আইডিয়া কাপ সাঙ্গাকারা বাহিনীর by মিথুন আশরাফ

এবারও বাংলাদেশ থেকেই নতুন বছর শুরম্ন হলো শ্রীলঙ্কার। একইভাবে। গত বছরেও বাংলাদেশের মাটি থেকেই শিরোপা জিতে নতুন বছরের যাত্রা শুরম্ন করেছিল তারা। সেবারও বছর সূচনায় তিন জাতি টুর্নামেন্টই ছিল।
এবারও তিন জাতি টুর্নামেন্ট 'আইডিয়া কাপে' চ্যাম্পিয়ন হয়েই নতুন বছরের সূচনা করেছে লঙ্কানরা। গতবার ১৬ জানুয়ারি বাংলাদেশকে ২ উইকেটে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়ে বছরের শুরম্ন করা শ্রীলঙ্কা এবার ৩ দিন আগে ভারতকে ৪ উইকেটে হারিয়ে সেই পথেই এগিয়ে যায়। পার্থক্য, ২০০৯ সালে মাহেলা জয়াবর্ধনের হাত ধরে শিরোপা জিতে বছর শুরম্ন হয়েছিল শ্রীলঙ্কার। এবার কুমারা সাঙ্গাকারার নেতৃত্বে দল চ্যাম্পিয়ন হয়। সেবার তিন জাতি টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, জিম্বাবুইয়ে অংশ নেয়। এবার জিম্বাবুইয়ের জায়গায় শুধু ভারত যোগ হয়। তাতেও হার মানেনি সাঙ্গাকারা বাহিনী। ভারতকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েই বছর শুরম্নর উৎসবে মাতে। পরিবর্তন আরেকটি আছে। সেবার টুর্নামেন্ট সেরা হয়েছিলেন বাংলাদেশের শাকিব আল হাসান। এবার হলেন লঙ্কান অধিনায়ক সাঙ্গাকারা নিজেই।
ম্যাচটি ছিল খুবই গুরম্নত্বপূর্ণ দু'দলের জন্যই। বাংলাদেশের জন্য বছরের শুরম্নতেই হার সহ্য করার লজ্জার গোলকধাঁধা থেকে বের হওয়ার ম্যাচ ছিল। গত বছর ডিসেম্বরে ভারতের কাছে নাসত্মানাবুদ হওয়ার পর ম্যাচ জিতে জয়ের ধারায় ফেরার লৰ্য ছিল শ্রীলঙ্কার। সঙ্গে আবারও নতুন বছর জয় দিয়ে শুরম্ন করার দিকেও নজর ছিল। সেই যাত্রায় আবারও সাফল্য পেয়েছে তারা। শাকিব বাহিনী হারের বৃত্তেই আটকা পড়েছে। শিশির প্রভাব ফেলবে এ সিরিজে_ তা আগেই জানা ছিল। পরে ফিল্ডিং করে ততটা লাভ হবে না তাও সবার জানা ছিল। তাই ম্যাচে টস জিতে ফিল্ডিং নেয়ার সিদ্ধানত্মই নেন সাঙ্গাকারা। আগে ব্যাট করে 'লিটর মাস্টার' মোহাম্মদ আশরাফুলের ৭৫ রানে ৭ উইকেটে ৫০ ওভারে ২৬০ রান করে বাংলাদেশ। এ রান খুব সহজেই তাড়া করে ম্যাচ জেতে শ্রীলঙ্কা। শিশির সমস্যায় বাংলাদেশ বোলাররা কোন সুবিধাই করতে পারেনি। তিলকারত্নে দিলশানের (১০৪) সেঞ্চুরিতে ৩ উইকেটে ৪৪.৫ ওভারে ২৬১ রান করে ম্যাচ জেতে লঙ্কানরা। সেই সঙ্গে নতুন বছরটি আবারও জয় দিয়েই শুরম্ন করে। বাংলাদেশ পুরনো হারের ইতিহাসের বৃত্তেই ধরা পড়ে। গত বছরেও জিম্বাবুইয়ের বিরম্নদ্ধে ৩৮ রানে হার দিয়েই বছর শুরম্ন করে টাইগাররা। আর শ্রীলঙ্কানরা ১৩০ রানে জিম্বাবুইয়েকে হারিয়ে নতুন বছরের শুভসূচনা করেছিল।
প্রথম ম্যাচে জয়ের রেশ দ্বিতীয় ম্যাচে ভারতের বিরম্নদ্ধেও বজায় রাখে শ্রীলঙ্কা। এ ম্যাচেও টস জেতেন সাঙ্গাকারা। সহজেই জেতেন ম্যাচ। গত বছর ভারতের বিরম্নদ্ধে হার দিয়েই বছর শেষ করে লঙ্কানরা। সেই হারের প্রতিশোধ নেয়। ধোনিবাহিনী নতুন বছর হার দিয়ে শুরম্ন করার জ্বালায় পোড়ায়। আগে ব্যাট করায় এবার ভারতও কুপোকাত হয়। শিশির সমস্যা এ ম্যাচেও বজায় থাকে। পেসার ওয়েলেগেদারার (৫/৬৬) বোলিং তা-বে ৫০ ওভারে ৯ উইকেটে ২৭৯ রান করতে সৰম হয় ভারত। যুবরাজের ৭৪ রানে এ স্কোর গড়ে ভারত। কিন্তু তাতে কোন লাভই হয়নি। জহির খান, আশিষ নেহরা, হরভজন সিংরা একেবারেই নীরব থাকেন। থিলান সামারাবিরাকেও আটকাতে পাড়েনি ভারত বোলাররা। তার অপরাজিত ১০৫ রান ও সাঙ্গাকারার ৬০ রানে ৫ উইকেটে ম্যাচ জিতে লঙ্কানরা। দুই ওভার হাতে রেখে ২৮৩ রান করে জয়ের বন্দরে পেঁৗছে যায়।
বাংলাদেশ ও ভারত দু'দলই ১টি করে ম্যাচ হারে। এবার মুখোমুখি দু'দল। এগিয়ে যাওয়ার লড়াই। যে জিতবে টুর্নামেন্টে টিকে থাকার দৌড়ে সে দলটিই এগিয়ে থাকবে। ম্যাচে আশা জাগিয়েছিল বাংলাদেশ। শিশির প্রভাব বিসত্মার করে। পরে ফিল্ডিং করে কোন দলই এ কন্ডিশনে সুবিধা করতে পারে না। তা জেনেও আগে ব্যাট করার সিদ্ধানত্ম নেন শাকিব। ভারতকে যেন জয়ের পূর্বাভাস ম্যাচ শুরম্নর আগেই দিয়ে দেন। এরপরও আশা জাগায় বাংলাদেশ। আগে ব্যাট করে ওপেনার ইমরম্নল কায়েসের ৭০, মাহমুদুলস্নাহ রিয়াদের অপরাজিত ৬০ ও তামিমের ৬০ রানে ৬ উইকেটে ৫০ ওভারে ২৯৬ রান করে। বোলাররাও ৫১ রানে সেবাগ, গম্ভীর, যুবরাজকে তুলে নিয়ে আশার আলো জ্বালান। কিন্তু শেষ পর্যনত্ম ধোনিকেই ঠেকানো যায়নি। তাই তো অপরাজিত ১০১ রানের ইনিংসটি খেলে বাংলাদেশকে কাঁদান এক ধোনিই। ৪ উইকেটে ৪৭.৩ ওভারে ২৯৭ রান করে ৬ উইকেটের জয় তুলে নেয় টিম ইন্ডিয়া।
ডবল লীগ পদ্ধতির টুনর্ামেন্টে আবার ফিরতি ম্যাচে লঙ্কার বিরম্নদ্ধে লড়াই করতে মাঠে নামে বাংলাদেশ। ম্যাচ হারলে বাংলাদেশের বিদায় অনেকটাই নিশ্চিত হবে লঙ্কা জিতলে টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলা নিশ্চিত হবে। এমন সমীকরণে আবারও টস জেতেন সাঙ্গাকারা। ম্যাচও। আগে ফিল্ডিং করে শ্রীলঙ্কা। খেলায় বাংলাদেশের কোন ব্যাটসম্যান অর্ধশতকেরও চেহারা দেখেননি। শাকিব ৪৭, রকিবুল ৪৩, ইমরম্নল করেন ৪২ রান। দলের স্কোর গিয়ে দাড়ায় ৯ উইকেটে ৫০ ওভারে ২৪৯ রান। এ স্কোর এবারও সহজেই তাড়া করে লঙ্কানরা। দিলশান প্রথম ম্যাচেই ইনজুরিতে পড়েন। দলে ফেরেন ইনজুরিমুক্ত মাহেলা জয়াবর্ধনে। দলে যুক্ত হয়েই বাংলাদেশকে পান। খেলেন দুর্দানত্ম ইনিংস। প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের বিরম্নদ্ধে সেঞ্চুরি করেন (১০৮) । জয়াবর্ধনের সঙ্গে থারাঙ্গাও অপরাজিত ১১৮ রান করেন। এ দুই ব্যাটসম্যানের সেঞ্চুরিতে অনায়াসেই ৯ উইকেটের বিশাল জয় পায় শ্রীলঙ্কা। ৪২.৫ ওভারেই ২৫২ করে জয় নিয়ে টুর্নামেন্টের ফাইনাল নিশ্চিত করে। ভারত-শ্রীলঙ্কা পরের ম্যাচের ওপর বাংলাদেশের ভাগ্য অনেকটাই ঝুলতে থাকে।
কিসের অপেৰা। কোন হিসেবেই পড়ল না ভারত। শ্রীলঙ্কার বিরম্নদ্ধে ফিরতি ম্যাচে হারলে বাংলাদেশের সুযোগ থাকত। পরবর্তী ম্যাচে ভারতকে হারাতে পারলে ধোনিবাহিনীই টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নেয়ার আশঙ্কায় পড়ত। এজন্য বাংলাদেশকে শুধু বোনাস পয়েন্টসহই নয়, জিততে হতো রানরেটে নিজেদের অবস্থান ভারতের চেয়েও বেশি পাকাপোক্ত করে। কিছুই দরকার পড়ল না। ভারত এবার লঙ্কানদের বিরম্নদ্ধে সহজভাবেই জিতে টুর্নামেন্টের ফাইনাল নিশ্চিত করে। বাংলাদেশের বিদায় ঘণ্টা বেজে যায়। বাংলাদেশ-ভারত ফিরতি ম্যাচটি হয়ে ওঠে শুধুই আনুষ্ঠানিকতা। ম্যাচে এবারও টস সাঙ্গাকারার। টানা চার ম্যাচেই টস জেতার কৃতিত্ব গড়েন। এবার সাঙ্গাকারাবাহিনীও ভুল করে। ফাইনালে টস হারলে যদি আগে ব্যাট করতে হয়। এ অভিজ্ঞতা অর্জন করতে গিয়ে লঙ্কানরাও হারের বৃত্তে আটকা পড়ে। ধোনিবাহিনী সুযোগটি ভালভাবেই কাজে লাগায়। আগে ব্যাট করে ৩ উইকেট করে নেয়া জহির খান ও অমিত মিশ্রার বোলিং তোপে মাত্র ২১৩ রান করে। ৪৬.১ ওভারেই গুঁড়িয়ে যায় লঙ্কানদের ইনিংস। সাঙ্গাকারা সর্বোচ্চ ৬৮ রান করতে সৰম হন। এ রান হেসেখেলেই পাড়ি জমায় ভারত। ভিরাট কোহলি ও গম্ভীর দু'জনই ৭১ রান করেন। এ দুই অর্ধশতকে ৩২.৪ ওভারে ২ উইকেট হারিয়ে ২১৪ করে ম্যাচ জেতে ভারত।
টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ প্রতিটি ম্যাচেই ভাল ব্যাটিং প্রদর্শন করেছে। বাংলাদেশ-ভারত আনুষ্ঠানিকতার ম্যাচে কিছু একটা আশা করেছিল সবাই। এবার আরও পদোন্নতি ঘটে। শাকিব নিজে ব্যাটিং নৈপুণ্য দেখান। কিন্তু দল সেই হারের জাল ছিঁড়ে বেরম্নতে পারেনি। ভারতই শেষ পর্যনত্ম জয়ের মুখ দেখে। এবার আর টস জেতেননি শাকিব। তাই আগে ব্যাট করতে হয়েছে। শাকিবের ৮৫ ও রিয়াদের অপরাজিত ৬৪ রানে ৬ উইকেটে ৫০ ওভারে ২৪৭ রান করে বাংলাদেশ। এবার কোহলি সেঞ্চুরি করেই বসেন। (অপরাজিত ১০২)। তাঁর এ সেঞ্চুরিতে ৪ উইকেটে ৪৩ ওভারে ২৪৯ করে ম্যাচে জয় নিয়েই মাঠ ছাড়ে ধোনিবাহিনী। শূন্য হাতেই ফাইনালের দর্শক হয়ে থাকেন শাকিবরা।
টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন কোন দলটি হবে? টুর্নামেন্ট সেরা কে হবেন? ভারতের কোহলি না শ্রীলঙ্কা অধিনায়ক সাঙ্গাকারা? ফাইনালের আগে এ দু'টি কুইজ সবার মুখে মুখে। ২০০৯ সাল ফিরে আসবে কি? ফিরে আসলেই শ্রীলঙ্কা চ্যাম্পিয়ন হবে। নয়তো ভারত। শেষ পর্যনত্ম ম্যাচ শেষ হলো। সব প্রশ্নের উত্তরও মিলল। অবসান ঘটল টুর্নামেন্ট সেরার বিতর্কেরও। আবারও শিরোপা জিতল শ্রীলঙ্কাই। মাঝপথে তীব্র উত্তেজনার ম্যাচে ধোনিবাহিনীকে ৪ উইকেটে হারালো সাঙ্গাকারাবাহিনী। আইডিয়া কাপ জিতে নিল লঙ্কাই। টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কারটিও জিতলেন লঙ্কান ক্যাপ্টেন সাঙ্গাকারা। ম্যাচে এবারও টস জয়ের ভাগ্য সাঙ্গাকারারই। এবার আর ভুল না করে ফিল্ডিংই নেন। ভারত তারকা ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতায় ম্যাচ একদিকে ঝুঁকে পড়ে। কিন্তু মিডল অর্ডারে সুরেশ রায়নার (১০৬) সেঞ্চুরি ভারতকে আশার পথ দেখায়। ৪৮.২ ওভারে ২৪৫ রান করে ভারত। বড় ম্যাচের ক্রিকেটার যে জয়াবর্ধনে_ফাইনালে তা প্রমানিত হয়। সাঙ্গাকারাও যে সেই পথে অনেকদূর এগিয়ে গেছেন সেটিও প্রতীয়মান। জয়াবর্ধনে অপরাজিত ৭১ ও সাঙ্গাকারা ৫৫ রান করেন। শ্রীলঙ্কা ম্যাচ জেতে ৪ উইকেটে। ৪৮.৩ ওভারে ৬ উইকেটে ২৪৯ রান করে টুর্নামেন্ট জয়ের আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ে লঙ্কান ক্রিকেটাররা। ৫ ম্যাচের ৪টিতে অর্ধশতক করে ২৭৪ রান করে টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কার সাঙ্গাকারা নিজের ঝুলিতে ভরেন। টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কারস্বরূপ গাড়ির চাবিটি হাতে পেতেই দলের ক্রিকেটাররা তাঁকে ঘিরে ধরেন। সেই গাড়িতেই ক্রিকেটাররা সওয়ার হয়ে আনন্দ মিছিল সেরে নেন। আরেকটি টুর্নামেন্টের ফাইনালে হারে ভারত। শ্রীলঙ্কার আবারও নতুন বছর শুরম্ন হয় শিরোপা জিতেই।

No comments

Powered by Blogger.