জ্বালানি- মধ্যম আয়ের দেশের স্বপ্ন বনাম জ্বালানিসংকট by মুশফিকুর রহমান

সরকারের চার বছরে উল্লেখযোগ্য অর্জনগুলোর মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সাফল্যের কথা জোরেশোরে বলা হয়। এ সরকার ২০০৯ সালে যখন দায়িত্ব নেয়, তখনকার বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণ ব্যবস্থার তুলনায় গত চার বছরে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে প্রায় সাত হাজার মেগাওয়াটে উত্তীর্ণ হয়েছে।
এই সাফল্য এসেছে প্রধানত ভাড়াভিত্তিক ও দ্রুত ভাড়াভিত্তিক তেলচালিত ছোট ছোট বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে। দ্রুততম সময়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর জন্য এর কোনো কার্যকর বিকল্প ছিল না। তবে তেলচালিত, ব্যয়বহুল ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন কৌশল যে সাময়িক এবং জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য করা হয়েছে, সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তা বলছে।
মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে বিদ্যুৎ উৎপাদনে নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা গড়তে আমাদের প্রধান সমস্যা প্রাথমিক জ্বালানির বহুমুখিনতার অভাব। সুলভে বিকল্প বাণিজ্যিক জ্বালানির সংস্থান করার উদ্যোগ এ সময়ে সামান্যই এগিয়েছে। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে এই সাফল্য সাময়িক স্বস্তির বিষয় মাত্র। আবার, বিদ্যুৎ না থাকার চেয়ে ব্যয়বহুল হলেও বিদ্যুৎ সরবরাহ থাকা ভালো। কারণ, বিশেষজ্ঞদের হিসাবে, এক কিলোওয়াট/ঘণ্টা বিদ্যুতের অনুপস্থিতি অর্থনীতিতে ২৫-৩০ টাকার ক্ষতির কারণ হয়। কিন্তু এভাবে আমদানি করা তেলে ভর্তুকি দিয়ে বাধাহীনভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। সে কারণে বিদ্যুতের দাম বারবার বাড়ানো হচ্ছে। শিল্প খাতে ইউনিটপ্রতি ১৬ টাকায় বিরতিহীনভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে গত বছরের জুন মাসে, কিন্তু এত বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনতে কোনো ক্রেতা আগ্রহ দেখাননি। অর্থাৎ, বিরতিহীন বিদ্যুৎ গ্রাহকের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে গেলে চলবে না।
বিদ্যুতের জন্য প্রাথমিক জ্বালানি গ্যাসের উৎপাদন গত চার বছরে দৈনিক এক হাজার ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট থেকে বেড়ে দৈনিক প্রায় দুই হাজার ৫০ মিলিয়ন ঘনফুটে উঠেছে। আবার গ্যাসের চাহিদাও বেড়েছে সরবরাহের থেকে বেশি। গ্যাসের নতুন সংযোগ দেওয়া বন্ধ রাখা সত্ত্বেও এখন গ্যাসের সরবরাহ ঘাটতি দৈনিক প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট। এ ঘাটতি ক্রমাগত বেড়েই চলেছে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চেষ্টা চলছে। গত চার বছরে এ ক্ষেত্রে প্রস্তুতিমূলক কাজ অনেকটুকু এগিয়েছে। এ মাসের মাঝামাঝি প্রধানমন্ত্রী মস্কো সফরে যাচ্ছেন। তখন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রাক-নির্মাণ ডিজাইন ও জরিপের জন্য ৫০০ মিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তি ও মূল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যয়ের ৯০ শতাংশ কী শর্তে ঋণ পাওয়া যাবে, তা নিয়ে রুশ সরকারের সঙ্গে সমঝোতা হওয়ার কথা। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ব্যয়বহুল এবং বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে অনেক বিশেষজ্ঞ এর বিরুদ্ধে। তবু, অর্থ পেলে এবং বিরোধিতা দূর হলেও ২০১৫ সালের আগে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ শুরু সম্ভব নয়, আর ২০২২ সালের আগে এখান থেকে বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে না।
সরকার ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করার রূপকল্প ঘোষণা করেছে। এটা সম্ভব। কিন্তু সে জন্য উন্নয়নের বর্তমান গতি বাড়াতে হবে। জ্বালানির নির্ভরযোগ্য, টেকসই সরবরাহ ছাড়া সেটা সম্ভব নয়। বর্তমানের মাথাপ্রতি বছরে মাত্র ২৬৫ কিলোওয়াট/ঘণ্টা পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার দৃশ্যমান বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হবে।
প্রকাশিত সমীক্ষা রিপোর্ট অনুযায়ী, ৮ শতাংশ হারে জিডিপির প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে আমাদের প্রায় ৩৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বণ্টন নিশ্চিত করতে হবে (বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের স্থাপিত ক্ষমতা প্রায় আট হাজার ৪০০ মেগাওয়াট এবং প্রকৃত উৎপাদনক্ষমতা প্রায় সাত হাজার মেগাওয়াট)। আগামী চার-পাঁচ বছর অব্যাহতভাবে বছরে প্রায় এক হাজার মেগাওয়াট বাড়তি বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা বাড়ানো আমাদের অর্থনীতির জন্য অপরিহার্য হিসেবে বিবেচনা করা হলেও গৃহীত পদক্ষেপগুলো বছরে ৩০০-৫০০ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা সংযোজন করবে না বলেই ইঙ্গিত করছে এবং এ ক্ষেত্রে প্রধান বাধা, প্রাথমিক জ্বালানি সরবরাহের সীমাবদ্ধতা।
বিশেষজ্ঞরা সমবেতভাবেই বলছেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রধান নির্ভরতা হওয়া উচিত কয়লার ওপর। অন্যান্য জ্বালানির ব্যাপক উন্নয়ন সম্ভাবনা উন্মোচিত হলেও বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এখনো কয়লার ওপরে বিশ্বের নির্ভরতা ৪০ শতাংশ। ওয়ার্ল্ড রিসোর্স ইনস্টিটিউটের প্রকাশিত সাম্প্রতিক প্রতিবেদন বলছে, ৫৯টি দেশে আগামী কয়েক বছরে প্রায় এক হাজার ২০০ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হবে, যার সম্মিলিত উৎপাদনক্ষমতা হবে এক হাজার ৪০০ গিগাওয়াট (১ গিগাওয়াট = ১,০০০ মেগাওয়াট )। এর মধ্যে ৪৫৫টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হবে ভারতে এবং ৩৬৩টি চীনে। বাংলাদেশে সরকারের ‘পাওয়ার সিস্টেম মাস্টারপ্ল্যান ২০১০’ (২০১১ সালে প্রকাশিত) অনুযায়ী, ২০৩০ সালে দেশে উৎপাদিত বিদ্যুতের ৫০ শতাংশ জ্বালানির জোগান দিতে হবে কয়লা থেকে (বর্তমানে প্রায় ৩ শতাংশ)। সে সময়ে কয়লা দিয়ে প্রায় ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। একইভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে, প্রায় ১১ হাজার মেগাওয়াট পরিমাণ বিদ্যুৎ স্থানীয় কয়লা দিয়ে উৎপাদন করতে হবে। এ পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনে ২০৩০ সাল নাগাদ দরকার হবে বছরে প্রায় ৩৩ মিলিয়ন টন পরিমাণ স্থানীয় কয়লার উৎপাদন নিশ্চিত করা। নিশ্চিতভাবে বলা যায়, দেশের পাঁচটি আবিষ্কৃত কয়লাক্ষেত্রের সবগুলোতে একযোগে বড়পুকুরিয়ার মতো ক্ষুদ্র, ঝুঁকিপূর্ণ ও ব্যয়বহুল ভূগর্ভস্থ পদ্ধতির খনি নির্মাণ করলেও লক্ষ্যমাত্রার সামান্য পরিমাণ কয়লাই উৎপাদন সম্ভব হবে।
অপর দিকে, কয়লাখনি উন্নয়নের জন্য বিনিয়োগ, কারিগরি জরিপ, ডিজাইন তৈরিসহ প্রস্তুতির পর্ব সময়সাপেক্ষ। সরকার বড়পুকুরিয়ার উত্তরাংশে (ভূতাত্ত্বিক ও কারিগরি বাস্তবতায় কেবল উন্মুক্ত পদ্ধতির খনি প্রযুক্তি প্রয়োগযোগ্য) একটি কয়লাখনি নির্মাণে আগ্রহী। সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা বলছেন, উন্মুক্ত খনি উন্নয়ন করলে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর তার কী প্রভাব পড়ে, তা না বুঝে সরকার খনি উন্নয়নের সিদ্ধান্ত নেবে না। এবং এ লক্ষ্যে সমীক্ষা শুরু করতে অতিসম্প্রতি আইডব্লিউএম নামের সরকারি সংস্থাকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। ২০১৪ সালের আগে সে সমীক্ষা শেষ হচ্ছে না। স্পষ্টত, সরকার বর্তমান মেয়াদে কয়লা উন্নয়ন প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেতে চায়। আমদানি করা কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগও এখন অবধি সামান্যই এগিয়েছে। তাহলে ২০২১ সালে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার প্রয়োজনীয় জ্বালানির জোগান অনিশ্চিত রেখেই কি আমরা সে পথে এগোচ্ছি?
ড. মুশফিকুর রহমান: খনি প্রকৌশলী, জ্বালানি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক।

No comments

Powered by Blogger.