কিংবদনত্মি জ্যোতি বসুর সঙ্গে একটি সাতকার by হারম্নন হাবীব

বাংলাদেশের বারদী গ্রামের মানুষ হলেও, পশ্চিমবঙ্গের ২৩ বছরের মুখ্যমন্ত্রী হলেও, ভারতের প্রধানতম ত্যাগী রাজনীতিপুরম্নষ হওয়া সত্ত্বেও জ্যোতি বসু ছিলেন সব সমাজের মেহনতী, সংগ্রামী মানুষের, বামপন্থী রাজনীতি ও আদর্শের মহত্তম প্রতিনিধি। এই মহত্তম রাজনীতিবিদের তিরোধান শুধু ভারত নয়, গোটা অবিভক্ত উপমহাদেশের মানুষকে শোকে আপস্নুত করেছে।
দীর্ঘ প্রায় ৯৬ বছরের বর্ণাঢ্য জীবন মহাপ্রাণ জ্যোতি বসুর। ছাত্রজীবন থেকে শুরম্ন করে ২০০০ সাল পর্যনত্ম বিসত্মৃত ছিল রাজনীতির সুবিশাল কর্মময় জীবন তাঁর । আমার সঙ্গে ২০০০ সালের নভেম্বরেই তাঁর কলকাতার বাড়িতে প্রথম ও শেষবারের মতো দেখা। সম্ভবত নবেম্বরের ৬ তারিখ। সেদিনই জ্যোতি বসু তাঁর ২৩ বছরের মুখ্যমন্ত্রীত্ব ছেড়ে দেবেন। রাজ্যের নতুন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেবেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য । আমি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) এর প্রধান সম্পাদক তখন। খবরটা জেনেই স্থির করে ফেললাম, এ দিনটিতেই একটি সাাতকার নেবো তাঁর। ভাবা ও কাজ একসঙ্গে। দ্রম্নত পেঁৗছে গেলাম কলকাতায়। এরপর তাঁর বাড়িতে।
লুঙ্গি পড়ে বসেছিলেন জ্যোতি বসু একটি কাঠের চেয়ারে। বাড়িটির নাম খুব সম্ভবত ইন্দিরা ভবন। খুব বেশি লোকজন চোখে পড়ল না। দুয়েকজন ব্যক্তিগত কর্মকর্তা। ওঁরাই বসার ব্যবস্থা করলেন। শুধু জ্যোতি বাবুর জীবনে নয়, পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে আলোচিত দিন সেদিন। কারণ স্বেচ্ছা-অবসরে যাচ্ছেন জ্যোতি বসু।
১৯১৪ সালে কলকাতার হ্যারিসন রোডের একটি বাড়িতে (এখনকার নাম মহাত্মাগান্ধী রোড) জন্ম নিয়ে যে শিশুটি টানা ২৩ বছর এবং প্রবল জনপ্রিয়তা নিয়ে তাঁর কমিউনিস্ট পার্টিকে মতায় রেখেছেন, সেই জ্যোতি বসু স্বেচ্ছায় আজ ছেড়ে দিচ্ছেন মতা। এমনকি সারা পৃথিবীতে যেখানে কমিউনিস্টরা পরাসত্ম, কমিউনিজমবিরোধী বিশ্ব যখন দ্রম্নত দখল করে নিচ্ছে প্রতিটি জনপদ, সেখানে সম্পূর্ণ চিরাচরিত গণতান্ত্রিক নির্বাচনে জিতিয়ে লাল ঝা-াকে উঁচিয়ে ধরেছেন জ্যোতি বসু। একে যদি শুধুই রাজনীতির কৃতিত্ব বলি, কমই বলা হয়। কাজেই সারা ভারত এবং পাশর্্ববতী দেশগুলোতে জ্যোতি বাবুর এ বিদায়কে স্মরণীয় করে রাখার একটা প্রবল প্রস্তুতি চোখে পড়ছিল আমার।
এ লেখাটিতে জ্যোতি বাবুর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের বিসত্মারিত কিছু আলোচনা করতে যাবো না। শুধু সেদিনের ছোট্ট স্মৃতিময় সাাতকারটির প্রোপট ও বিষয়বস্তু নিয়ে একটি মামুলি আলোকপাত করব। আমার একটিই ইচ্ছে, ছোট্ট এই লেখাটির মাধ্যমে সদ্য-প্রয়াত সেই মহাপ্রাণ ব্যক্তির প্রতি আমার ব্যক্তিগত শ্রদ্ধা জানানো।
১৯৩৫ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজী সাহিত্যে স্নাতক ডিগ্রি ও পরে লন্ডন থেকে ব্যারিস্টারি পাস করে দেশে ফিরে যে জ্যোতি বাবু অন্যকিছু হতে পারতেন, সেই জ্যোতি বাবু বামধারার রাজনীতিতে নিজের আসন পাকাপোক্ত করে নিয়েছেন ক্রমান্বয়ে। লন্ডন থেকে ১৯৪০ সালে দেশে ফিরেই তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় কমর্ী হিসেবে কাজ শুরম্ন করেন। যুক্ত হন রেল শ্রমিক ইউনিয়নের সঙ্গে। গোপনে রেল শ্রমিকদের সঙ্গে রাজনৈতিক যোগাযোগ স্থাপন করেন। অবিভক্ত বাংলার সর্বত্র ঘুরে বেড়ান তিনি। এ ছাড়া পার্টির আরও কিছু গুরম্নত্বপূর্ণ দায়িত্ব অর্পিত হয় তাঁর ওপর। এরই মধ্যে ১৯৪০ সালে বিয়ে করেন। বিয়ের কিছুদিন পরেই স্ত্রী মারা যান। ১৯৪১ সালে মারা যান জ্যোতি বসুর মা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন। সাম্রাজ্যবাদের বিরম্নদ্ধে সংগ্রাম রূপ নেয় ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগ্রামে। গঠিত হয় ফ্যাসিবাদবিরোধী লেখক-শিল্পী সংঘ। সে সংঘের প্রথম সম্পাদক হলেন জ্যোতি বসু।
এরপর তাঁর জীবনের আরেক যাত্রা শুরম্ন। ১৯৪৬ সালে প্রথম রাজ্য বিধানসভায় নির্বাচিত হন। এ সময় শ্রমিক আন্দোলন, ছাত্র সমস্যা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রা, পুলিশি নির্যাতনের বিরম্নদ্ধে সোচ্চার হতে দেখা যায় তাঁকে। দ্রম্নত তিনি উঠে আসেন পার্টির মূলধারায়। ১৯৪৮ সালের বেআইনি ঘোষিত হয় কমিউনিস্ট পার্টি। গ্রেফতার ও কারাবরণ করেন তিনি। ১৯৫২-৫৭ সালে সিপিআই(এম)-এর পশ্চিমবঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬২ সালে চীনপন্থী হিসেবে গ্রেফতার করা হয় জ্যোতি বসুকে। ১৯৬৩ সালে জেল থেকে মুক্ত হন। ১৯৬৪ সালে পার্টির পলিটবু্যরোর সদস্য হন। এরপর আমৃতু্য পলিটবু্যরোর সদস্য থাকেন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির।
কংগ্রেস তখন সর্বভারতীয় রাজনীতিতে আসন পোক্ত করে বসেছে। কংগ্রেসকে হটানো সহজ কথা নয়। কিনত্মু জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে বামফ্রন্ট সে আসনে চিড় ধরিয়ে দিলো পশ্চিমবঙ্গে। বিপুল ভোটে জিতলেন জ্যোতি বসু এবং তাঁর দল। ১৯৭৭ সালেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে প্রথম শপথ নিলেন তিনি। এরপর থেকে ২০০০ সাল পর্যনত্ম দীর্ঘ ২৩ বছর থাকলেন মুখ্যমন্ত্রী। একজন রাজনীতিবিদের জন্য এ গৌরব অনন্য।
ধীরস্থির জ্যোতি বসুর সাথে আমার সাাতকারের ব্যাপারটি আগেই ঠিক করে রেখেছিল বাংলাদেশের কলকাতা ডেপুটি হাই কমিশন। কাজেই তেমন অসুবিধে হলো না। সব মহলেই তখন একটাই প্রশ্ন বুদ্ধদেব বাবু কি জ্যোতি বাবুর শূন্যতা পূরণ করতে পারবেন?
যথেষ্ট বৃদ্ধ তিনি তখনও। অনেকটাই ভাবলেশহীন। গায়ে একটিন চাদর চড়িয়ে বসেছিলেন কাঠের একটি সাধারণ চেয়ারে। ভাবছিলাম, কি কথা দিয়ে শুরম্ন করবো। ওঁর শরীরের যে অবস্থার কথা কিছুদিন ধরে শুনে আসছি তাতে মনেও হচ্ছে না বেশিণ কথা বলতে পারবেন। কাজেই স্থির করে ফেললাম, যে প্রশ্নটি সাধারণের মুখে বারবার উচ্চারিত হচ্ছে, সেটি দিয়েই শুরম্ন করি।
প্রশ্নটি করতেই তিনি স্পষ্ট জবাব দিলেন, এসব কথার কোন মানে নেই। অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য পারবেন না কেন? না পারার কি আছে? কারও কোন স্থানই পূরণ না হয়ে পড়ে থাকে না। তা ছাড়া ওকে তো আগে থেকেই তৈরি করা হয়েছে। দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
এরই মধ্যে বন্ধুবর আবেদ খান একুশে টেলিভিশনের ক্যামেরাম্যানসহ গিয়ে উপস্থিত হলো। তারও ইচ্ছে বিশেষ দিনটাতে একটি সাাতকার ধারণ করবেন। আমাদের আলাপচারিতা আলাদাভাবে হলেও সাাতকরের চরিত্র খুব যে আলাদা হয়েছে তামার মনে হয়নি। কিছু কিছু আলাদা হলেও আমাদের দুজনেরই প্রশ্ন ছিল প্রায় অভিন্ন ।
বাংলাদেশে তখন শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামল। বাংলাদেশ সম্পর্কে কথা তুলতেই তিনি নিজের থেকেই অনেককিছু বলে গেলেন। বললেন, শেখ হাসিনাকে তিনি পছন্দ করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় জনগণ ও সেনাবাহিনী যে অবদান রেখেছে তা শেখ হাসিনা প্রকাশ্যে উচ্চারণ করেছেন বলে তিনি ধন্যবাদ জানালেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় কংগ্রেস মতায় ছিল। কিনত্মু জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টি এবং বামধারার প্রতিটি দলগোষ্ঠী আমাদের সংগ্রামে প্রত্য ভূমিকা রাখে। তারা তহবিল গঠন করে, রিফু্যজিদের দেখাশোনা করে এবং প্রতিটি পদেেপ মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন জানায়।
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে কথা তুলতেই তিনি দুই দেশের ঐতিহ্যবাহী সম্পর্ককে আশাবাদ ব্যক্ত করলেন। বললেন, অনেককিছুই করা দরকার। কিছুদিন আগে যে বাস সার্ভিস উদ্বোধন হয়ে গেলো, তাতেই কেবল সনত্মুষ্ট থাকলে চলবে না। দুই দেশের মানুষের মধ্যে যোগাযোগ আরও বাড়াতে হবে। রেল, নৌপথ ও আকাশ পথে যোগাযোগ আরও বাড়াতে হবে। ব্যবসা বাণিজ্য ও সংস্কৃতি বিনিময় এমন পর্যায়ে নিতে হবেযাতে সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়।
আমি যখন এসব বিষয়ে তার মতামত জানতে চাইছিলাম তখন বেশ কয়েকবারই তিনি আমাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলেন, দেখুন, আমি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নই, আমি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল রাখতে চাই। দিলস্নীতে যারাই মতায় থাক (তখন বিজেপি মতায়) তাদেরও বাংলাদেশের স্বার্থের দিকে তাকাতে হবে। বাণিজ্য বৈষম্যের ব্যাপার নিয়ে যে কথাবার্তা হচ্ছে, তাও বাসত্মবভিত্তিক পর্যালোচনা করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, দুই দেশের সন্দেহ-অবিশ্বাস দূর করতে হবে। ইতিহাসের পাপ থেকে দু দেশকেই বেরিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশেও সসত্মা ভারতবিরোধিতা চালানো ঠিক নয়। আমি জানি কেউ কেউ এখন পাকিসত্মানের ভাষাতেই কথা বলছেন। দুই দেশের স্বার্থেই এসব প্রচারণা বন্ধ হওয়া ভাল।
সাাতকারটি দীর্ঘ সময় ধরে হয়নি। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা থেকে তা প্রচারিতও হয়েছিল।
এরপর অবশ্য আমি দ্রম্নত ছুটে গিয়েছিলাম রাইটার্স বিল্ডিংয়ে নতুন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সাাতকার নিতে।
আজ জ্যোতি বসু নেই। কেউই থাকেন না অননত্মকাল। এই মহাপ্রাণ মানুষটিকে আমার অনত্মর নিংড়ানো শ্রদ্ধা জানাই।
হারম্নন হাবীব : মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও সাংবাদিক
ব-সধরষ : যয১৯৭১@মসধরষ.পড়স

No comments

Powered by Blogger.