বিনামূল্যে পাঠ্যবই-অনন্য এক সামাজিক আন্দোলনের যেভাবে জন্ম হলো by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

গতকাল জানুয়ারির দ্বিতীয় দিনে যখন এ লেখা লিখছি, অনেকগুলো সংবাদপত্রে দেখেছি_ স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের হাতে হাতে ঝকঝকে নতুন বই। মাধ্যমিক পরীক্ষায় বিশেষভাবে ভালো ফল করে যেসব স্কুল, তাদের নিয়ে এমন সচিত্র খবর দেখে আমরা অভ্যস্ত।
কিছুদিন আগে অষ্টম শ্রেণীর জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা এবং প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার ফল প্রকাশ হওয়ার পরও এমন চিত্র দেখেছি। তবে পাঠ্যবই বিতরণকে কেন্দ্র করে যে আনন্দ-উল্লাস তা সব প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়কে ছুঁয়ে যায়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণের পদক্ষেপ অনেক বছর আগেই নেওয়া হয়েছিল। বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে পরের বছর থেকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীকেও সরকার বিনামূল্যে বই বিতরণ করবে। বহু বছর ধরেই সরকারি প্রতিষ্ঠান এনসিটিবির তত্ত্বাবধানে বেসরকারি প্রকাশকরা স্কুলের পাঠ্যবই প্রকাশ ও দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। এ ক্ষেত্রে প্রধান অভিযোগ ছিল, সময়মতো সব বই প্রকাশ হয় না এবং কোনো কোনো বই প্রকাশ হতে শিক্ষাবর্ষের ২-৩ মাসও গড়িয়ে যায়। এক পর্যায়ে এ অভিযোগ ব্যাপকভাবে উঠতে থাকে যে বোর্ড নির্ধারিত মূল্যে সব বই পাওয়া যায় না এবং শিক্ষার্থীদের গাইডবই কিনতে বাধ্য করা হয়। দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের জন্য বই কেনার ব্যয়ভার বহনও ক্রমে কঠিন হয়ে পড়ছিল। দেশে শিক্ষার প্রসার ঘটছে এবং দরিদ্র পরিবারেও ক্রমে শিক্ষার আলো প্রবেশ করতে শুরু করেছে। কিন্তু তাদের তো সব বই কেনার সামর্থ্য নেই।
এ অবস্থায় মাধ্যমিক পর্যায়ের সব শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে বই প্রদানের সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে ছিল যুগান্তকারী পদক্ষেপ। ২০০৯ সালে এ পদক্ষেপ গ্রহণের সময় একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা হয় সার্বিক বিষয় তদারকির জন্য। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল এর সদস্য হিসেবে কাজ করার। পরের বছরও একই দায়িত্ব আমার ওপর অর্পিত হয়েছিল। সে সময়ে তিনটি বিষয় আমার কাছে বিশেষভাবে ধরা পড়ে। এর মধ্যে দুটি নেতিবাচক এবং একটি ইতিবাচক। তবে শেষ পর্যন্ত সবার আন্তরিক চেষ্টায় ইতিবাচক বিষয়টিই সব বাধা জয় করে আমাদের প্রত্যাশা ছাপিয়ে যায়।
প্রথমে নেতিবাচক বিষয়ের কথাই বলছি। আমাদের দেশে একদল উৎপাদক ও ব্যবসায়ী রয়েছেন, যারা এমনকি শিশু খাদ্যেও ভেজাল দিতে ইতস্তত বা দ্বিধা করেন না। তাদের কাছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বাস্থ্য বড় কথা নয়, লাভ কত বেশি হবে সেটাই মুখ্য। একইভাবে জীবন রক্ষাকারী ওষধের নামেও বাজারে ছাড়া হয় ভেজাল ওষুধ। এভাবে রোগ বাঁচানোর জন্য চড়া দামে কেনা ওষুধও হয়ে ওঠে প্রাণঘাতী। পাঠ্যবই শিশুদের হাতে সময়মতো পেঁৗছে দিতেই হবে, এ বিষয়টি নিয়ে আমরা বইয়ের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনায় বসেছি। বৈঠক হয়েছে একাধিকবার এবং তাতে খোলামেলা কথা বলেছেন অনেকেই। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কোটি কোটি শিক্ষার্থীর জন্য বই প্রকাশ কেবল ব্যবসায়িক কার্যক্রম নয়, একই সঙ্গে জনসেবাও_ এটা সবাই স্বীকার করেন। কিন্তু কথা আর কাজে সবাই এক থাকেন না।
দ্বিতীয়ত যে বিষয়টি লক্ষ্য করেছি সেটা হচ্ছে, পাঠ্যবইয়ের বিপুল ব্যবসার সুবিধা গ্রহণে নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দেওয়ার প্রবণতা। পছন্দের লেখক দিয়ে বই লেখানো এবং পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে প্রকাশের দায়িত্ব প্রদানে আগ্রহী ছিলেন অনেকেই। সরকার বই প্রকাশের দায়িত্ব গ্রহণ করায় এ ব্যবসা হাতছাড়া হয়ে যাবে, সেটা তারা বুঝতে পারেন। এ কারণে শুরু হয় নানা চক্রান্ত। প্রথমে বলা হয়, সরকারের পক্ষে এমন দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন অসম্ভব। কিন্তু দ্রুতই তারা বুঝতে পারলেন যে, অসম্ভবকে সম্ভব করার মতো কিছু লোক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন এবং তারা কোনো বাধা মানবেন না। তখন শুরু হলো ভিন্ন পথে তৎপরতা, যা রীতিমতো ভয়ঙ্কর মাত্রা পেল। বই যাতে সময়মতো প্রকাশিত হতে না পারে সে জন্য বাইন্ডারদের ধর্মঘটে যাওয়ার জন্য প্ররোচনা দেওয়া হয়। শুধু যে অসাধু প্রকাশকরা এ চক্রান্তের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, সেটা বলা যাবে না। এমনকি সরকারি প্রতিষ্ঠানের অফিসার ও কর্মচারীদেরও কাউকে কাউকে দেখা যায় চক্রান্তকারীদের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন কিংবা নিজেরাই এমন অপকর্মে লিপ্ত হয়ে পড়ছেন।
আর ইতিবাচক যে বিষয়টি লক্ষ্য করছি তা হচ্ছে, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন বিভাগ ও দফতর-অধিদফতরের আন্তরিকতা। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও এগিয়ে এসেছিলেন সময়মতো। এনসিটিবি ও মাধ্যমিক শিক্ষা পর্ষদের কর্মীদের মধ্যেও সৃষ্টি হয়েছিল প্রতিকূলতা জয় করার মানসিকতা। এক দল নিবেদিতপ্রাণ কর্মী রাতদিন পরিশ্রম করে নতুন বছরের প্রথম দিনেই দেশের প্রতিটি স্কুলে বই পেঁৗছানোর কাজ সুচারুরূপে সম্পন্ন করেন।
এ কাজে বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো বিষয় হচ্ছে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের গতিশীল নেতৃত্ব। তার সঙ্গে যে কোনো সমস্যা নিয়ে সরাসরি কথা বলা সম্ভব ছিল। যত বড় সমস্যাই হোক, তিনি দ্রুত ও যথাযথ সমাধান প্রদানে ছিলেন আন্তরিক। ফলে বিষয়টি কেবল আর পাঠ্যবই প্রকাশ ও বিতরণে সীমাবদ্ধ থাকে না, হয়ে ওঠে একটি বড় ধরনের সামাজিক আন্দোলন।
গত ১ জানুয়ারি চতুর্থবারের মতো বই পেয়েছে শিক্ষার্থীরা। বই প্রকাশ হয়েছে ২৬ কোটিরও বেশি। গ্রহীতার সংখ্যা প্রায় পৌনে চার কোটি। তারা এসেছে অন্তত আড়াই থেকে তিন কোটি পরিবার থেকে। হতদরিদ্র থেকে কোটিপতি, সব পরিবারের ছেলেমেয়েরাই হাতে পেয়েছে বিনা মূল্যের বই। আগামীতে বইয়ের সংখ্যা আরও বাড়বে, সেটা বলাই চলে। এর সূত্র ধরে বলা যায় যে, বই সময়মতো প্রকাশ ও বিতরণ হবে কি-না, সেটা নিয়ে সংশয় একেবারেই থাকবে না। আমরা সম্মিলিত চেষ্টায় অন্ধকারের শক্তিকে পিছু হটিয়ে দিয়েছি। তাদের সামর্থ্য হবে না এ ধারাকে উল্টে দেওয়ার। দুর্ভাগ্যজনকভাবে যদি সেটা ঘটে, তবে আমাদের জাতি হিসেবে অন্ধকার যুগে ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
প্রথম বছর আমাদের ছিল নতুন পথে চলার মতো। কিছুটা শঙ্কিত পদক্ষেপ ফেলতে হয়েছে। এ বছরের বই বিতরণে তেমন বিঘ্ন ঘটেনি। এখন নিদ্বর্িধায় বলা যায়, আমরা দৌড়াতে শিখেছি। যারা বলে যে বাঙালি ব্যবস্থাপনার কাজে ভালো নয়, দক্ষতা নিয়ে যারা প্রশ্ন তোলেন, তাদের উচিত পাঠ্যবই প্রকাশ ও বিতরণের বিষয়টি বিবেচনায় না রাখা। সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন কাজে এর অভিজ্ঞতা অনুসরণ করা গেলে সামাজিকভাবে আমরা অনেক এগিয়ে যাব, তাতে সন্দেহ নেই।
এবারে প্রধানমন্ত্রী ৩১ ডিসেম্বর কয়েকজন শিশুর হাতে গণভবনে বই তুলে দিয়েছেন। আমি আরও খুশি হতাম যদি তিনি ১ জানুয়ারি প্রত্যন্ত কোনো গ্রামের স্কুলে গিয়ে শিশুদের হাতে বই তুলে দিতেন। এর মধ্য দিয়ে শিক্ষার প্রতি সরকারের অঙ্গীকারের নতুন করে প্রকাশ ঘটত। ১ জানুয়ারি তাকে আমরা দেখেছি বাণিজ্যমেলা উদ্বোধন করতে। বাণিজ্য আমাদের বাড়াতে হবে। অর্থনীতির চাকা সচল করতে হবে। শিক্ষার প্রসারের জন্যও সবল অর্থনীতির প্রয়োজন রয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী সরাসরি নির্দেশনা প্রয়োজনও অপরিহার্য। তবে তারপরও বলব, তাকে শিক্ষার জন্য আরও বেশি প্রয়োজন। এ কারণেই প্রত্যাশা থাকবে যে, আগামী বছর জানুয়ারির প্রথম দিনে তিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরে নতুন বই ছাত্রছাত্রীদের হাতে তুলে দিচ্ছেন।
বিনা মূল্যে বই বিতরণের সুফল বিশেষভাবে পাচ্ছে দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েরা। বিশেষভাবে উপকৃত হচ্ছে ছাত্রীরা। নারী শিক্ষার প্রসারে বাংলাদেশের অর্জন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অমর্ত্য সেন থেকে শুরু করে জাতিসংঘের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞ, কারও নজর এড়ায় না। বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ, পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীতে পাবলিক পরীক্ষা চালু, ছাত্রীদের উপবৃত্তি প্রদান_ এসব অর্জন সবার সামনে রয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের ফল প্রকাশিত হচ্ছে সময়মতো। মহাজোট সরকারের অনেক ব্যর্থতা রয়েছে ঠিকই, কিন্তু শিক্ষা খাতে অগ্রগতি নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সবাই মুক্তকণ্ঠে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে সাধুবাদ দিচ্ছেন।
বই বিতরণের কাজটি যেভাবে সফল সামাজিক আন্দোলনের প্রতীক হয়ে উঠেছে তার ধারাবাহিকতায় আরেকটি পদেক্ষপ গ্রহণের জন্য আমি বিনীত অনুরোধ জানাতে চাই। স্কুলকে শিশুদের জন্য আনন্দদায়ক করে তুলতেই হবে। সেখানে সুন্দর ভবন গড়ে উঠুক, থাকুক গ্রন্থাগার ও কম্পিউটার ল্যাবরেটরি। খেলার মাঠ ও সব শিশুর জন্য পরিচ্ছন্ন টয়লেট অবশ্যই স্থাপন করতে হবে। বিশেষভাবে নজর দিতে হবে কন্যাশিশুর প্রতি। গ্রন্থাগার ও কম্পিউটার তাদের আধুনিক জগৎকে সামনে এনে দেবে। এ জন্য বাজেট বরাদ্দে কার্পণ্য করা উচিত হবে না। এ ধরনের সুবিধা দেশের সার্বিক উন্নয়নে কী প্রভাব ফেলে তার চমৎকার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে আমাদের কাছের দেশ শ্রীলংকা। বাংলাদেশের সব গ্রামেই চাই সুন্দর ও আদর্শ স্কুল_ এ লক্ষ্য অর্জনে সবাই দৃঢ়সংকল্প নিয়ে এগিয়ে আসুক, অবশ্যই কোনো বাধা অজেয় থাকবে না।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : অধ্যাপক ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.