষ্ঠু বণ্টন ও পানি ব্যবস্থাপনা নিয়েই বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিয়েছে। দু’দেশের সম্পর্কের উন্নয়নের স্বার্থেই পানি সমস্যার সমাধান প্রয়োজন। ভারতের যেমন পানির প্রয়োজন রয়েছে, তেমনি বাংলাদেশেরও পানির প্রয়োজন রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সমস্যা শুধু তিস্তা নিয়ে নয়। তাই প্রয়োজন ভারতীয় নেতাদের আন্তরিকতার। এ আন্তরিকতাই পানি সমস্যার একটা স্থায়ী সমাধান এনে দিতে পারে।
ড. তারেক শামসুর রেহমান : প্রফেসর ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
tsrahman09@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.