ক্যাশ ওয়াকফ ও এর অবদান by ইকবাল কবীর মোহন

ওয়াকফ হিসেবে স্থাবর সম্পত্তি যেমন জমি, দালান, বই-পুস্তক, গবাদিপশু ইত্যাদি দান করার চেয়ে নগদ বা ক্যাশ ওয়াকফ বেশি উপযোগী এবং গুরুত্বপূর্ণ। ক্যাশ ওয়াকফের প্রচলন অটোম্যান শাসনকাল থেকেই। তখন বুরশা শহরের অনেক ধনবান ও বিত্তশালী লোক দরিদ্র মানুষকে নগদ অর্থ ওয়াকফ হিসেবে দান করতেন। চিজাককা (১৯৯৫) উল্লেখ করেন যে, ক্যাশ ওয়াকফ তখনকার সময় বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল এবং ব্যক্তি ও সামাজিক উন্নয়নে তা অভাবনীয় ভূমিকা রেখেছিল। সেই সময় স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং সমাজসেবায় ক্যাশ ওয়াকফ’র অবদান ছিল খুব বেশি। ১৬ শতকের শেষদিকে এসে ক্যাশ ওয়াকফ আনাতোলিয়া এবং ইউরোপের ইসলামী প্রদেশগুলোতে খুবই জনপ্রিয় ব্যবস্থা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিল বলে জানা যায়। ওয়াকফ প্রশাসনে তুরস্কের দীর্ঘ ইতিহাস রযেছে। তুরস্কে ক্যাশ ওয়াকফ আর্থিক কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে ৮টি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংক এবং ১৭টি প্রচলিত ব্যাংকের ২২টি শাখা ও ২৭টি উইনডো ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এর মধ্যে অধিকাংশ ইসলামী ব্যাংক ও কয়েকটি প্রচলিত ধারার ব্যাংক ক্যাশ ওয়াকফ হিসাবের মাধ্যমে ওয়াকফ ব্যবস্থাপনার সাথে জড়িত রয়েছে। ওয়াকফ তহবিলের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করছে দেশের শীর্ষস্থানীয় বাণিজ্যিক ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। ব্যাংকটি ২০০৪ সালের পহেলা জুলাই ক্যাশ ওয়াকফ সঞ্চয় হিসাব চালু করার পর ২০১৬ সালে এই ব্যাংকের সঞ্চয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭৫.২৬ কোটি টাকা। সঞ্চয়ের দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে আছে সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড। ব্যাংকটি ১৯৯৭ সালে ক্যাশ ওয়াকফ সঞ্চয় প্রকল্প চালু করে এবং বর্তমানে (২০১৬) ব্যাংকটির ওয়াকফ আমানতের স্থিতি হচ্ছে ২৩.৬৯ কোটি টাকা।
ইসলামী ব্যাংকগুলোর মধ্যে আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড, এক্সিম ব্যাংক লিমিটেড, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড এবং প্রচলিত ধারার এবি ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক এবং ব্যাংক এশিয়ায় ‘ক্যাশ ওয়াকফ’ হিসাব চালু আছে। নিচে ব্যাংকগুলোর ক্যাশ ওয়াকফ সঞ্চয়ের (পাঁচ বছরের) একটি চিত্র তুলে ধরা হলো: মুসলিম বিশ্বে ওয়াকফ, বিশেষ করে ক্যাশ ওয়াকফ’র বহুমুখী অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবদান রয়েছে। এমন অনেক অতি প্রয়োজনীয় সেবা রয়েছে যা রাষ্ট্রের পক্ষে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি, অথচ ওয়াকফ’র মাধ্যমে কম খরচে নাগরিকদের কাছে সেই সেবা পৌঁছে দেয়া সম্ভব হয়েছে। ক্যাশ ওয়াকফ এমন একটি পরহিত বা দান, যাতে সমাজের সচ্ছল ব্যক্তিরাই কেবল অংশ নিতে পারেন না; কম আয়ের মানুষ, এমন কি অসচ্ছল ব্যক্তিরাও তাতে অংশ নিতে পারেন। ফলে অধিকাংশ লোক ক্যাশ ওয়াকফতে অংশ নেয়ার মাধ্যমে একটি একক তহবিল গঠিত হওয়ার ফলে এটি দিয়ে সমাজসেবা বা সামাজিক উন্নয়ন যতটা দ্রুত ও কার্যকরভাবে করা যায়, সাধারণ ওয়াকফ দিয়ে তা সম্ভব হয় না। ক্যাশ ওয়াকফ’র ফলে দেশের নাগরিকদের সেবার জন্য যে খরচ হওয়ার কথা সরকারের, তা অনেকটা লাঘব হয় এবং সরকার অন্য খাতে তার বাজেট বরাদ্দের সুযোগ সৃষ্টি হয়। এ কথা অস্বীকার্য যে, ক্যাশ ওয়াকফ যুগ যুগ ধরে মুসলিম বিশ্বে সরকারের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রেখেছে। আধুনিক যুগেও ওয়াকফ’র অবদান এতটুকু কমেনি, বরং তার গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে। বাংলাদেশে সাধারণ ওয়াকফ চালু থাকলেও ক্যাশ ওয়াকফ’র বিষয়টি এখানে তেমন পরিচিতি লাভ করতে পারেনি। এ দেশে ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালুর পর থেকে ক্যাশ ওয়াকফ’র বিষয় সামনে আসে। সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক সর্বপ্রথম ১৯৯৭ সালে ক্যাশ ওয়াকফ সঞ্চয় প্রকল্প চালু করলেও এই বিষয়টির প্রতি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব প্রদান করেছে দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। ইসলামী ব্যাংক ক্যাশ ওয়াকফ প্রকল্প ২০০৪ সালে চালু করে অত্যন্ত সফলভাবে এই প্রকল্পের সঞ্চয় বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়। ফলে ব্যাংকটির ক্যাশ ওয়াকফ সঞ্চয়ের পরিমাণ ৭৫,২৬ কোটি টাকা, যা ব্যাংকগুলোর মোট ওয়াকফ আমানতের ৭১.২৪ শতাংশ। ইসলামী ব্যাংক ‘মুদারাবা ওয়াকফ ক্যাশ ডিপোজিট অ্যাকাউন্ট’-এর মাধ্যমে ওয়াকিফের কাছ থেকে ওয়াকফ আমানত গ্রহণ করে এবং এই আমানত বিনিয়োগ করে যে আয় হয়, তা থেকে ব্যাংকের ইচ্ছানুযায়ী বা ওয়াকিফের নির্দেশনা অনুযায়ী শরিআহসম্মত কতগুলো নির্দিষ্ট কল্যাণকর কাজে তা ব্যয় করে থাকে।
যেসব খাতে ওয়াকফ’র মুনাফা ব্যয় করা হয়, তা হলো :
১. দুস্থ পুনর্বাসন: ক্যাশ ওয়াকফ তহবিল থেকে গরিব, অসহায়, গৃহহীন মানুষের জীবনমান উন্নয়ন, শারীরিকভাবে অক্ষম, ভিক্ষুক ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন এবং শহরের দরিদ্র মানুষের সার্বিক অবস্থার উন্নয়ন করা।
২. শিক্ষা ও সংস্কৃতির উন্নয়ন: এতিম ও গরিব ছাত্র-ছাত্রীদের আনুষ্ঠানিক কিংবা অ-নানুষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা এবং তাদেরকে বিনামূল্যে শিক্ষাসামগ্রী প্রদান করা, দক্ষ মানুষ তৈরির জন্য শিক্ষার মান উন্নয়ন, শারীরিক ও কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, গরিব ছাত্র-ছাত্রীদের সাধ্যমতো বৃত্তির ব্যবস্থা করা, দুর্গম ও অবহেলিত অঞ্চলে শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণ করা।
৩. স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাতে সহযোগিতা: ক্যাশ ওয়াকফ’র আয় থেকে গ্রাম ও শহরের বস্তি বা দরিদ্রপল্লীর মানুষের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা, যেসব মানুষ দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত এবং অর্থের অভাবে অসুখ-বিসুখে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করতে অপারগ তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা; বস্তি, স্কুল, মসজিদসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা; গরিবদের জন্য হাসপাতাল, ক্লিনিক প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন চিকিৎসাসেবা পরিচালনা এবং স্বাস্থ্যসংক্রান্ত গবেষণায় অনুদানের ব্যবস্থা করা।
৪. সামাজিক সেবা কার্যক্রম: দরিদ্র, অনাথ ও অসহায় মেয়েদের যৌতুকবিহীন বিবাহ অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা, রাস্তা-ঘাটের উন্নয়ন ও বৃক্ষরোপণ করে পরিবেশের উন্নতি সাধন, জুয়া, মাদকাসক্তি ও অন্যান্য সামাজিক অনাচার রোধে সচেতনতা বৃদ্ধি, সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, আয়-বর্ধক কর্মসূচির মাধ্যমে মসজিদ, মাদরাসা, কবরস্থান ইত্যাদির উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করা। এখানে উল্লেখিত খাতসমূহে ব্যাংক ক্যাশ ওয়াকফ তহবিলের আয় থেকে ব্যয় করা ছাড়াও ওয়াকফকারী হিসাব খোলার সময় শরিআহ অনুমোদন করে, এমন যে কোনো কল্যাণ ও সেবামূলক খাতের কথা উল্লেখ করতে পারেন। এ কথা অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে উল্লেখ করা যায় যে, ওয়াকফ আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের অন্যতম উপায়। এটা মানুষের ব্যক্তি জীবনকেই সফল করে না, বরং তার পরকালীন জীবনের জন্যও অফুরন্ত সাওয়াবের পাথেয় জোগাড় করে। ওয়াকফ’র সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা দরিদ্র, অসহায় ও অক্ষম মানুষের নানা উপকার সাধন করে এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটাতে সাহায্য করে। তাই সমাজের সামর্থ্যবান লোকদের উচিত ওয়াকফ’র মতো কার্যকর আর্থিক কৌশলের সাথে যুক্ত হয়ে সদকায়ে জারিয়াহর সুবিধা গ্রহণ করা এবং এর মাধ্যমে দুনিয়া ও আখেরাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে এগিয়ে আসা। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের সবাইকে স্থায়ী সঞ্চয় ও কল্যাণের পথে অগ্রসর হওয়ার তৌফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড

No comments

Powered by Blogger.