মধুপুরে ধর্ষণ ॥ যুবদল নেতাসহ গ্রেফতার ৫ জন রিমান্ডে- চিকিৎসাধীন স্কুলছাত্রী এখন মানসিক ভারসাম্যহীন

মধুপুর উপজেলা যুবদলের যুগ্ম সম্পাদক মনিরুজ্জামান মনির নেতৃত্বে একদল নরপশুর নির্মম গণধর্ষণের শিকার নবম শ্রেণীর স্কুলছাত্রী (১৫) ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে চিকিৎসাধীন রয়েছে।
সে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ায় সুস্থ হয়ে উঠতে বেশ সময় লাগবে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। এদিকে টাঙ্গাইলে পুলিশ ৪ ধর্ষক ও ধর্ষণে সহায়তাকারী এক তরুণীকে গ্রেফতার করে বুধবার দুপুরে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট খ-অঞ্চলের বিচারক জান্নাতুল ফেরদৌস ইবনে হকের আদালতে হাজির করে। পুলিশ আসামিদের ৭ দিনের রিমান্ডের আবেদন করলে আদালত ৪ ধর্ষককে ৩ দিন ও সহায়তাকারী বিথি আক্তার ইভাকে এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
আটককৃতরা হলো ধর্ষিতার বান্ধবী বিথি আক্তার ইভা, মনিরুজ্জামান মনি, শাজাহান আলী, নুরুজ্জামান গেদা, হারুনুর রশীদ। এ গণধর্ষণের সঙ্গে জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে বুধবার দুপুরে টাঙ্গাইলে বিভিন্ন সংগঠন সমাবেশ ও মানববন্ধন কর্মসূচী পালন করেছে।
টাঙ্গাইল ডিবি পুলিশের ওসি হুমায়ুন কবীর জানান, গত রবিবার রাতে ধর্ষিতার বান্ধবী বিথি আক্তার ইভাকে রসুলপুর গ্রামের বাড়ি থেকে আটক করা হয়। পরে তার কথামতো সোমবার সকালে মধুপুর উপজেলার সুপ্তি কম্পিউটার দোকানে অভিযান চালিয়ে দোকানের মালিক ও মধুপুর উপজেলা যুবদলের ৩নং যুগ্ম সম্পাদক মনিরুজ্জামান মনিসহ অন্যদের গ্রেফতার করা হয়। ভিডিও দোকান থেকে অশ্লীল ভিডিও চিত্র, দুইটি কম্পিউটার, দুইটি ক্যামেরা ও সিডি উদ্ধার করে ডিবি পুলিশ।
মধুপুরের স্থানীয় জনগণ জানায়, উপজেলা যুবদলের যুগ্ম সম্পাদক মনিরুজ্জামান মনির নেতৃত্বে একটি চক্র দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের কুকর্ম করে আসছিল। যুবদল নেতা মনি ও তার সহযোগী বিথি নাটক, সিরিয়াল, মিউজিক ভিডিও তৈরি করত। এসব তৈরি করে তারা ডিস লাইনের মাধ্যমে প্রচারের কথা বলে টাঙ্গাইলসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে স্কুল ও কলেজপড়ুয়া মেয়েদের এসব কাজে উদ্বুদ্ধ করত। যেসব মেয়ে মনি ও বিথির খপ্পরে পড়ত তাদের বিভিন্নভাবে যৌন নির্যাতন চালিয়ে অশ্লীল ভিডিও চিত্র ধারণ করে রাখত। পরে মনির কম্পিউটার দোকান থেকে সিডি আকারে তা বাজারে বিক্রি করা হতো।
ডিবি পুলিশের ওসি হুমায়ুন কবীর আরও জানান, ধর্ষিতা স্কুলছাত্রীর বাড়ি টাঙ্গাইল সদর উপজেলার শিবপুর তারাবাড়ী গ্রামে। তার দিনমজুর পিতার নাম ফয়েজুদ্দিন। সে সদর উপজেলা আগ বিক্রমহাটি মাহমুদুল হাসান উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্রী। গত ৬ ডিসেম্বর বিয়ের দাওয়াত খাওয়ার কথা বলে বিথি তার স্কুল সহপাঠীকে (ধর্ষিতা) নিয়ে যায় মধুপুরে মনির মালিকানাধীন কম্পিউটার দোকানে। সেখান থেকে তারা নির্জন পাহাড়ী এলাকার একটি বাড়িতে যায়। এরপর দিনে সেখানে তারা বিভিন্ন পাহাড়ী লোকেশনে ‘নিয়তি’ নামক নাটকের শুটিং করে। পরে পূর্বপরিকল্পনা মতো নুরুজ্জামান গেদার বাড়িতে যায়। রাতে মনিসহ শাজাহান আলী, নুরুজ্জামান গেদা, হারুনুর রশীদ তাকে গণধর্ষণ করে। এ সময় বিথি পাশের রুমে অবস্থান নিয়ে জোরে গান বাজাতে থাকে। এভাবে ৩দিন তাকে ওই বাড়িতে আটকে রেখে গণধর্ষণ করে। শুধু তাই নয়, নরপশুরা এ ধর্ষণের ভিডিও চিত্রও ধারণ করে।
এরপর গত ১০ ডিসেম্বর সোমবার সদর উপজেলার রসুলপুর রেললাইনের ওপর ধর্ষিতা স্কুলছাত্রীকে মুমূর্ষু অবস্থায় ফেলে রেখে তারা চলে যায়। সংবাদ পেয়ে স্কুলছাত্রীর বড় ভাই রফিকুল আলম রেললাইন থেকে তাকে উদ্ধার করে গত ১২ ডিসেম্বর বুধবার টাঙ্গাইল সদর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেখান থেকে গত সোমবার রাতেই বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা পরিচালিত এসএএইচ আর প্রকল্পের আইএফও টাঙ্গাইল শাখার মাধ্যমে তাকে ঢাকায় প্রেরণ করা হয়। এ ঘটনায় ধর্ষিতার ভাই রফিকুল আলম বাদী হয়ে পাঁচজনকে আসামি করে মধুপুর থানায় মামলা দায়ের করেছে। এদিকে ধর্ষিতা স্কুলছাত্রী ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ওই ছাত্রী এখন মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে বলে তার চিকিৎসক ডা. বিলকিস বেগম জানিয়েছেন। তিনি জানান, ঘুমের ওষুধেও তার এখন কাজ হচ্ছে না। সে মাঝে মধ্যে বলছে নরপশুরা তার ধর্ষণের চিত্র ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়ার হুমকি দিয়েছে। যুবদলের নেতার বিষয়ে জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক আশরাফ পাহেলী বলেন, মনি দোষী হয়ে থাকলে তাকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হবে। মামলার বিষয়ে টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর সাংবাদিকদের বলেন, রিমান্ডে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এ চক্রের সঙ্গে আরও কেউ জড়িত থাকলে তাদেরও গ্রেফতার করা হবে। এ বিষয়ে কোন ছাড় দেয়া হবে না।
ন্যক্কারজনক এ ঘটনায় মধুপুরসহ পুরো টাঙ্গাইলে সমালোচনার ঝড় বইছে। এ ঘটনার তীব্র নিন্দা, ক্ষোভ ও ধর্ষকদের কঠোর শাস্তির দাবি জানিয়ে ধনবাড়ী উপজেলা প্রেসক্লাব চত্বরে বুধবার বিক্ষোভ সমাবেশ করা হয়েছে। বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা ধনবাড়ী উপজেলা শাখা, প্রেসক্লাব ও সাংবাদিক স্মৃতি পাঠাগার মিলিতভাবে এ বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করে। মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার সভাপতি আব্দুল্লাহ আবু এহসানের সভাপতিত্বে সমাবেশে ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন প্রেসক্লাব সভাপতি স ম জাহাঙ্গীর আলম, মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিক স্মৃতি পাঠাগারের সভাপতি আনছার আলী, জাপা নেতা জীবন মাহমুদ শক্তি, আশরাফুজ্জামান, মানবাধিকার কর্মী শাহাদৎ হোসেন, লাভলী ইয়াসমিন, রমজান আলী, সাংবাদিক বেলাল হোসেন, ডা. আবুবকর সিদ্দিক প্রমুখ।
টাঙ্গাইলে দুপুরে শহরের কোর্ট চত্বরে ইয়ুথ এন্ডিং হাঙ্গার প্রজেক্ট টাঙ্গাইল জেলা শাখার ব্যানারে মানববন্ধন করা হয়। এতে বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ স্কুলছাত্রী ধর্ষণে জড়িতদের ফাঁসি, নারীদের নিরাপত্তা এবং ধর্ষিতা ও তার পরিবারকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তার দাবি জানান। তা না হলে তারা এর চেয়ে আরও কঠোর আন্দোলনে যাবে বলে হুমকি দেন।

No comments

Powered by Blogger.