সাদেকা দম্পতির অনলাইন সুকৃতি by পল্লব মোহাইমেন

নতুন বছরের প্রথম দিনটিই অনেক আনন্দে কেটেছে সাদেকা হাসানের। ১ জানুয়ারি উদ্বোধন হলো ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা, ২০১৩। এবারই প্রথম বাণিজ্য মেলার সব পণ্য ঘরে বসে অনলাইনে কেনাকাটা করা যাবে। আর এ কৃতিত্ব সাদেকা হাসান ও তাঁর স্বামী আতাউর রহমানের।
ই-বাণিজ্যের (ই-কমার্স) এ সাইট তৈরি, পণ্যের তথ্য সংগ্রহ ও তথ্যভান্ডার ব্যবস্থাপনার কাজটা তাঁরা করেছেন তাঁদের প্রতিষ্ঠান ফিউচার সলিউশন ফর বিজনেস (এফএসবি) থেকে। মেলা উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম ক্রেতা হিসেবে একটি নকশিকাঁথা কেনেন বাণিজ্য মেলার পণ্য বেচাকেনার এ ওয়েবসাইট থেকে। স্বভাবতই সাদেকা হাসান খুব খুশি।
‘এত বড় একটা কাজ যে আমরা সময়মতো করে ফেলতে পেরেছি, এটাই বড় কথা। পণ্যের তথ্য, ছবি সংগ্রহ করে ওয়েবে প্রকাশ করার পুরো কাজ করছে গ্রামের ছেলেমেয়েরা। দরকারি প্রশিক্ষণ পাওয়ার পর তারা ঢাকায় এসে কাজগুলো করতে পারছে।’ বললেন সাদেকা।
এই দম্পতির সঙ্গে প্রথম দেখা ২০১০ সালের জানুয়ারিতে, বাগেরহাটের রামপালে; জ্ঞানমেলায়। সেখানে তাঁদের স্টলে মংলার নারীদের তৈরি নকশিকাঁথা, শাড়িসহ নানা রকম পণ্য ছিল। তবে সেই পণ্য কিনতে হবে অনলাইনের মাধ্যমে। বাংলাদেশে সে সময় এ ধরনের ই-কমার্স উদ্যোগ নিতে একটু সাহসের প্রয়োজন ছিল বৈকি। তবে তাঁরা বলেছিলেন, ‘আমরা পারব।’
সাদেকাদের এফএসবির ওয়েবসাইট ‘আমার দেশ আমার গ্রাম’-এর মাধ্যমে বাংলাদেশের বিভিন্ন পণ্য উৎপাদকেরা সরাসরি বিক্রি করতে পারেন অনলাইনে। সেটা শাকসবজি, মাছ-মাংস থেকে শুরু করে পোশাক, হস্তশিল্প— সবকিছুই হতে পারে। এই অনলাইন বাজারে এখন প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার উৎপাদকের ১৫ হাজার রকমের পণ্য রয়েছে।
যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব বেডফোর্ডশায়ারে কম্পিউটার নেটওয়ার্ক প্রকৌশল বিষয়ে পড়েছেন আতাউর রহমান। সে সময় (২০০৩ সাল) তিনি এফএসবি ইউকে গড়ে তোলেন। ২০০৬ সালে আতাউর রহমানের সঙ্গে বিয়ের পর সাদেকা হাসান চলে যান লন্ডনে। সেখানে তিনি স্থাপত্যবিদ্যায় পড়াশোনা শুরু করেন।
আতাউর রহমান ভেবেছিলেন, বিলেতেই স্থায়ী হবেন। কিন্তু বিভিন্ন কাজের সুযোগের ক্ষেত্রে বর্ণবৈষম্য তাঁকে পীড়া দিত। সাদেকাও বিলেতে থাকতে চান না। দেশে কিছু করা যায় কি না—এ ভাবনা থেকে ২০০৮ সালে তাঁরা চলে আসেন দেশে।
বাংলাদেশ ব্র্যান্ডস নামের বিভিন্ন ফ্যাশন হাউসের ই-কমার্স সাইট তৈরি করে দেন তাঁরা। সাদেকা বলেন, ‘বিবি রাসেলের কাজের ধারা আমাকে ভাবতে শেখাল সরাসরি উৎপাদকদের কাছে যেতে।’ সাদেকার দাদা ও নানার বাড়ি মংলায় চলে গেলেন দুজন। যে নারীরা নকশিকাঁথা তৈরি করেন, তাঁদের ডাকলেন। বললেন, ‘কম্পিউটারে আপনাদের পণ্য বিক্রি হবে।’ আতাউর স্থানীয় কলেজের কয়েকজন ছাত্রকে ছবি তোলা, ডেটা এন্ট্রি এবং ওয়েবে তথ্য প্রকাশ করার প্রশিক্ষণ দেন। শুধু নকশিকাঁথা নয়, ঘেরের মাছ, সুন্দরবনের মধু থেকে শুরু করে নানা পণ্য নিয়ে আসেন উৎপাদকেরা। আর সবই স্থান পায় ই-কমার্স সাইটে।
এভাবেই মংলায় শুরু হয় আমার দেশ আমার গ্রাম ওয়েবসাইটের প্রথম কেন্দ্র। এখন জামালপুর, টাঙ্গাইল, নরসিংদী, কুষ্টিয়া, রংপুর, দিনাজপুর ও রাজবাড়ীতে একটি করে আর যশোরে দুটি কেন্দ্র রয়েছে। শিগগির আরও কেন্দ্র চালু হবে। সাদেকা জানান, ‘পণ্যের দাম উৎপাদককে দেওয়ার পর আমরা ৫ শতাংশ অর্থ দিই ব্যাংককে। ৫ শতাংশ কেন্দ্রের উন্নয়নে চলে যায়, আর বাকি ৫ শতাংশ এফএসবির জন্য থাকে।’ এসব কেন্দ্রে শুধু ই-কমার্সের কাজ হয় না, কেন্দ্র থেকে স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটও তৈরি করে দেওয়া হয়।
২০১১ সালে এফএসবি পেয়েছে জাতীয় ডিজিটাল উদ্ভাবনী পুরস্কার, ই-এশিয়া পুরস্কার, জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড ইয়ুথ সামিট পুরস্কার ও ভারতের মন্থন পুরস্কার। ২০১২ সালে এসেছে ইউরো-এশিয়া আইসিটি সামিট পুরস্কার। সর্বশেষ ২০১২ সালের নভেম্বরে উইটসা পুরস্কারও পেয়েছে আমার গ্রাম আমার দেশ। এ পুরস্কারের জন্য ৮৪টি দেশ থেকে ১১ হাজার আবেদন জমা পড়েছিল। পুরস্কৃত হয়েছে মাত্র ১২টি প্রকল্প। আতাউর ও সাদেকার স্বপ্ন—বাংলাদেশের সব গ্রামের পণ্য অনলাইন বাজারে বেচাকেনা হবে বিশ্বজুড়ে। জনপ্রিয় হবে বাংলাদেশের ব্র্যান্ড, উজ্জ্বল হবে দেশের ভাবমূর্তি।
প্রথম আলোর ‘আমিই বাংলাদেশ’ আয়োজনের জন্য পরামর্শ দিতে যোগাযোগ: ab@prothom-alo.info

No comments

Powered by Blogger.