ভারতের নতুন সেনসেশন কোহলি by মাহমুদুন্নবী চঞ্চল

শৈশবেও তাঁর ব্যাটে রানের ফোয়ারা ছুটত। বাড়ির সামনের রাসত্মায় উচ্ছল বন্ধুদের সাথে ক্রিকেট খেলতে কতজনের জানালার গস্নাস যে ভেঙ্গেছেন তার ইয়ত্তা নেই। এজন্য হরহামেশাই প্রতিবেশীদের অভিযোগ আসত তাঁর মায়ের কাছে।
ফলে কম বকুনি জোটেনি কপালে। কখনও কড়া আবার কখনও স্নেহের পরশে শাসন করার চেষ্টা করতেন মা। 'যতই শাসন কর, ব্যাট-বল ছাড়ব না'_ এমনই পণ ছিল তাঁর। তবে ছেলের মধ্যে প্রতিভার ছোঁয়া খুঁজে পেতেন বাবা। ভাবতেন, ছেলে বড় হলে নামকরা ক্রিকেটার হবে। সবাই তাকে একনামে চিনবে। তাই হলো। কিন্তু দুর্ভাগ্য, ছেলের ক্রমাগত উত্থান, জনপ্রিয়তা নিজ চোখে দেখে যেতে পারলেন না বাবা। চলে গেলেন পরপারে। দেখে যেতে পারেননি, তাঁর ছেলে এখন ভারতের জাতীয় ক্রিকেট দলের নয়া সেনসেশন। তবে দেখে গেছেন অনুর্ধ-১৫, ১৭ ও ১৯ ক্রিকেটে তাঁর ছেলে কিভাবে বোলারদের পিটিয়ে লম্বা রানের ইনিংস খেলত। এখন বাবার সেই লালিত স্বপ্ন ধীরে ধীরে পূরণ করতে যাচ্ছে সেই কিশোর। ঠা-া মাথায় এ্যাটাকিং ক্রিকেট খেলে সমপ্রতি যিনি সবার নজরে এসেছেন তিনি ভারতের উদীয়মান ক্রিকেটার বিরাট কোহলি। শচীন-যুবরাজদের ইনজুরির ফাঁকে দলে প্রবেশ করে তিনি প্রমাণ করেছেন নিজের দতা। আসন পাকাপোক্ত করছেন জাতীয় দলে। শুধু তাই নয়, সমপ্রতি বাংলাদেশে শেষ হওয়া ত্রিদেশীয় ওয়ানডে সিরিজে আগুন ঝলসানো ব্যাটিংয়ে ওয়ানডে র্যাঙ্কিংয়ে রকেট গতিতে ২৬ ধাপ এগিয়ে দখল করেছেন ২১ নম্বর আসনটি। মাত্র ২২ বছরে এত দ্রম্নত র্যাঙ্কিংয়ের উন্নতিতে সবাই তাঁর মধ্যে দেখতে পাচ্ছেন শচীনের ছায়া। ভাবতে শুরম্ন করেছেন তিনিই হতে পারেন শচীনের যোগ্য উত্তরসূরি। মাত্র দেড় বছরের আনত্মর্জাতিক ক্যারিয়ারে ২০ ওয়ানডে ম্যাচে তাঁর মোট রান ৭৫৯। ২টি সেঞ্চুরি আর ৫টি ফিফটির সমন্বয়ে রান গড় ৫৪.২১। তবে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে তাঁর উদ্ভাসিত ব্যাটিংয়ের নমুনা দেখতে পাওয়া যায়। মাত্র ২৪ ম্যাচে তাঁর মোট রান ১৬১৭। এর মধ্যে রয়েছে ৫টি সেঞ্চুরি এবং ৬টি ফিফটি। গড় ৫৫.৭৫। তবে বাংলাদেশে সদ্যসমাপ্ত 'আইডিয়া কাপ'-এ আলোকিত নৈপুণ্যই তাঁকে নিয়ে এসেছে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।
দিলিস্নতে জন্ম নেয়া বিরাট কোহলির ক্রিকেট যাত্রা কিশোর বয়স থেকেই। মাত্র ১০ বছর বয়সেই তালিম নিতে শুরম্ন করেন দিলিস্ন ক্রিকেট একাডেমীতে। ধীরস্থির গোছের কোহলি লম্বা রানের ইনিংস খেলতে বেশ পটু থাকায় এই একাডেমীর অনুর্ধ-১৫ দলের অধিনায়ক হিসাবে নির্বাচিত হন। রানের ধারাবাহিকতায় অনুর্ধ-১৭ দলের অধিনায়কও হন। এবার হিমাচল প্রদেশের বিপৰে মাত্র ৭ ম্যাচে ১টি ডবল সেঞ্চুরিসহ ৮০০ রান করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন টিনএজ কোহলি। বারম্নদের মতো ক্রমাগত বিস্ফোরিত হচ্ছিল তাঁর ব্যাটিং প্রতিভা। সুফল পেয়েও যান হাতেনাতে।
২০০৬ সাল। ডাক পান অনুর্ধ-১৯ দলে। এই বছর ইংল্যান্ড সফরে সবের্াচ্চ স্কোর করে সিরিজ জিততে সহায়তা করেন নিজ দেশকে। ক্রমশ তাঁর ব্যাটিং খ্যাতি দেশের গ-ি ছাড়িয়ে বিসত্মৃত হলো আরও অনেক দূরে। ২০০৮ সাল। অনেক কিছু পাবার বছর কোহলির। অনুর্ধ-১৯ দলের অধিনায়কত্বের মুকুট ওঠে তাঁর মাথায়। সাফল্যের সাথে মালয়েশিয়াতে অনুষ্ঠিত অনুর্ধ-১৯ বিশ্বকাপের ট্রফি ভারতকে এনে দেন। ব্যাট হাতে এখানেও রীতিমতো ঝলমলে তিনি। টুর্নামেন্টের ৪র্থ সর্বোচ্চ রান তাঁর। ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটে সবচেয়ে জনপ্রিয় লীগ 'রঞ্জি ট্রফি'তে অংশ নিয়ে নিজেকে আরও পরিণত করেন। ফলে জাতীয় দলে ঢোকার আগেই তাঁর সুযোগ ঘটে জনপ্রিয় টুর্নামেন্ট 'আইপিএল'-এ খেলার। রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্সের হয়ে আইপিএলের প্রথম আসরে তেমন আলো ছড়াতে পারেননি। ১৩ ম্যাচে করেন ১৬৫ রান । কিন্তু অধ্যবসায় থেমে থাকেনি তাঁর। অস্ট্রেলিয়ায় ইমার্জিং পেস্নয়ার্স টুর্নামেন্টে দুর্দানত্ম সেঞ্চুরি করার পরই জাতীয় দলের দরজা উন্মুক্ত হয় তাঁর জন্য। অবশ্য এেেত্র সিনিয়র ক্রিকেটারদের ইনজুরি বেশ সাহায্য করে কোহলিকে। ২০০৮ সালের আগস্টে শ্রীলঙ্কার বিপ েওয়ানডেতে অভিষেক হয় তাঁর। লিটল মাস্টার শচীন তেন্ডুলকর ও সেবাগের ইনজুরিজনিত অনুপস্থিতিতে জাতীয় দলে নিজের দতা প্রমাণের সুযোগ আসে তাঁর। শ্রীলঙ্কা সফরের প্রথম ম্যাচে ১২ রানে আউট হলেও ২য় ম্যাচেই রাখেন গুরম্নত্বপূর্ণ ভূমিকা। লো স্কোরিংয়ের সেই ম্যাচে তাঁর করা ৩৭ রানের ওপর ভর করেই সিরিজে সমতা আনে ভারত। ৪র্থ ম্যাচে ওয়ানডে ক্যারিয়ারের প্রথম অর্ধ শত (৫৪) করে দলের সিরিজ জয়ের কাজকে অনেক সহজ করে দেন। এই সিরিজ জয় ছিল ভারতের কাছে অনেক আকাঙ্ৰিত। কারণ লঙ্কানদের মাটিতে এবারই প্রথমবারের মতো একদিবসীয় সিরিজ জেতে ধোনির 'টিম ইন্ডিয়া।' এমন সাফল্যের ধারাবাহিকতায় হোম সিরিজে ইংল্যান্ডের বিপ েওয়ানডে স্কোয়াডে অনত্মর্ভুক্ত হন কোহলি। কিন্তু শচীন-সেবাগ ইনজুরি কাটিয়ে স্কোয়াডে ফিরলে কপাল পোড়ে তাঁর । ২০০৯ সাল। প্রথমদিকে শ্রীলঙ্কা সফরেও কোহলি থাকেন উপেৰিত। তবে 'আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি'তে ভারত স্কোয়াডে থাকেন তিনি। এবারও যুবরাজের ইনজুরির বদৌলতে দলে জায়গা পান। অন্যের ইনজুরির সুযোগ নিয়ে দলে প্রবেশ নিয়ে বেশ অস্বসত্মিতে ছিলেন তিনি। তবে আত্মবিশ্বাস ছিল_ দলে নিয়মিত হবেনই। আস্থা অর্জন করবেন নির্বাচকম-লীর। ২০০৯ সালের শেষদিকে ৪ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ খেলতে ভারত সফরে আসে শ্রীলঙ্কা। এবারও যুবরাজের অনুপস্থিতিতে কোহলির দলে ঢোকা। ব্যাট থেকে রীতিমতো আলো ছড়ালেন। এই সিরিজেই দেখা পেলেন ওয়ানডে ক্যারিয়ারের প্রথম ম্যাজিকাল থ্রি ফিগার_ সেঞ্চুরি, যে সেঞ্চুরি সিরিজ জেতায় ভারতকে। র্যাঙ্কিংয়ে টেস্টসেরা ব্যাটসম্যান গৌতম গাম্ভীরের সাথে নয়ন জুড়ানো ২২৪ রানের পার্টনারশিপ তাঁকে নতুন করে চেনায় জাতীয় দলে। প্রমাণ করলেন তিনি ম্যাচ উইনিং ব্যাটসম্যান। বাংলাদেশে শেষ হওয়া ত্রিদেশীয় ওয়ানডে সিরিজটি কোহলির জন্য ছিল টার্নিং পয়েন্ট। শচীনের অনুপস্থিতিতে ব্যাট হাতে চমক দেখিয়েছেন তিনি। ফাইনালে ভারত লঙ্কার কাছে হারলেও গোটা সিরিজে কোহলি ছিলেন স্বীয় নৈপুণ্যে সমুজ্জ্বল। আর এমন দাপুটে উইলোবাজিতেই ২৬ ধাপ প্রমোশন কোহলির, যা চমকে ওঠার মতোই ব্যাপার। টুর্নামেন্টে তাঁর রান ২৭৫। গড় ৫৫। এর মধ্যে রয়েছে ১টি হার না মানা শতক ও ২টি ফিফটি। প্রথম ম্যাচে লঙ্কার বিপৰে ঠিক সুবিধা করতে পারেননি; সাজঘরে ফেরেন মাত্র ৯ রানেই। দলও হেরে যায়। কিন্তু ২য় ম্যাচেই বাংলাদেশের বিপৰে স্বরূপে ফেরেন এই ডানহাতি। মাত্র ৯ রানের জন্য দেখা পাননি সেঞ্চুরির। তাঁর করা ৯১ রানের ওপর ভর করে ম্যাচ জেতে ভারত। পরের ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপৰে থাকেন ৭১ রানে অপরাজিত। দলও জেতে সাবলীলভাবে। ৪র্থ ম্যাচে বাংলাদেশের বিপৰে ক্যারিয়ারের ২য় সেঞ্চুরি করে দ্বিতীয় ম্যাচের জ্বালা মেটান। তাঁর ৯৫ বলে ১০২ রানের নটআউট ইনিংসটি ঠা-া মাথায় আক্রমণাত্মক ক্রিকেটেরই বহির্প্রকাশ। কিন্তু ফাইনালে টপঅর্ডার সব ব্যাটসম্যানের মতো তিনিও ব্যর্থ হন। মাত্র ২ রান করেন কোহলি। ভারতও হারে ৪ উইকেটে।
কোহলির সংৰিপ্ত ক্রিকেট ক্যারিয়ার পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তাঁর ব্যাট হাসলেই দলও হাসে। ম্যাচ উইনার হিসেবে তিনি ইতোমধ্যেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আগে সিনিয়র ক্রিকেটারদের ইনজুরির কল্যাণে দলে ঢুকলেও সাম্প্রতিক পারফরমেন্স তাঁর ক্যারিয়ারকে রঙিন করেছে। জাতীয় দলে ঢুকতে এখন আর কারও ইনজুরির দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না তাঁর। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটের মতো এখন আনত্মর্জাতিক পরিম-লেও
তাঁর ব্যাট হাসতে শুরম্ন করছে। ওয়ানডেতে পথচলা কোহলি এখনও প্রবেশ করতে পারেননি ক্রিকেটের মূলধারা টেস্ট ক্রিকেটে। সেদিন আর বেশি দূরে নয়; খুব অচিরেই দেখা যেতে পারে সাদা পোশাকে গোলকবাজদের শাসন করছেন দিলিস্নর এই ক্রিকেটরত্ন। বাবার স্বপ্ন পূরণে সেই লৰ্যেই হাঁটছেন বিরাট কোহলি।

No comments

Powered by Blogger.