'প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য' by আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী

আজ পাঁচ দিন ধরে গৃহবন্দি হয়ে আছি। সরকারি আদেশে নয়, প্রকৃতির আক্রোশে। লন্ডনে আছি ৪৪ বছর হয়ে গেল। আজ পাঁচ দিন ধরে সেই লন্ডনে (সারা ব্রিটেন) যে বরফপাত দেখছি, কয়েক বছর আগে তার চেয়েও ভয়াবহ বরফপাত দেখেছি, রাস্তায় হাঁটু পর্যন্ত বরফে গেড়ে গেছে; কিন্তু এ রকম একটানা দিনের পর দিন বরফপাত দেখিনি। সেই সঙ্গে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা এবং মাঝেমধ্যে তুষারঝড়। বিশ্ব আবহাওয়ায় একটা অবিশ্বাস্য পরিবর্তন ঘটছে। এ সম্পর্কে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ যথাসময়ে সতর্ক না হলে, ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে কোনো পরমাণু যুদ্ধের দরকার হবে না, বিশ্ব এমনিতেই ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাবে। গত কয়েক বছর ব্রিটেনের সারা বছরের আবহাওয়া দেখে মনে হচ্ছিল, উইন্টারেও বুঝি আর ছিটেফোঁটা বরফপাত ছাড়া বড় রকমের কিছু হবে না। কিন্তু এবারের উইন্টার জানিয়ে দিয়ে গেল, বিশ্বের আবহাওয়া এখন সত্যই অত্যন্ত অস্থিরমতি। বিশ্বের রাজনৈতিক নেতারা প্রকৃতিবিশারদ আধুনিক বিজ্ঞানীদের সহায়তায় প্রকৃতির এই পাগলামি দূর করা, জলবায়ু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা এবং পরিবেশ দূষণ বন্ধ করতে না পারলে বা না চাইলে ইসরাফিলের শিঙা সহসা একদিন বেজে উঠবেই। তা বহুদূরে ভাবলে ভুল করা হবে। ব্রিটেনে এ ক'দিনের তুষারপাতেই (প্রায় সারা ইউরোপ) স্কুল, কলেজে ছুটি দিতে হয়েছে।
ট্রেন টিউব চলাচলে বিঘ্ন ঘটেছে। বিভিন্ন এয়ারপোর্ট থেকে অসংখ্য ফ্লাইট বাতিল হয়েছে। বোঝা যাচ্ছে, প্রকৃতি ও বিজ্ঞানের যুদ্ধে বিজ্ঞান জয়ী হতে থাকলেও মাঝেমধ্যে প্রকৃতিও পরাজয়ের শোধ নেয়। আমরা প্রকৃতির কল্যাণ হস্ত দেখেছি, আবার তার ধ্বংসের বাহুও দেখেছি। এই বাহু একটি নয়, অনেক। ইউরোপ-আমেরিকায় যেমন আছে ভূমিকম্প, তুষারঝড়, বন্যা ও ভূমিধস; তেমনি এশিয়া ও আফ্রিকাতে আছে বন্যা, সাইক্লোন, খরা, আবহাওয়াজাত নানা রকম ব্যাধি। সেই সঙ্গে ভূমিধস ও নদীভাঙন। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের নিজস্ব কৃতকর্মও তার নিজের ধ্বংসের যে নতুন বীজ তৈরি করেছে তা হলো, মারণাস্ত্র ও পরিবেশ দূষণ। পৃথিবী একদিন ধ্বংস হবে- এটা ধর্মবিশ্বাসী মানুষ মাত্রই অবধারিত সত্য বলে জানে। ছোটবেলায় শুনতাম, একটি পুঁথির বয়ান, যা মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত ছিল- 'শোন মুমিন মুসলমান/করি আমি নিবেদন/এ দুনিয়া ফানা (ধ্বংস) হবে কিছুই রবে না।' বিজ্ঞানীরাও বহুকাল বিশ্বাস করেছেন, পৃথিবী একদিন ধ্বংস হবে। এখন কেউ কেউ ভাবছেন, শত বিপর্যয়ের মধ্যেও মানুষ তার বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনী বুদ্ধি দ্বারা পৃথিবী নামক গ্রহটিকে বাঁচাবেন। মানবসভ্যতা হয়তো রক্ষা পাবে; কিন্তু এই আশাবাদে বিশ্বাসী হওয়ার সুযোগ কোথায়? সম্প্রতি ইউরোপ ও আমেরিকারই কয়েকজন বুদ্ধিজীবী সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন, 'পৃথিবীতে একটি পরমাণু ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হওয়ার আশঙ্কাই এখন সবচেয়ে বেশি।' ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর এই আশঙ্কা বেড়েছে বলে তারা মনে করেন। আমি পণ্ডিত নই, বিজ্ঞানীও নই; একজন নগণ্য সাংবাদিক। আমার ধারণা, ডোনাল্ড ট্রাম্প যতই দুষ্টবুদ্ধির লোক হন; তার আমলে পরমাণু যুদ্ধ বাধার আশঙ্কা কম। আঞ্চলিক ও প্রচলিত অস্ত্রের যুদ্ধ বাড়তে পারে; কিন্তু পরমাণু অস্ত্রের যুদ্ধ নয়। ট্রাম্প বাক্যবাগিশ লোক, যুদ্ধবাগিশ লোক নন। তাছাড়া হোয়াইট হাউসে বসার পর থেকেই তিনি নানা চাপের মধ্যে আছেন। একদিকে নারীঘটিত কেলেঙ্কারি; অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকালে রাশিয়ান কানেকশনের তদন্ত। তিনি বাগাড়ম্বরপ্রিয় প্রেসিডেন্ট। বাগাড়ম্বরপ্রিয় ব্যক্তিরা কখনও সাহসী হন না। তার হোয়াইট হাউস প্রশাসনেও এখন স্থিতিশীলতা নেই। তার নিজস্ব ব্যক্তিদেরই তিনি হয় একের পর এক বরখাস্ত করছেন অথবা তারা চলে যাচ্ছেন। একটি পরমাণু যুদ্ধের আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে আমেরিকার। আশঙ্কাটি যে এখনও নেই তা বলছি না। কিন্তু উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক যুদ্ধ ও বাগ্‌যুদ্ধে আপাতত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের পরাজয় হয়েছে। এই পরাজয়ের পরিণতি- দক্ষিণ কোরিয়ায় আমেরিকার প্রভাব আরও হ্রাস এবং দুই কোরিয়ার মধ্যে বৈরিতার বদলে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি। উত্তর কোরিয়ার কমিউনিস্ট নায়ক কিমকে রণোন্মাদ, বর্বর স্বৈরাচারী, বুদ্ধি-বিবেচনাহীন ডিক্টেটর হিসেবে পশ্চিমা বিশ্ব যে প্রচারণা চালাচ্ছে, তা যে কত অতিরঞ্জন তা শিগগিরই প্রমাণ হবে। দক্ষিণ কোরিয়ায় এবার যে উইন্টার অলিম্পিক হয়ে গেল, তাতে উত্তর কোরিয়ার সৌজন্য দূত হয়ে এসেছিলেন কিমের বোন। তাকে বসতে দেওয়া হয়েছিল ডোনাল্ড ট্রাম্পের কন্যা ইভাঙ্কা এবং সেখানকার মার্কিন আঞ্চলিক সেনাবাহিনী প্রধান এক জেনারেলের পাশে। কিমের বোনকে দেখে দক্ষিণ কোরিয়ার মানুষ বিপুলভাবে অভিনন্দন জানিয়েছে। তিনি যখন বলেছেন, 'উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার মানুষ একই জাতি এবং একই রক্ত তাদের ধমনিতে প্রবাহিত'; তখন করতালিতে স্টেডিয়াম ফেটে পড়ার উপক্রম হয়েছিল। এই দৃশ্য দেখে একাধিক মার্কিন মিডিয়াতেই বলা হয়েছে, দক্ষিণ কোরিয়ায় আমেরিকার সামরিক উপস্থিতি ও রাজনৈতিক প্রভাব বজায় রাখার দিন শেষ হয়ে এসেছে। দক্ষিণ কোরিয়ার মানুষ, এমনকি বর্তমান ক্ষমতাসীন নেতাদের অনেকেও বুঝতে পেরেছেন, দুই কোরিয়াকে পরস্পরের বিরুদ্ধে লাগিয়ে রেখে আমেরিকা এই অঞ্চলে তার সামরিক ও রাজনৈতিক আধিপত্য বজায় রাখতে চায়। উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে আমেরিকা কোনো হামলা চালাতে চাইলে দক্ষিণ কোরিয়াকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করবে এবং প্রথম ধ্বংস হবে দক্ষিণ কোরিয়া।
আমেরিকার এই অভিসন্ধি বুঝতে পেয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলো থেকে প্রায় প্রতিমাসেই ছাত্রছাত্রীরা বিশাল প্রতিবাদ মিছিল বের করেন এবং দক্ষিণ কোরিয়ার মাটি থেকে মার্কিন যুদ্ধঘাঁটি অপসারণের দাবি জানান। এই দাবির মুখে আমেরিকাকে একদিন দক্ষিণ কোরিয়া ছাড়তে হবে। সন্দেহ নেই, আমেরিকা এখনও যদি বিশ্বে পরমাণু শক্তিধর একমাত্র রাষ্ট্র হতো, তাহলে আরও অনেক হিরোশিমা, নাগাসাকির মতো ভয়াবহ বিপর্যয় সৃষ্টি করে ছাড়ত। কিন্তু আমেরিকা এখন আর পরমাণু মারণাস্ত্রের একক অধিকারী দেশ নয়। কয়েকটি পশ্চিমা দেশ ছাড়াও রাশিয়া, চীন, ভারত, পাকিস্তান, ইসরায়েলের হাতে রয়েছে ছোট-বড় এই মারণাস্ত্র। উত্তর কোরিয়ার হাতে আছে এই মারণাস্ত্র, যা বোতাম টিপলেই আমেরিকা পর্যন্ত পৌঁছতে পারে। ইরানকে আমেরিকা চাপে রেখেছে। ইরান পশ্চিমা দেশগুলোর অর্থনৈতিক অবরোধের ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারলে বিশ্বে আরেকটি পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হবে এবং নিউক্লিয়ার ক্লাবের আরেক সদস্য হতে চাইবে, তাতে সন্দেহ নেই। এই অবস্থায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যতই হম্বিতম্বি করুন, উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে সহসা পরমাণু যুদ্ধে নামবেন- এটা বিশ্বাস করা কঠিন। মার্কিন এস্টাবলিশমেন্ট ডোনাল্ড সাহেবের মতো মাথা মোটা নয়। তারা জানে, ১৯৪৫ সালের জাপানের মতো উত্তর কোরিয়ার অবস্থা নয়। সেখানে হামলা চালাতে গেলে পল্টি খেতে হবে। ফলে উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে অনেক হুমকি-ধমকি দিলেও ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজের কন্যা ও জেনারেলকে দক্ষিণ কোরিয়ার অলিম্পিকে পাঠিয়ে এবং উত্তর কোরিয়ার নেতার বোনের পাশে বসিয়ে প্রীতি সম্ভাষণ বিনিময়ের সুযোগ গ্রহণ করেছেন। তাই ইউরোপ-আমেরিকার অনেক সুধীজনের মতো আমারও ধারণা, বর্তমান বিশ্বে সহসা পরমাণু যুদ্ধ শুরু হবে, এই আশঙ্কা কম। আঞ্চলিক ও প্রচলিত অস্ত্রের যুদ্ধ বাড়তে পারে, দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে- সে কথা আগেই বলেছি। কিন্তু তাতেও পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কা থেকে মুক্ত হয়নি এবং এই আশঙ্কা দিন দিন বাড়ছে। পরমাণু হামলা ঠেকানোর তবু পথ আছে। কিন্তু প্রকৃতির এই আকস্মিক ভয়াবহ হামলা প্রতিরোধের কোনো কার্যকর পন্থা এখনও আবিস্কৃত হয়নি। ঝড় আসছে, ভূমিকম্প হবে- এ সম্পর্কে আবহাওয়া বিভাগ আগাম সতর্কবাণী সবাইকে জানাতে পারে। কিন্তু প্রকৃতির ছোবল এড়াতে পারে না। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এত অভাবনীয় উন্নতির যুগেও 'বিস্ট ফ্রম দ্য ইস্ট' নামের প্রাকৃতিক এই মহাপ্রলয় থেকে ইউরোপ বাঁচতে পারল কি? তবে বৈজ্ঞানিক উন্নতির ফলে ক্ষয়ক্ষতি কিছুটা কমাতে পেরেছে। আমার ধারণাটা সঠিক কিনা জানি না; কিন্তু এ ধারণাটা হলো, সহসা একটি পরমাণু যুদ্ধ বাধার আশঙ্কা বর্তমানে অনেক কম এবং পরমাণু যুদ্ধ দ্বারা পৃথিবী ধ্বংস হবে- এই আশঙ্কার চেয়েও বড় আশঙ্কা, প্রাকৃতিক মহাপ্রলয়েই পৃথিবী একদিন ধ্বংস হবে। আর মানুষই নিজেদের লোভের বশে প্রকৃতিকে খেপিয়ে তুলেছে। তার কল্যাণশক্তিকে সহযোগিতার হাত না বাড়িয়ে তার ধ্বংসশক্তিকে আবাহন করছে। রোদ, জ্যোৎস্না, ফুল-ফল, শ্বাস নেওয়ার বাতাস, পানি, ফসল সবই তো প্রকৃতির কল্যাণের দান। আবার ঝড়, বন্যা, মহামারী, ভূমিকম্প, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস, অগ্নিঝড়, তুষারঝড় প্রকৃতিরই ধ্বংসশক্তির প্রকাশ। আমরা প্রকৃতির কল্যাণ হস্তের অবদানকে বিশ্বময় সম্প্রসারণের ব্যবস্থা করিনি। ক্যাপিটালিজম তাকে কিছু মানুষের ভোগের ও লোভের বস্তু করেছে। আর প্রকৃতির ধ্বংসশক্তি থেকে নাপাম বোমা, পরমাণু বোমা, কেমিক্যাল অস্ত্র বানিয়ে মানব ও মানবসভ্যতাকে ধ্বংসের ভয়াবহ ব্যবস্থা করে রেখেছি। আমরা সুন্দরবন ধ্বংস করছি। কিন্তু একটা সুন্দরবন তৈরি করতে পারছি না। নানা বিষাক্ত অস্ত্রের বিস্ম্ফোরণ ঘটিয়ে পৃথিবীর আলো, বাতাস, জল দূষিত করছি। তা থেকে বিস্তার ঘটছে ভয়াবহ রোগের। তার প্রতিকারের পথ না খুঁজে আধিপত্যবাদী স্বার্থে নিত্যনব মারণাস্ত্র তৈরি করে মানবসভ্যতা ও সমগ্র জীবজগতের অস্তিত্ব ধ্বংসের পথে এগোচ্ছি। পৃথিবী আজ রবীন্দ্রনাথের ভাষায়- 'মানুষ জন্তুর হুঙ্কারে' পূর্ণ। এ ক্ষেত্রে প্রকৃতির আর দোষ কী? পরিবেশবান্ধব দুনিয়া তো গড়তে চান না রাষ্ট্রপতি ও রাজনৈতিক নেতারা। যারা চান তারা সংখ্যালঘু। আধুনিক সভ্যতার একটি শীর্ষ দেশ ব্রিটেনের রাজধানী লন্ডনে বরফ আর তুষারঝড়ে গৃহবন্দি হয়ে ভাবছি, বিশ্ব কি কোনো একদিন নিজেদের লোভ ও প্রকৃতির রোষ থেকে মুক্ত নতুন দুনিয়া গড়ার পথে এগোতে পারবে, নাকি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সব উন্নতি, সভ্যতার এত অগ্রগতি সত্ত্বেও ধ্বংসের পথে এগোবে? এই প্রশ্নের জবাব আমার জানা নেই। বহু বছর আগে এ ধরনের এক সংকট সম্পর্কে লেখা আমার একটি কলামের শিরোনাম দিয়েছিলাম কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের একটি বিখ্যাত কবিতার পঙ্‌ক্তি ধার করে। এই লেখাটিও সেই একই শিরোনাম দিয়ে শেষ করছি- 'প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য/ ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা...।'

No comments

Powered by Blogger.