শিক্ষাক্ষেত্রে অশুভ ছায়া by মুস্তাফা নূরউল ইসলাম

খুবই উদ্বেগের বিষয় যে, অব্যাহতভাবে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটে চলেছে। কোনোভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না প্রশ্ন ফাঁস। ইতিমধ্যে এ ব্যাপারে নানা রকম পদক্ষেপ নেওয়ার পরও অশুভ শক্তি যেন অনেকটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েই সরকার ও প্রশাসনের শক্তিমত্তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাদের শক্তিমত্তার পরিচয় দিচ্ছে। এই বিষয়টি শিক্ষার সামগ্রিক মানের ক্ষেত্রে কতটা হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে এর ব্যাখ্যা-বিশ্নেষণ নতুন করে নিষ্প্রয়োজন। শিক্ষাক্ষেত্রে যে নানামুখী সংকট সৃষ্টি হচ্ছে এ নিয়ে নানা মহলে ব্যাপক কথা হচ্ছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ব্যবস্থার পরিবর্তন করে প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধসহ শিক্ষার মান নিশ্চিত করার কথা ভাবা হচ্ছে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েই কি এই গুরুতর ব্যাধির নিরসন করা যাবে? তারপরও যদি দৃশ্যমান অগ্রগতি হয় তাতেই মঙ্গল। তবে এ ব্যাপারে তাড়াহুড়ো না করাই শ্রেয় মনে করি। শিক্ষার মানের বিষয়টি খুব বেশি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। শিক্ষার মানোন্নয়নের বিষয়ে এ পর্যন্ত সচেতন মহল থেকে অনেক কথাই বলা হয়েছে। সম্প্রতি এ ব্যাপারে পত্রিকায় কয়েকটি প্রতিবেদনও চোখে পড়েছে। সরকার শিক্ষার মানোন্নয়নে আন্তরিক নয় কিংবা প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেনি এমনটি বলা যাবে না। কিন্তু তারপরও কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায়নি। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নের প্রথম ও প্রধান শর্ত হচ্ছে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা। এই প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার অতীতে বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে এবং এর সুফলও পরিলক্ষিত হচ্ছে। প্রাথমিক ও প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা দু'ভাগে ভাগ করে শিক্ষার ভিতকে শক্তিশালী করার উদ্যোগটি বিভিন্ন মহলে প্রশংসা কুড়িয়েছে। একই সঙ্গে শিক্ষাকে আনন্দদায়ক করে উপস্থাপনের জন্য প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়, এর ইতিবাচক প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষ্য করা গেছে। কিন্তু তাই বলে যে প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে সব সমস্যা দূর হয়ে গেছে তা নয়। এখনও বেশ কিছু সমস্যা বিদ্যমান এবং এসবের নিরসনে অত্যন্ত দ্রুত সুদূরপ্রসারী কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া অপরিহার্য। কিন্তু এখন এই প্রাথমিক পরীক্ষার প্রশ্ন পর্যন্ত ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। তারপর আসে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার স্তর। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাক্ষেত্রে বেশ কিছু নেতিবাচকতার কথা এখনও শোনা যায়। এর মধ্যে শিক্ষকসহ অবকাঠামোগত সংকটের বিষয়টি গুরুত্ববহ। মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে দক্ষ-প্রশিক্ষিত শিক্ষকের বিকল্প নেই। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা খাতে যতটা গুরুত্বের সঙ্গে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন, ততটা দেওয়া হচ্ছে না- এমন অভিযোগ কোনো কোনো মহল থেকে উত্থাপিত হয়। এ দুই স্তরেই পাসের হার আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় এখন অনেক বেড়েছে, তা অসত্য নয়; কিন্তু কতটা মানসম্পন্ন হয়েছে এ দুই স্তরের শিক্ষা তা নিয়ে কথা ওঠাটাও অমূলক নয়। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, উচ্চ মাধ্যমিকে ভালো ফল করেও উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে প্রবেশের জন্য পরীক্ষায় বহুসংখ্যক শিক্ষার্থী সফল হতে পারছে না। এ অবস্থায় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নের বিষয়ে প্রশ্ন ওঠাটাই স্বাভাবিক। গত কয়েক বছরে শিক্ষাক্ষেত্রে অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে; কিন্তু এ পরিবর্তন সব ক্ষেত্রে সমভাবে ঘটেছে কি-না এটিও একটি প্রশ্ন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিবর্তন মানে তো সামগ্রিক পরিবর্তন নয়। এ দুই স্তরের শিক্ষার মানোন্নয়নে তাই বিশেষভাবে দৃষ্টি দেওয়া আবশ্যক। মাধ্যমিক পরীক্ষায় এবার প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা রীতিমতো ভয়ঙ্কর চিত্র উপস্থাপন করেছে। সামনে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা। এ নিয়ে সঙ্গত বিরাজ করছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। তারপর আসে উচ্চশিক্ষার বিষয়। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে আমরা কতটা এগিয়েছি এবং মান কতটা উন্নত করা সম্ভব হয়েছে, তাও প্রশ্নের বিষয়। পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা পদ্ধতিসহ নানা বিষয়ে এ পর্যন্ত কম আলোচনা-পর্যালোচনা হয়নি। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসার দেশে উচ্চশিক্ষার হার বাড়িয়েছে, তা অসত্য নয়; কিন্তু কোনো কোনো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকাণ্ড নিয়ে মাঝে ব্যাপক গুঞ্জনের সৃষ্টি হয়েছিল। সরকার কয়েকটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিয়েছিল। শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড- এটি বহুল প্রচলিত একটি বাক্য। বিগত চারদলীয় জোট সরকারের শাসনামলে শিক্ষা খাতে দুর্নীতির ব্যাপক ডালপালা ছড়িয়ে ছিল এবং এ নিয়ে রীতিমতো বাণিজ্য শুরু হয়েছিল। এমন অভিযোগ যথেষ্ট পুষ্ট। অতীতের তুলনায় অনেকটাই তা নিয়ন্ত্রণ করা গেছে। এ ব্যাপারে আরও কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ দায়িত্বশীল সব মহলকে। আমাদের পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বৈশ্বিক জ্ঞানকাণ্ডের সঙ্গে আরও সক্রিয়ভাবে যুক্ত হতে হবে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি আমাদের দেশে শিক্ষা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। এই অনাকাঙ্ক্ষিত-অনভিপ্রেত ঘটনা শিক্ষার মানোন্নয়নের ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা তো সৃষ্টি করেছেই, একই সঙ্গে সৃষ্টি করছে আস্থার সংকটও। নিকট অতীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার (ঘ ইউনিট) প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি অনেক প্রশ্ন, বিস্ময় ও শঙ্কার সৃষ্টি করে। জেএসসি থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে এমনকি বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনাবলি এক ভয়াবহ ব্যাধির সুস্পষ্ট ইঙ্গিত। প্রশ্নপত্র ফাঁসের চক্র অনেক দিন ধরেই এ ভয়ঙ্কর অপরাধ চালিয়ে যাচ্ছে এবং চাকরি, পরীক্ষা পাসের প্রলোভন ইত্যাদি দেখিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে বিপুল অঙ্কের টাকা। শুধু প্রশ্নপত্র ফাঁসই নয়, উত্তরপত্র মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও অতীতে কেলেঙ্কারি হয়েছে। এ পরিস্থিতি গ্লানি এবং লজ্জার বিষয় তো বটেই, সমগ্রিকভাবে শিক্ষার মানোন্নয়নের পথেও বড় ধরনের অন্তরায় সৃষ্টি করেছে। একই সঙ্গে শিক্ষা ব্যবস্থা ও পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে ভবিষ্যতে বড় ধরনের আস্থা সংকট দেখা দিতে পারে। এমনটি সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য কোনোভাবেই মঙ্গলজনক হবে না।
এ পর্যন্ত প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা কম ঘটেনি এবং অব্যাহতভাবে ঘটেও চলেছে। কিন্তু এর দৃষ্টান্তযোগ্য প্রতিকার নিশ্চিত করা যায়নি। এর পেছনে যেসব দুর্বৃত্ত কলকাঠি নাড়ে, সেই মূল হোতাদের খুঁজে বের করা যায়নি। দৃষ্টান্তযোগ্য প্রতিকার দাঁড় করানো সম্ভব হলে হয়তো এত ভয়াবহভাবে এই ব্যাধির বিস্তার ঘটত না। এখন পাবলিক পরীক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তনের যে চিন্তা-ভাবনা হচ্ছে এ সম্পর্কে আরও আগে কেন নেওয়া হয়নি, প্রশ্ন হলো সেটি। আমাদের দেশে এখনও শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা অনেক। বেকারত্ব জীবনের অভিশাপ থেকে মুক্তির আশায়, বিশেষ করে একটি সরকারি চাকরির প্রলোভন সবারই থাকে। সরকারি চাকরি নামের সেই সোনার হরিণ শিক্ষিত বেকার যারা, তারা সবাই ধরতে চান। যোগ্যতার মাপকাঠিতে প্রত্যাশিত চাকরি হয়তো সবার জোটে না; কিন্তু তারপরও একটি সরকারি চাকরির নিশ্চয়তা সবাই পেতে চান। ইতিমধ্যে যারা এ চাকরির প্রলোভনে প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়েছেন তারা কোনো কিছু না জেনেই একটি নিশ্চিত জীবনের জন্য বক্রপথে পা রেখেছিলেন। সংঘবদ্ধ দুষ্টচক্র তাদের জীবন চরম অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়। এমন দৃষ্টান্ত দেওয়া যাবে অনেক। এ দুষ্টচক্র শিক্ষাক্ষেত্রেও ছোবল বসাচ্ছে। এই শত্রুদের মূলোৎপাটনে নির্মোহ অবস্থান নিয়ে কঠোর দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। এরা দেশ ও জাতির শত্রু। এ শত্রুদের শিকড়-বাকড় যে চারদিকে ছড়িয়ে গেছে, বিদ্যমান পরিস্থিতি এ সাক্ষ্যই দিচ্ছে। ভবিষ্যতে যেন এমন কোনো ঘটনা আর না ঘটে, সেটিই নিশ্চিত করতে হবে। ব্যবস্থা বদলের এখন যে সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়ে ভাবা হচ্ছে এর মধ্য দিয়ে অবস্থা বদলের চেষ্টা কতটা সফল হবে, তা এখনই বলা সম্ভব নয়। নতুন ব্যবস্থা কিংবা পদ্ধতি চূড়ান্ত করার আগে আরও ব্যাপক বিশ্নেষণ এবং ভাবার প্রয়োজন রয়েছে। তবে কোনোভাবেই যাতে আস্থার সংকটের ছায়া বিস্তৃত না হয়, এ জন্যও সজাগ থাকতে হবে। আস্থা সংকট, আস্থাহীনতা, অবিশ্বাস এসবের নেপথ্যের একটিমাত্র কারণ বোধ হয় সামাজিক অবক্ষয়। এ অবস্থা থেকে ফিরতে না পারলে আস্থার সংকট থেকে মুক্তি নেই। এ সংকট থেকে মুক্তির একমাত্র পথ সামাজিক মূল্যবোধগুলো নতুন করে প্রতিষ্ঠা করা। শিক্ষাক্ষেত্রে এই যে সংকট দেখা দিয়েছে এবং যে গভীর ষড়যন্ত্র চলছে, তা নির্মূলে কঠোর ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে না পারলে শিক্ষা মানের নিম্নগতি ঘটবে এবং তা রোধ করা দুরূহ হয়ে পড়বে। শিক্ষার মানোন্নয়নে নতুন করে পরিকল্পনার ভিত্তিতে সুদূরপ্রসারী কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে অরাজকতা যাতে কোনোভাবেই মাথাচাড়া দিয়ে না উঠতে পারে, সে জন্য সংশ্নিষ্ট দায়িত্বশীল সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে যথাযথ দায়িত্ব পালনে অবশ্যই নিষ্ঠ হতে হবে। প্রশ্নপত্র ফাঁস, উত্তরপত্র কেলেঙ্কারিসহ শিক্ষাক্ষেত্রে যেসব নেতিবাচকতা বিরাজ করছে, সেসব নিরসনে শুভবোধসম্পন্ন সবার ঐকান্তিক প্রয়াস জরুরি। ইতিমধ্যে প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে পরীক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তনের ব্যাপারেও চিন্তা-ভাবনা হচ্ছে। কিন্তু সব কথার শেষ কথা হলো, আগে রোগ নিরাময়ের জন্য ব্যাধিটির উৎস চিহ্নিত করে যথাযথ দাওয়াই প্রয়োগ করতে হবে। শিক্ষার মানোন্নয়নের সঙ্গে দেশ ও জাতির অগ্রগতির বিষয়টি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। জাতির অগ্রগতি-উন্নয়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অন্যান্য খাতের চেয়েও অধিক গুরুত্ব দিয়ে দৃষ্টি দিতে হবে শিক্ষাক্ষেত্রে। শিক্ষাক্ষেত্রে যে অশুভ ছায়া পড়েছে এর নিরসনে যূথবদ্ধ প্রয়াস ছাড়া গত্যন্তর নেই।
শিক্ষাবিদ

No comments

Powered by Blogger.