আসাম এখন কোন পথে? by এবনে গোলাম সামাদ

আসাম নিয়ে আবার অনেক কথাই হচ্ছে। কিন্তু আসাম সম্পর্কে আমাদের সাধারণ জ্ঞান খুব স্বল্প। বিশেষ করে আসামের মুসলমানদের সম্পর্কে। আসামের মুসলমানদের উদ্ভব সম্পর্কে যথেষ্ট গবেষণা হয়নি। আসামের সবচেয়ে বড় শহর গৌহাটি। গৌহাটি নামটা বাংলা। অহমিয়া বা আসামি ভাষায় নামটা হলো গুয়াহাটি। আগে অহমিয়া ভাষায় নামটা ছিল গুবাক-হাটি। হাট শব্দটা ফারসি। গুবাক শব্দটাও ফারসি। ফারসিতে গুবাক বলতে বোঝায় সুপারি। গুবাক-হাটি নামটা তাই বাংলা করলে দাঁড়ায়, ‘সুপারির হাট’। আসামের সবচেয়ে বড় শহর গৌহাটির নামটা কেন এসেছে ফারসি ভাষা থেকে, সেটা জানা যায় না। বাংলাদেশে ১৩৩৮ থেকে ১৫৭৬ সাল পর্যন্ত ছিল একটি পৃথক স্বাধীন মুসলিম সালতানাত।
যাকে বলা হচ্ছে সালতানাত-ই-বঙ্গালাহ্। এর একটা বিশেষ প্রভাব পড়েছিল পশ্চিম আসামের (কামরূপ) ওপর। বাংলার স্বাধীন সুলতানরা জয় করেছিলেন পশ্চিম আসাম বা কামরূপ পর্যন্ত। সম্ভবত সে সময়ে উদ্ভব হয়েছিল গুবাক-হাটি নামটি। কেননা, বাংলার সুলতানরা তাদের কাজকর্মে করতেন আরবি ও ফারসি ভাষার বিশেষ ব্যবহার। সুলতান শাম্্স-উদ-দীন ইলিয়াস শাহ্-এর পুত্র সেকেন্দার শাহ্ ১৩৬৭ সালে কামরূপে এসে একটি টাকশাল স্থাপন করেছিলেন। সেকেন্দার শাহ্ পুত্র গিয়াস-উদ-দীন আজম শাহ্ গৌহাটিতে নির্মাণ করেছিলেন একটি দুর্গ। বিষয়টি সম্পর্কে অবগত হওয়া সম্ভব হয়েছে গৌহাটিতে প্রাপ্ত আরবি ভাষায় লিখিত একটি শিলালিপি থেকে। শিলালিপিটি সংরক্ষিত আছে আসামের কামরূপ সংগ্রহশালায়। এর থেকে আমরা অনুমান করতে পারি, আসামে মুসলমানেরা হঠাৎই বাইরে থেকে গিয়ে উপস্থিত হয়নি। কম করে তারা খ্রিষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দী থেকে সেখানে আছে। আসামের অনেক মন্দিরে থাকতে দেখা যায় গম্বুজ। আর এসব গম্বুজ হলো কতকটা গৌড়ের সুলতানি আমলের মসজিদের মতো। দেখতে কতকটা উল্টানো ধামার মতো। বিখ্যাত কামাক্ষার মন্দিরেও এর প্রভাব পরিদৃষ্ট হয়। অহমিয়া বা অসমিয়া ভাষা বাংলা ভাষার সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। অনেকের মতে, ভাষাটিকে বলা যায় বাংলা ভাষারই একটি রূপ। ১৯৩১ সালে বগুড়ার মহাস্থান নামক জায়গায় সম্রাট অশোকের সময়ের একটি শিলালিপি আবিষ্কৃত হয়, যা অশোক প্রাকৃত ভাষায় ব্রাহ্মী অক্ষরে লিখিত। অনেকের মতে, অশোক প্রাকৃত থেকে হতে পেরেছে বাংলা ভাষার উদ্ভব। আসামে সম্রাট অশোকের সময় কোনো শিলালিপি পাওয়া যায়নি। অশোকের সময়ের এই শিলালিপিকে ধরা হয় আনুমানিক ৩০০ খ্রিষ্টপূর্ব অব্দের। আসামের কোথাও এত পুরনো শিলিলিপি এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। আসামে ভাষার অক্ষর ও বাংলা ভাষার অক্ষর একই। বাংলা অক্ষরের উদ্ভব হয়েছে ব্রাহ্মী অক্ষর থেকে। আসামি ভাষাকে ভাবা যায় বাংলা ভাষা থেকে উদ্ভূত। ব্রিটিশ আমলের আসাম প্রদেশে যারা বাস করত, তাদের শতকরা ৫০ ভাগ মানুষ কথা বলত বাংলা ভাষায়। শতকরা ২০ ভাগ মানুষ কথা বলত অহমিয়া বা আসামি ভাষায়। আর শতকরা ৩০ ভাগ লোক কথা বলত বিভিন্ন উপজাতীয় ভাষায়। উপজাতীয়দের ভাষা আর্য পরিবারভুক্ত ছিল না। এরা হলো চীনা এবং কম্বোডিয় ভাষা পরিবারভুক্ত। এদের কথা এখন বিশেষভাবে ভাবতে হচ্ছে, কেননা সাবেক আসাম প্রদেশ এখন আর নাই। তা ভেঙে সৃষ্টি হতে পেরেছে আসাম, অরুণাচল, নাগাল্যান্ড, মেঘালয় ও মিজোরাম। মিজোরামের মানুষ আর্য ভাষায় কথা বলে না। বিজিপি এখন আসামের প্রাদেশিক পরিষদে ক্ষমতায় আছে। ক্ষমতায় আছে ভারতের পার্লামেন্টে। আসামে বিজিপি বলছে হিন্দুত্ববাদের কথা। হিন্দুত্ববাদের ভিত্তি হলো আর্য ভাষা ও হিন্দুধর্ম। কিন্তু উপজাতিদের ভাষা আর্য পরিবারভুক্ত নয়। আর ধর্মে তারা এখন অধিকাংশই হয়ে উঠেছে খ্রিষ্টান। হিন্দুত্ববাদ আসামে কিছুটা আবেদনবহ হলেও সমগ্র পূর্ব ভারতে তার প্রভাব সেভাবে প্রবিষ্ট হতে পারবে না। কেননা, খ্রিষ্টধর্ম আর হিন্দুধর্ম একসূত্রে গাঁথা হতে কখনই পারে না। আসামে ১৯৮০-এর দশকে শুরু উলফাদের আন্দোলন (ULFA= United Liberation Front of Assam)। এই আন্দোলনকারীরা চাচ্ছিল, আসাম, অরুণাচল, নাগাল্যান্ড, মেঘালয়, মিজোরাম নিয়ে একটি পৃথক স্বাধীন ফেডারেশন গড়তে। এই আন্দোলনে সহায়তা দিচ্ছিল চীন।
আপাতত এই আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়লেও আবার তা হয়ে উঠতে পারে প্রবল। হিন্দুত্ব দিয়ে একে রোধ করা সম্ভবপর হবে বলে মনে করা যায় না। কিন্তু এখন বিজিপি সরকার আসামে যে নীতি গ্রহণ করছে, তাতে প্রায় দেড় কোটি বাংলাভাষী মুসলমানকে ছাড়তে হবে আসাম (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮)। বাংলাদেশ সরকারের উচিত হবে না বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখা। রাখাইন সে দেশের মুসলমানদের জন্য কসাইখানায় পরিণত হয়েছে। আসামেও ঘটতে পারে তার পুনরাবৃত্তি। বিজিপি বলছে, এসব বাংলাভাষী মুসলমান নাকি আসামে গেছে বেআইনিভাবে। কিন্তু এটা কী করে সম্ভব? কারণ, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে থাকে কড়া পাহারায় ভারতীয় সীমান্ত-প্রহরীরা। তাদের চোখে ধুলা দিয়ে কী করে এত বাংলাভাষী মুসলমান আসামে প্রবেশ করতে পারল, সেটা তাই হয়ে উঠছে খুবই প্রশ্নসাপেক্ষ। অন্য দিকে, ভারতের এক প্রদেশ থেকে আরেক প্রদেশে মানুষ সহজেই যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে কোনো আইনগত বাধা নেই। পশ্চিমবঙ্গের সাথে আছে আসামের সাধারণ সীমান্ত। পশ্চিমবাংলা থেকে বাংলাভাষী মানুষ, তা সে মুসলমানই হোক আর হিন্দু, আসামে যেতে পারে বিনা বাধায়। কিভাবে ধরা যেতে পারে যে, বাংলাভাষী মুসলমানেরা বর্তমান বাংলাদেশ থেকে? পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আসাম থেকে বাংলাভাষী মুসলমান বিতাড়নের বিরোধিতা করে বলেছেন, এর ফলাফল ভয়াবহ হবে। এর বিপক্ষে আসামের বিজিপি সরকার নাকি মামলা করেছে। ভারতের সেনাপ্রধান আসামে বাংলাভাষী মুসলমানের অনুপ্রবেশ নিয়ে সম্প্রতি বলেছেন, এর মূলে আছে পাকিস্তান ও চীনের ষড়যন্ত্র। পাকিস্তান ও চীন ষড়যন্ত্র করে বাংলাভাষী মুসলমানদের পাঠাচ্ছে আসামে। কিন্তু বাংলাদেশে এখন কোনো পাকিস্তানবান্ধব সরকার নেই। তাই বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে পাকিস্তানকে সহযোগিতা করার প্রশ্ন ওঠে না। অন্য দিকে, আসাম ও চীন প্রায় লাগোয়া। চীন ইচ্ছা করলেই উলফাদের মদদ জুগিয়ে পরিস্থিতি অনেক ঘোরালো করতে পারে। বাংলাভাষী মুসলমানদের দিয়ে যা করানো সম্ভব নয়। সুতরাং চীন পাকিস্তানের সহায়তায় বাংলাভাষী মুসলমানদের বাংলাদেশ থেকে আসামে পাঠাচ্ছে, এটা যুক্তিবহ বলে মনে হচ্ছে না।
মনে পড়ছে ঈশপের গল্প : ভাটিতে পানি খেয়ে উজানে পানি ঘোলা করবার পরিচিত গল্প। জানি না, ভারতের সেনাপতি আসলে কী চাচ্ছেন। যদি তিনি মনে করে থাকেন যে, এর মাধ্যমে বাংলাদেশকে ভয় দেখানো যাবে, বাধ্য করা যাবে ভারতের কথা মেনে চলতে, তবে সেটা যথাযথ হবে না। কেননা, ভারত বিরাট শক্তিধর দেশ হলেও, বাংলাদেশকে আক্রমণ করলে বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। ১৯৭১-এর পরিস্থিতি এখন আর বিরাজ করছে না। ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ-এন-লাই, বলেছিলেন বহিঃআক্রমণের হাত থেকে পাকিস্তানের অখণ্ডতাকে রক্ষা করবার জন্য চীন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু চীন শেষ পর্যন্ত ১৯৭১ সালে ভারতের সাথে যুদ্ধকে এড়াতে চায়। কেননা, ১৯৭১ সালের ৯ আগস্ট ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছিল ‘শান্তি-মৈত্রী-সহযোগিতা’ চুক্তি। যেটা আসলে ছিল একটা সামরিক চুক্তি। চীন ভারতের সাথে যুদ্ধে জড়ালে সোভিয়েত ইউনিয়ন চীনকে আক্রমণ করতে পারত, চীনের উত্তর সীমান্তে। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন এখন আর নেই। রাশিয়া এখনো একটি বিরাট সামরিক শক্তি। কিন্তু সে আর এখন একটি ভারতবান্ধব রাষ্ট্র নয়। বরং রাশিয়া হয়ে উঠতে চাচ্ছে চীনবান্ধব। যাকে বলে শিলিগুড়ি করিডোর বা যাতায়াত পথ, তা হলো ২৭ কিলোমিটার (১৭ মাইল) চওড়া। এই করিডোরের মধ্য দিয়েই স্থাপিত হতে পেরেছে ভারতের মূল ভূ-খণ্ড থেকে পূর্ব ভারতের যোগাযোগব্যবস্থা। শিলিগুড়ি করিডোর চীন সীমান্ত থেকে ১৩০ কিলোমিটার (৮০ মাইল) দূরে অবস্থিত। চীন যদি তিব্বতের চুম্বি উপত্যকা থেকে আক্রমণ করে এই কোরিডোর দখল করে নিতে পারে, তবে আসামের সাথে ভারতের যোগাযোগ কেবলমাত্র থাকতে পারে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে। একসময় নেপাল ছিল ভারতবান্ধব দেশ। কিন্তু এখন সে পরিণত হয়েছে একটি চীনবান্ধব দেশে। নেপাল ইচ্ছা করলে এই করিডোর দখলের চেষ্টা করতে পারে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান এমন যে, ভারত তাকে কখনই সহজে কব্জা করতে সক্ষম হবে না। কেননা, বাংলাদেশ এককভাবে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ করবে না। ১৯৭১-এ যুদ্ধে ভারত জয়ী হয়েছিল, তার একটি কারণ বাংলাদেশের মানুষের একটা বিরাট অংশের সমর্থন ছিল তার দিকে। কিন্তু এবার বাংলাদেশ আক্রান্ত হলে, বাংলাদেশের মানুষ তার প্রতি সেভাবে সহযোগিতার হস্ত নিশ্চয় প্রশস্ত করতে চাইবে না। সাধারণত গণতান্ত্রিক দেশে পররাষ্ট্রবিষয়ক নীতির ক্ষেত্রে সেনাপতিরা মুখ খোলেন না। কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, প্রধান সেনাপতিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো পররাষ্ট্র বিষয়ে সভা সমিতিতে বিবৃতি দিতে। সেনাবাহিনী এভাবে রাজনীতিতে জড়ালে ভারতে গণতন্ত্র বিপন্ন হতেই পারে। বর্তমান সেনাপতির বিবৃতিকে সমর্থন করেছেন তার পূর্বে যিনি ভারতের প্রধান সেনাপতি ছিলেন তিনিও। এ ছাড়া সমর্থন করেছেন ভারতের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। ভারতে জারি হতে পারে সেনা শাসন। আসামে বর্তমানে আছে বিজিপি সরকার। কিন্তু এই সরকারের পতন ঘটতে পারে। কেননা, আসামের জনমত বদলে যাওয়া সম্ভব। তারা এড়াতে চাইতে পারে চীনের সাথে সংঘর্ষ।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.