দু’জনার দুটি পথ দু’দিকে গেছে বেঁকে by মাহমুদুন্নবী চঞ্চল

 ফুটবল ঈশ্বর ম্যারাডোনার হাত ধরেই পরিচয়। অতঃপর প্রেম, রোমান্স, বিয়ে। বছরখানেক পরই সুখী সংসারে পুত্রসন্তান বেঞ্জামিনের আগমন। বেশ ভালই কাটছিল সময়। মাঠে দুরন্ত পারফরমেন্স করে যাচ্ছিলেন সার্জিও এ্যাগুয়েরো।
অন্যদিকে ঘরসংসার আর সন্তানের দেখভাল নিপুণভাবেই সারছিলেন জিয়ান্নিনা। এরই মাঝে মাদ্রিদ থেকে উড়ে আসলেন সপরিবারে ম্যানচেস্টারে। এখানেও দাম্পত্য জীবনটা ছিল রঙিনই। তবে হঠাৎই ছন্দপতন। দু’জনের মিলের অভাব, একে অপরের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ। অতঃপর ছাড়াছাড়ি। সংসার ভাঙল ম্যারাডোনার ছোট মেয়ের। নতুন বছরের শুরুতেই এমন খবরটি বিশ্বকে জানিয়েছেন জিয়ান্নিনা-এ্যাগুয়েরো দম্পতি। নতুন বছরে নতুন উদ্দীপনায় সবাই শুরু করে পথচলা, সেখানে এ্যাগুয়েরো ২০১৩ সাল শুরু করলেন ভাঙ্গা হৃদয়ে। ‘ম্যারাডোনার মেয়ের জামাই’ খেতাবটি হয়ে গেল অতীত। মাত্র চার বছরের সংসার। ঘরে ছিল ফুটফুটে জুনিয়র কুন এ্যাগুয়েরো। বাবা ম্যারাডোনার খ্যাতি, স্বামী এ্যাগুয়েরোর সেনসেশনাল ইমেজ। অর্থকড়িরও সমস্যা থাকার কথা নয়। কেন এই বিচ্ছেদ? কেউ দোষ দিচ্ছেন এ্যাগুয়েরোকে, কেউবা জিয়ান্নিনাকে। শেষদিকে জিয়ান্নিনার লাইফ স্টাইল কিছুটা ছন্দহীন হয়ে পড়েছিল। পার্টি জীবনে প্রবেশ করেছেন তিনি, যা নাকি একদম পছন্দ করেননি এ্যাগুয়েরো। অন্যদিকে আর্জেন্টিনা মিডিয়ার খবর, দেশটির সঙ্গীত তারকা কারিনা তাজেদার সঙ্গে প্রণয় চলছে ম্যানসিটি তারকা এ্যাগুয়েরোর, যা মেনে নিতে পারেননি জিয়ান্নিনা। সব মিলিয়ে সংসারে আগুন, অতঃপর ঘূর্ণিঝড়। কয়েকদিন আগে বিচ্ছেদের খবরটি প্রথম প্রকাশ করেন ম্যারাডোনার মেয়ে জিয়ান্নিনাই। টুইটারে তিনি নিশ্চিত করেন, ‘আমরা আলাদা হয়ে গেছি। একটা কঠিন বছর অবশেষে শেষ হলো। অনেক কিছু বদলে গেছে এই সময়টাতে।’ এমন টুইটের বিপরীতে জিয়ান্নিনার এক অনুসারী লিখেছিলেন, ‘এ্যাগুয়েরো তোমার যোগ্য নয়। ও একটা গর্দভ, নির্বোধ।’ তবে এমন টুইট খুব একটা সমর্থন করেননি জিয়ান্নিনা। স্বামীর প্রতি কিছুটা দরদ রেখে বলেছেন, ‘এভাবে বলবেন না। ও আমার ছেলের বাবা। আর আপনি যা বলছেন, ও মোটেও সে রকম নয়। যখন একটা জুটির সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়, তাতে দু’জনেরই দোষ থাকে।’
সাবেক স্ত্রীর এমন টুইট হৃদয়টা চুরমার করে দিচ্ছে এ্যাগুয়েরোকে। কারণ তিন বছরের ফুটফুটে বেঞ্জামিন এ্যাগুয়েরোর কলিজার টুকরো। অবসরে ছেলের সঙ্গেই কাটত তার সময়। হৃদয়ের সব ভালবাসা যেন জমা ছিল ছেলের জন্য। একদিন পরই বিচ্ছেদের ব্যাপারে মুখ খোলেন এ্যাগুয়েরো। যাতে ছেলের বেদনায় নীল হতে দেখা গেছে তাঁকে। বেঞ্জামিনকে ছাড়া বাঁচতে পারবেন না বলেও জানিয়ে দিয়েছেন ২৪ বছর বয়সী এই তারকা ফরোয়ার্ড। আর্জেন্টিনার একটি পত্রিকাকে এ্যাগুয়েরো বলেছেন, দু’জনের এই আলাদা হয়ে যাওয়াটা হুট করে নয়। কয়েক মাস ধরেই এমন একটা ঝড়ের পূর্বাভাস ছিল। ‘আমাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার পর গত কয়েক মাসে আমি জীবনের নতুন পর্যায়টির সঙ্গে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছি। এটা মোটেও সহজ কিছু ছিল না। কারণ জিয়ান্নিনার সঙ্গে মিলে আবেগময় কিছু সময় কাটিয়েছি। এ সময়টায় আমরা দু’জন বড় হয়েও উঠছিলাম। আমাদের ভালবাসার ফসল হিসেবে এসেছে বেন (বেঞ্জামিন)। এটা ছিল আশীর্বাদ। আমার কাছে সবচেয়ে কঠিন ছিল বেন থাকবে বুয়েনস এয়ার্সে, আর আমি অবশ্যই পেশাগত কারণে ম্যানচেস্টারে’ বিচ্ছেদের কারণ এভাবেই ব্যাখ্যা করেছেন এ্যাগুয়েরো। এ্যাগুয়েরোর বক্তব্যে পরিষ্কার, কয়েক মাস আগেই এক ছাদের নিচে থাকা হচ্ছিল না তাঁদের। বর্তমানে এ্যাগুয়েরো ম্যানচেস্টারে থাকলেও স্ত্রী ও সন্তান থাকছে স্পেনের মাদ্রিদে। এমন খবরই দিয়েছে আন্তর্জাতিক মিডিয়া। প্রচ- দুঃসময় এটা এ্যাগুয়েরোর, তা সহজেই অনুমিত। তবে এ্যাগুয়েরো চাইছেন সাংসারিক ঝামেলা যেন মাঠের খেলায় প্রভাব না পড়ে। সাক্ষাতকারে তাও পরিষ্কার করেছেন তিনি। ‘আমি চেষ্টা করব না পড়ুক। কারণ আপনি সব সময়ই চাইবেন যতটুকু সম্ভব পেশাদারী মনোভাব রাখা যায়। আমি মনে করি না এটা আমার পারফরম্যান্সে প্রভাব ফেলবে। তবে নিজের সন্তানের থেকে দূরে থাকা মোটেও সহজ কিছু নয়। বেনকে ছাড়া থাকা আমার জন্য অসম্ভব।’ থাকাটা আসলেই অসম্ভব। কারণ এ্যাগুয়েরোর ফুটবল ক্যারিয়ারের মূল উত্থান সংসার জীবনের পর থেকেই। স্প্যানিশ ক্লাব এ্যাটলেটিকো মাদ্রিদে নিজেকে চিনিয়েছেন, পরে ইংলিশ ক্লাব ম্যানচেস্টার সিটিতে হয়েছেন পুরোদমে আলোকিত। সাফল্যের এই সোপানে কাছে পেয়েছেন স্ত্রী ও সন্তানকে। তাদের ছাড়া জীবনটা অর্থহীনই মনে করছেন তিনি। এ্যাগুয়েরোর ক্যারিয়ার শুরু স্বদেশী ক্লাব ইন্ডিপেন্ডিয়েন্ত দিয়ে। ২০০৩ থেকে ২০০৬, প্রায় তিন বছর এই ক্লাবে ভীষণ আলোচিত ছিলেন এ্যাগুয়েরো। ৫৪ ম্যাচে ২৩ গোল তারই বহির্প্রকাশ। এই সাফল্যের জের ধরেই ২০০৬ সালে ২৩ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে স্প্যানিশ ক্লাব এ্যাটলেটিকো মাদ্রিদে যোগ দেন তিনি। ট্রান্সফার ফি ছিল ওই ক্লাবের রেকর্ড। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৮। বার্সিলোনা-রিয়াল মাদ্রিদের দাপট দেখানো লা লীগায় শুরুটা বিতর্কিতই ছিল এ্যাগুয়েরোর। রিক্রিয়েটিভো হুয়েলভার বিরুদ্ধে হাত দিয়ে গোল করেছিলেন তিনি। তবে ধীরে ধীরে নিজ নৈপুণ্যে সব সমালোচনাকে পাশ কাটান তিনি। লীগে প্রথম মৌসুমে মাত্র ৬ গোল করা এ্যাগুয়েরো পরের চার মৌসুমে গোল করেছেন সন্তোষজনক। উরুগুয়েন তারকা স্ট্রাইকার দিয়েগো ফোরলানের সঙ্গে জুটি বেঁধে শেষের দিকে বেশ সুনাম অর্জন করেছিলেন তিনি। শেষ মৌসুমে লীগে তার গোল ছিল ৩২ ম্যাচে ২০টি। ২০১০-১১ মৌসুম শেষেই নিজের ওয়েবসাইটে এ্যাগুয়েরো ঘোষণা দেন, ক্লাব বদল করতে চান তিনি। তুখোড় ফর্মে থাকা এই তারকা ফুটবলারকে পেতে বেশি আগ্রহ প্রকাশ করে ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার সিটি। কার্লোস তেভেজের ক্লাব ছাড়ার ঘোষণার পর এ্যাগুয়েরোকে পেতে আরও বেশি মরিয়া হয়ে ওঠে ম্যানসিটি কর্তৃপক্ষ। প্রায় ৩৫ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে ইংলিশ লীগে নাম লেখান আর্জেন্টাইন এই তারকা স্ট্রাইকার। আর শুরু থেকেই চমক দিতে থাকেন। গত মৌসুমে দীর্ঘ ৪৪ বছর পর লীগ শিরোপা জেতে ম্যানসিটি। যাতে প্রত্যক্ষ অবদান এই এ্যাগুয়েরোর। লীগের শেষ শিরোপা নির্ধারক ম্যাচে জয়সূচক গোল করে পুরো সিটি শিবিরকে আনন্দে ভাসান তিনি। শিরোপা নিয়ে ছেলের সঙ্গে সেই সময়ের ছবি হৃদয়কে নাড়া দেয় এ্যাগুয়েরোর। তিনি কি ফিরে পাবেন নিজের ছেলেকে? কিংবা ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে জিয়ান্নিনাই কি ফিরে আসবেন? তা হয়ত বলা কঠিন। আর্জেন্টাইন ফুটবল কিবদন্তি, বেঞ্জামিনের নানা দিয়াগো ম্যারাডোনা এই প্রসঙ্গে এখনও মন্তব্য বা একটি কথাও বলেননি। হয়ত সময় নিচ্ছেন তিনি, সংসারটি জোড়া লাগানোর জন্য। দুটি পথ এক করে দেয়ার জন্য হয়ত ভিন্ন কোন কৌশল খ্ুঁজছেন এই ফুটবল গ্রেট। কারণ আপাতদৃষ্টে এখনও প্রতীয়মান, এ্যাগুয়েরো-জিয়ান্নিনা একে অপরের প্রতি এখনও দুর্বল। মাঝে বেঞ্জামিনের ভালবাসা। হয়ত নতুন করে সংসারটা আবারও সাজাতে পারেন তাঁরা।

No comments

Powered by Blogger.