নোবেল বিজয়ী তিন নারীর সফর

নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী তিন নারী ম্যারিয়েড ম্যাগুয়ার, শিরিন এবাদি ও তাওয়াক্কল কারমান রোহিঙ্গা সংকট গভীরতর হওয়ার অনেক আগেই নোবেল বিজয়ী অং সান সু চির প্রতি রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার নিশ্চিত করতে আহ্বান জানিয়েছিলেন। শুধু তাঁরা তিনজনই নন, আরও অনেক নোবেল বিজয়ী বিভিন্ন সময় বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে মিয়ানমারের নেত্রীর কাছে সহমর্মিতা আশা করেছিলেন। এখন বাংলাদেশ সফরে সরেজমিনে প্রত্যক্ষ করে তিন নোবেল বিজয়ী নারীর আবেদন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে কতটা বাড়তি গুরুত্ব পায়, সেটাই এখন দেখার বিষয়। তবে এই নোবেল বিজয়ী তিন নারী যে মিয়ানমার ইস্যুকে অসম্ভব গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন, তা পরিষ্কার। বাংলাদেশ থেকে ফিরেই তাঁরা মিয়ানমারে যাওয়ার জন্য ভিসার আবেদন করবেন। তাঁদের উদ্দেশ্য সু চির সঙ্গে সরাসরি কথা বলে তাঁর কাছেই কৈফিয়ত চাওয়া। নোবেলজয়ী এই তিন নারীই মনে করেন, রোহিঙ্গাদের সঙ্গে যা ঘটেছে তা গণহত্যার সংজ্ঞায় পড়ে। শরণার্থী শিবিরে তাঁরা যে ১০০ জন নারীর সঙ্গে কথা বলেছেন, তাঁরা সবাই ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। তাই তাঁরা অকপটে বলতে পেরেছেন যে মিয়ানমারে যা ঘটেছে, তা আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে বিচার হওয়ার যোগ্য। আমরা এ-সংক্রান্ত বিচারের দিকে শুরু থেকেই গুরুত্বারোপ করে আসছি। তবে বিষয়টি মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিষেধাজ্ঞাসহ কঠোর মনোভাব কখন কীভাবে কতটা কাজ করে তার ওপর নির্ভরশীল। এ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোসহ আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর তরফে যতটা চাপ এসেছে, তা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর প্রাধান্যনির্ভর সরকারের ঘুম ভাঙানোর জন্য যথেষ্ট বলে প্রমাণিত হয়নি। অন্যদিকে ভারত, চীন ও রাশিয়ার মতো দেশগুলো দুর্ভাগ্যজনকভাবে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করা থেকে বিরত রয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমার শরণার্থী প্রত্যাবাসন চুক্তি করলেও বাস্তবে পদ্ধতিগতভাবে রোহিঙ্গাবিরোধী রাষ্ট্রীয় নীতি এবং কালাকানুনে কোনো মৌলিক পরিবর্তন লক্ষণীয় নয়। নোবেল বিজয়ী তিন নারী বলেছেন, চিঠির পর চিঠি লিখেও তাঁরা সু চির কোনো জবাব পাননি।
তবু তাঁরা হাল ছাড়বেন না। অং সান সু চির মানবাধিকার রক্ষায় একসময় বিশ্ব সম্প্রদায় সোচ্চার ছিল, তারই সতীর্থ তিন নোবেলজয়ী নারী যখন তাঁর সাক্ষাৎ চাইবেন তখন এর ফলাফল কী হবে তা দেখার জন্য বিশ্ববাসী অপেক্ষা করবে। বন্দী সু চিকে দেখতে এই তিন নোবেলজয়ীর দুজন ভিসা চেয়েও ভিসা পাননি। এবার রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার রক্ষায় তাঁদেরই ভিসার আবেদন নাকচ হবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত সুচিকেই দিতে হবে। কারণ, তিনি দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী। নোবেল বিজয়ী তিন নারীর বাংলাদেশে ছুটে আসার ঘটনাকে আমরা ‘মানবতার প্রতি একটি মাইলফলক সাড়া’ হিসেবে গণ্য করি। নারীপক্ষের আলোচনায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার মাধ্যমে মানবাধিকার রক্ষায় তাঁরা বাংলাদেশের সরকার এবং জনগণকে স্যালুট জানান। বাংলাদেশে আসার জন্য আমরাও তাঁদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। আমরা আশা করব, নোবেল বিজয়ী এই তিন নারীর বাংলাদেশ সফর রোহিঙ্গাদের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত গঠনে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে গণহত্যাকারীদের কাঠগড়ায় তুলতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব পাস হওয়া দরকার বলে ইরানের শিরিন এবাদি যথার্থই মন্তব্য করেছেন। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, সুদানের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা পরিষদ তাই করেছিল। মিয়ানমার রোম সংবিধিতে সই করেনি বলে সেখানে তাদের কারও বিচার হবে না, সেটা আসলে কোনো যুক্তির কথা নয়। মিয়ানমারের গণহত্যার বিচারে ব্যর্থ হওয়ার পরিণাম বিশ্বকে আরও চরম মূল্যে শোধ দিতে হতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.