শ্যামপুর কারখানায় অগি্নকাণ্ড-এ করুণ মৃত্যুতে কোনো সান্ত্বনা নেই

রাজধানীর শ্যামপুর শিল্প এলাকায় সোনারগাঁও ফেন্সি প্রিন্টিং অ্যান্ড ডায়িং ফ্যাক্টরিতে অগি্নকাণ্ডে আটজন শ্রমিকের করুণ মৃত্যুর ঘটনা সকলকে ব্যথিত ও বেদনার্ত করেছে। নিহতদের দু'জন যমজ ভাই এবং পাঁচজনের বয়স ১৭ থেকে ২০ বছরের মধ্যে।
তাদের পাঁচজন আবার কারখানা মালিকের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। পরিবারে একটু সচ্ছলতা কিংবা এমনকি কেবল বেঁচে থাকার জন্যই এই বয়সে তারা শ্রমিকের কঠিন পেশা বেছে নিয়েছিল। কিন্তু নিয়তি তাদের ঠেলে দিল অনন্তলোকে। বৃহস্পতিবার রাতে ফ্যাক্টরি ভবনের ছাদের টিনশেডে ঘুমিয়ে থাকাই তাদের কাল হলো। ভবনের নিচের তলাগুলোতে চলছিল উৎপাদনের কাজ। রাতে ডিউটি না থাকা কয়েকজন শ্রমিক থাকতেন টিনশেডে। অপর্যাপ্ত বেতন-ভাতার কারণেই এমন পরিবেশে থাকতে তারা বাধ্য হতো, এমনটি হওয়াই স্বাভাবিক। অগি্নকাণ্ডের কারণ হতে পারে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট কিংবা সিগারেটের আগুন। দাহ্য পদার্থ নিয়ে যে কারখানায় কাজ হয়, সেখানে অবশ্যই যাবতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকা চাই। কিন্তু তাতে ব্যত্যয় ঘটেছে এবং এর দায় অবশ্যই বর্তাবে কারখানা কর্তৃপক্ষের ওপর। ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষের ভাষ্য :শ্রমিকদের থাকার স্থানে আগুন নেভানোর কোনো সরঞ্জাম ছিল না। আমাদের দেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, যেখানে নির্মাণবিধি আদৌ অনুসরণ করা হয় না। স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার নিয়মকানুনও মানা হয় কম ক্ষেত্রেই। এজন্য পুঁজির স্বল্পতাসহ মালিকপক্ষ নানা যুক্তি দেখাতে পারে। সরকারের তরফে সহায়তা না পাওয়ার মতো অজুহাতও দেওয়া যায়। কিন্তু তাতে গাফিলতি কিংবা এমনকি ইচ্ছাকৃত ত্রুটির স্খলন হয় না। নিরাপত্তা ব্যবস্থার অপর্যাপ্ততার জন্যই আমরা দেখছি তৈরি পোশাক শিল্পে একের পর এক দুর্ঘটনা। এসব প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দ্রব্যমূল্য চিত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তাদের যাতায়াত ও বসবাসের সুবিধার প্রতি উদ্যোক্তাদের নেই কোনো মনোযোগ। অনেক ক্ষেত্রেই কাজের পরিবেশ অমানবিক। দেশের শ্রমিক সংগঠনগুলোর ক্রমাগত অভিযোগ যে, বেশিরভাগ কারখানাতেই কাজের পরিবেশ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার অনুমোদিত বিধি অনুযায়ী নেই। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প পণ্যের ক্রেতাদের তরফেও বিভিন্ন সময়ে শ্রমবিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে সরকার ও মালিকপক্ষের মনোযোগ আকর্ষণ করা হয়েছে। মূলত তাদের অব্যাহত চাপের কারণেই গার্মেন্ট শিল্প এখন শিশু শ্রমিকমুক্ত। কিন্তু তারপরও সমস্যার বোঝা যথেষ্ট ভারি এবং তার খেসারত মূলত দেয় শ্রমিকরাই। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তৈরি পোশাক এবং অন্যান্য শিল্পের মালিকদের একটি বড় অংশই কাজের পরিবেশ উন্নত করার বিষয়ে মনোযোগী না হয়ে বরং এসব ইস্যু সামনে নিয়ে আসা শ্রমিক সংগঠনগুলোকে বিদেশি স্বার্থান্বেষী মহলের উস্কানি ও মদদপুষ্ট হিসেবে হেয় করায় সচেষ্ট থাকে। শিল্পের স্বার্থেই এমন মনোভাব পরিত্যাজ্য হওয়া বাঞ্ছনীয়। কারখানা মালিকের বাড়তি লাভ করার প্রতি মনোযোগ থাকবেই। কিন্তু একইসঙ্গে শ্রমিকদের সুবিধাও দেখতে হবে। আধুনিক বিশ্বে এ বিষয়টির ওপর নজর রাখছে দেশ-বিদেশের অনেক সংগঠন। শিল্পে সমৃদ্ধ হওয়ার লক্ষ্য আমাদের সামনে রয়েছে। কিন্তু শ্রমিকদের আর্থিক ও নিরাপত্তা সুবিধা উপেক্ষা করে তা অর্জন করা আদৌ সম্ভব নয়।

No comments

Powered by Blogger.