পাকিদের কাছেও খেই হারাল ভারত by মোঃ এনামুল হাসান

টেস্টই নাকি সত্যিকারের ক্রিকেট। তাহলে ওয়ানডে কি ভালমন্দ বিশ্লেষণে না গেলে দুইয়ের মাঝামাঝি কিছু! আসলে ওয়ানডেটাই হচ্ছে আধুনিক যুগের প্রথম চিত্তাকর্ষক ক্রিকেট। সেই ১৯৭১ সালে আবির্ভাবের পর থেকে অদ্যাবধি উইলো-গোলকের লড়াইয়ে সমান জনপ্রিয় পঞ্চাশ ওভারের ম্যাচ।
আর সেই সত্তরের দশক থেকেই খেলাটির আনন্দ-উত্তেজনার পালে নব হাওয়া যোগ করতে যে দেশগুলো গুরুত্বপূর্ণ, ভারত-পাকিস্তান তার অন্যতম। কারণটাও অনুমেয়। পঞ্চাশ ওভারের ফরমেটে প্রথম বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৫ সালে, দ্বিতীয়টি ১৯৭৯তে। তার আগে ১৯৭৮-এ স্বল্পদৈর্ঘ্যরে ক্রিকেটে বাড়তি উন্মাদনার জন্ম দিতে দিপক্ষীয় লড়াইয়ে মুখোমুখি হয় চিরশত্রু ভারত-পাকিস্তান। দু’দেশের লড়াই ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার মধ্যকার ঐতিহাসিক এ্যাশেজের চেয়েও অধিক উত্তাপ ছড়িয়ে যায় ক্রিকেটবিশ্বে। এবারের আয়োজন ঘিরেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আর সেই উন্মাদনার লড়াইয়ে ভারতেরই মাটিতে এসে ভারতকে নাস্তানাবুদ করে গেল মিসবাহ-উল হকের পাকিস্তান। ২ ম্যাচের টি২০ সিরিজ ১-১এ ড্রর পর তিন ম্যাচের ওয়ানডেতে চিরশত্রুদের ২-১এ হারায় তারা।
চেন্নাইয়ের প্রথম ওয়ানডেতে ৬ উইকেটে ও কলকাতার দ্বিতীয় ম্যাচে ৮৫ রানের বিশাল ব্যবধানে জয়ের মধ্য দিয়ে এক ম্যাচ হাতে রেখেই সিরিজ নিশ্চিত করে সফরকারী পাকিস্তান। তবে মান রক্ষার শেষ ম্যাচে সফরকারীদের ১০ রানে হারিয়ে ইজ্জত বাঁচায় মহেন্দ সিং ধোনির ভারত। উন্মাদনার প্রথম ওয়ানডেতে পাকিদের কাছে পাত্তাই পায়নি স্বাগতিক ভারত! টক্কর তো দূরের কথা, ব্যাটিং ব্যর্থতায় মিসবাহ-উল হকদের বিরুদ্ধে খুব একটা প্রতিরোধও গড়তে পারেনি মহেন্দ্র সিং ধোনির দল। চেন্নাইয়ের প্রথম লড়াইয়ে ৬ উইকেটের জয় নিয়ে বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে হারের বদলার পাশাপাশি তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে ১-০তে এগিয়ে যায় অতিথিরা। ওপেনার নাসির জামসেদের ক্ল্যাসিক্যাল সেঞ্চুরির ওপর ভর করে ভারতের ছুড়ে দেয়া ২২৮ রানের চ্যালেঞ্জ ১ ওভার ৫ বল হাতে রেখেই টপকে যায় পাকিস্তান, হারাতে হয় মাত্র ৪ উইকেট। হারা ম্যাচে স্বাগতিকদের সান্ত¡না, ড্যাশিং সেঞ্চুরির জন্য অধিনায়ক ধোনির হাতে ওঠা ম্যাচসেরার পুরস্কার!
সিরিজে টিকে থাকতে দ্বিতীয় ওয়ানডেতে তাই জয়ের বিকল্প ছিল না ভারতের সামনে। কলকাতার সে ম্যাচেও স্বাগতিক ভারতকে ৮৫ রানে হারিয়ে এক ম্যাচ হাতে রেখে সিরিজ জয়ের পাশাপাশি ‘পয়মন্ত ইডেনে’ নিজেদের শতভাগ সাফল্যের ধারা অব্যাহত রাখে পাকিস্তান। পাকিদের ছুড়ে দেয়া ২৫০ রানের চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করতে গিয়ে ১৬৫ রানে গুটিয়ে যায় ভারতীয়দের ইনিংস। যার মধ্য দিয়ে ইডেনের ইতিহাসে ভারতের বিরুদ্ধে খেলা চার ম্যাচের সব ম্যাচ জয় পায় সফরকারীরা। জয়ের ধারা অব্যাহত রেখে বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের কপালে আরও একটি হতাশার তিলক এঁকে দেয় মিসবাহ-উল হক বাহিনী। ব্যাট হাতে দুরন্ত সেঞ্চুরি উপহার দিয়ে পাকিদের জয়ের নায়ক ছিলেন ওপেনার নাসির জামসেদ।
টানা দুই হারে মান সম্মান সবই ডোবার উপক্রম হয় ধোনিদের। ইজ্জত বাঁচাতে, ধবল ধোলাই ঠেকাতে শেষ ম্যাচে জয়ের বিকল্প ছিল না। কঠিন সে পরিস্থিতিতে দিল্লীর তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডেতে চিরশত্রু পাকিস্তানকে ১০ রানে হারিয়ে সান্ত¡নার জয় নিয়ে উন্মাদনার দ্বিপক্ষীয় আয়োজন শেষ করে ভারত। যে জয়ের মধ্য দিয়ে ঘরের মাটিতে ‘হোয়াইটওয়াশ লজ্জা’ এড়াল বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা! কলকাতার মতো দিল্লীতেও টসভাগ্যে জয়লাভ করে ব্যাটিং বেছে নেন অধিনায়ক ধোনি। লো-স্কোরিং ম্যাচে আগে ব্যাট করে ৪৩.৪ ওভারে মাত্র ১৬৭ রানে গুটিয়ে যায় স্বাগতিকদের ইনিংস। বোলারদের নৈপুণ্যে ৪৮.৫ ওভারে প্রতিপক্ষকে ১৫৭ রানে অলআউট করে দিয়ে দারুণ এক জয় তুলে নেয় ক্রমাগত ব্যর্থতায় দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া ভারত। ইজ্জত রক্ষার লড়াইয়ে ৩৬ রানের ধৈর্যশীল ইনিংস খেলে ম্যাচসেরা হন ভারত অধিনায়ক ধোনি। পুরো দ্বৈরথে অসাধারণ ব্যাটিংশৈলী উপহার দেয়ায় সিরিজসেরার পুরস্কার ওঠে পাকিস্তান ব্যাটসম্যান নাসির জামসেদের হাতে।
তার আগে দুই ম্যাচের সিরিজে লড়াইটা হয় সেয়ানে-সেয়ানে। প্রথম টি২০তে টস জিতে ফিল্ডিং নেয়া হাফিজকে জয়ের রাস্তাটা তৈরি করে দেন মূলত বোলাররাই। যেখানে বল হাতে নেতৃত্ব দেন টি২০’র অন্যতমসেরা পেসার উমর গুল (৩/২১) ও সেনসেশনাল অফস্পিনার সাঈদ আজমল (২/২৫)। দুই তারকার বোলিং তোপে মাত্র ১৩৩ রানে থেমে যায় ভারতের ইনিংস। জবাব দিতে নেমে ব্যাট হাতে বাকি কাজ সারেন হাফিজ-মালিক। ইশান্ত শর্মার বলে ভুবনেশ্বর কুমারের হাতে ক্যাচ তুলে দিয়ে সাজঘরে ফেরার আগে ৪৪ বলে ৬ চার ও ২ বিশাল ছক্কার সাহায্যে ৬১ রান করেন হাফিজ। ক্যারিয়ারের তৃতীয় টি২০ হাফ সেঞ্চুরির হাঁকিয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন হাফিজ। স্পিনার রবিন্দ্র জাদেজার করা ২০তম ওভারের চতুর্থ বলে ছক্কা হাঁকিয়ে দলকে জয়ের বন্দরে পৌঁছে দেন শোয়েব মালিক। নিজেকে খুঁজে ফেরা এ অলরাউন্ডার ৫ বলে ৩ চার ও ৩ ছক্কায় ৫৭ রানে অপরিজত থাকেন মালিক। ৩ ওভারে স্কোর বোর্ডে ১২ রান জমা হতেই শীর্ষ তিন ব্যাটসম্যান সাজঘরেÑ জয়ের জন্য ১৩৪ রানও মনে হয় বহু দূরের পথ। কিন্তু সেখান থেকেই দলকে দারুণ এক জয় এনে দেন দলপতি মোহাম্মদ হাফিজ। তার দুরন্ত হাফ সেঞ্চুরির ওপর ভর করে দুই ম্যাচ টি২০’র প্রথমটিতে ভারতকে ৫ উইকেটে হারিয়ে সিরিজে ১-০তে এগিয়ে যায় সফরকারী পাকিস্তান। বহুল প্রতীক্ষিত উন্মাদনার প্রথম ময়দানী লড়াইয়েই ৬১ রানের দৃষ্টিনন্দন ইনিংস খেলে ম্যাচসেরা হন পাক-অধিনায়ক। তবে যুবরাজ সিংয়ের দুরন্ত ব্যাটিংয়ের ওপর ভর করে সফরকারী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় ও শেষ টি২০তে ১১ রানের দারুণ এক জয় পায় ভারত। রোমাঞ্চকর সে জয়ের মধ্য দিয়ে পিছিয়ে পড়েও দুই ম্যাচের সিরিজ ১-১ সমতায় শেষ করে মহেন্দ্র সিং ধোনির দল। আহমেদাবাদের সিরিজ নির্ধারণী লড়াইয়ে টসে হেরে ব্যাটিং পেয়ে নির্ধারিত ২০ ওভারে ৫ উইকেটে ১৯২ রানের চ্যালেঞ্জিং স্কোর গড়ে স্বাগতিক ভারত। জবাবে অধিনায়ক মোহাম্মদ হাফিজের হাফ সেঞ্চুরি ও আহমেদ শেহজাদের দৃঢ়তাপূর্ণ ব্যাটিং সত্ত্বেও ৭ উইকেটে ১৮১ রানে থেমে যায় পাকিস্তানের রানের চাকা। চিরশত্রুদের বিরুদ্ধে দুরন্ত জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে ধোনির দল। অসাধারণ ব্যাটিংশেলী উপহার দিয়ে ম্যাচসেরা হন ভারতের বিশ্বকাপজয়ের নায়ক যুবরাজ সিং। আর সিরিজসেরার পুরস্কার ওঠে পাক দলপতি মোহাম্মদ হাফিজের হাতে।
২০০৭-এর নবেম্বর সর্বশেষ ভারত সফর করে পাকিস্তান ক্রিকেট দল। এরপর ২০০৮Ñএ মুম্বাইয়ের তাজ হোাটেলে পাকিস্তানী সন্ত্রাসীদের জঙ্গী হামলার সূত্র ধরে দু’দেশের সম্পর্কের অবনতি হলে আর দ্বিপক্ষীয় সিরিজ খেলেনি ভারত-পাকিস্তান। আর ভারত পাকিস্তানের মাটিতে খেলতে গিয়েছিল তারও প্রায় দুই বছর আগে ২০০৬-এর ফেব্রুয়ারিতে। পাঁচ বছর পর তাই এবারের ভারত-পাকিস্তান দ্বিপক্ষীয় সিরিজ নিয়ে গোটা দুনিয়ারই আগ্রহ ছিল তুঙ্গে। পাক-ভারত ক্রিকেটের দীর্ঘ বিরতির নজিরটা অবশ্য এবারই ছিল না। এর আগে ১৯৬২ থেকে শুরু হওয়ার পর ১৯৬৫-১৯৭১ পর্যন্ত ৬ বছর যুদ্ধের জন্য সিরিজ অনুষ্ঠিত হয়নি। ১৯৯৯-২০০৪ পর্যন্ত ৫ বছর কারগিল যুদ্ধের জন্যও সিরিজ বন্ধ ছিল। অতঃপর ২০০৭-২০১২! ১৯৪৭ সালে ভূখ-ীয় বিভক্তির মধ্য দিয়ে পৃথক স্বাধীন ভারত-পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হলেও অদ্যাবধি ধর্ম-বর্ণ-রাজনীতিসহ কোন সম্পর্কেই সহমতে আসতে পারেনি এশিয়ার দুই সুপার পাওয়ার, বরং কাশ্মীর-কারগিলসহ একাধিক ইস্যুতে বারকয়েক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া, বার বারই চিরবৈরী দু’দেশকে কাছে টেনে সম্পর্কোন্নয়নের মেলবন্ধ তৈরির পথ করে দিয়েছে ক্রিকেট। দীর্ঘদিন পর উইলো-গোলকের সেই দ্বিপক্ষীয় লড়াই-ই আবার ভারত-পাকিস্তানে উষ্ণ সম্পর্কের নতুন বারতা নিয়ে হাজির হলো এবারও।

No comments

Powered by Blogger.