আটকে রাখা হচ্ছে ২৪ ঘণ্টার বেশি- আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আইন মানছে না! by কাজী আনিছ

পোশাক কারখানায় ডাকাতির অভিযোগে আশরাফুল ইসলাম ওরফে সেন্টু মিয়া (৩৫) নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। গত ২০ নভেম্বর আশরাফুলসহ কয়েকজনকে আদালতে হাজির করা হয়। ডিবি জানায়, তাঁদের ১৯ নভেম্বর গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
কিন্তু আশরাফুলের পরিবারের দাবি, ১৬ নভেম্বর বিকেলে তাঁকে আশুলিয়ার বাইপাইল থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তাঁর কোনো খোঁজ না পাওয়ায় আশুলিয়া থানায় তারা একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে। প্রায় চার দিন আটকে রাখার পর আশরাফুলকে আদালতে হাজির করে ডিবি।
সংবিধানে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিকে ২৪ ঘণ্টার বেশি আটক না রাখার বিধান থাকলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অনেক ক্ষেত্রেই তা মানছেন না। দীর্ঘদিন আটকে রেখে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তির ওপর শারীরিক নির্যাতন, মামলা সাজানো, দেনদরবারসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে তাঁদের বিরুদ্ধে। এমনকি গ্রেপ্তার করার পর সংশ্লিষ্ট পরিবার জানতে পারে না। সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি ঘটনার অনুসন্ধান করে এসব অভিযোগের সত্যতাও মিলেছে।
ওই ডাকাতি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির উপকমিশনার (ডিসি) মোল্যা নজরুল ইসলাম ২৪ ঘণ্টার বেশি আটক রাখার অভিযোগ অস্বীকার করেন। তবে আশরাফুলের পরিবারের করা জিডির তদন্ত কর্মকর্তা আশুলিয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সাদেক দেওয়ান জানান, যেদিন আশরাফুল নিখোঁজ ছিলেন, সেদিনই ডিবি তাঁকে গ্রেপ্তার করেছিল।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ২৪ ঘণ্টার বেশি আটক রেখে শুধু আদালতের সঙ্গে নয়, রাষ্ট্র ও সংবিধানের সঙ্গে মিথ্যাচার করা হচ্ছে। এ ধরনের অভিযোগ কমিশনের কাছেও রয়েছে।
বিষয়টি সম্পর্কে পুলিশের মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ কীভাবে কাজ করবে, তা আইন দিয়ে নিয়ন্ত্রিত। এর বাইরে কারও কোনো ধরনের কাজ করার সুযোগ নেই। কেউ যদি সেটা করে, তবে তা হবে আইনবিরুদ্ধ। এটা প্রমাণিত হলে দোষী ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান আছে।
আইনে যা আছে: সংবিধানের ৩৩(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, গ্রেপ্তার ও প্রহরায় আটক প্রত্যেক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিকটতম ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করতে হবে। ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ছাড়া তাকে এর বেশি সময় আটক রাখা যাবে না। ফৌজদারি আইনের ৬১ ধারায় ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় কাউকে আটক না রাখার কথা বলা হয়েছে।
কয়েকটি উদাহরণ: জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসক নারায়ণ চন্দ্র হত্যায় কামাল হোসেন নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। গত ২৫ আগস্ট বিকেলে সাংবাদিকদের মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠিয়ে গ্রেপ্তারের খবর জানানো হয়। প্রায় দুই দিন আটক রাখার পর ‘সন্দেহজনক ঘোরাঘুরি’র অভিযোগ এনে তাঁকে আদালতে সোপর্দ করা হয়। জামিনে মুক্তির পর ৩০ আগস্ট কামাল প্রথম আলোর কাছে অভিযোগ করেন, প্রায় দুই দিন তাঁর ওপর অমানবিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যার ব্যাপারে জোর করে স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করেছিল র‌্যাব।
এ ব্যাপারে গত ২ সেপ্টেম্বর র‌্যাবের সদর দপ্তরে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এ বিষয়ে প্রশ্ন উঠলে র‌্যাব আটক রাখা ও নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করে। তবে র‌্যাব জানায়, হত্যায় জড়িত একজনের সঙ্গে লুটের মালামাল ভাগাভাগি করা নিয়ে কামালের মুঠোফোনে যোগাযোগ হয়েছিল। তাই তাঁকে প্রথমে আটক করা হয়। তাহলে তাঁকে কেন হত্যা মামলার আসামি করা হয়নি, এ প্রশ্নের কোনো সদুত্তর মেলেনি।
সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা মামলার আসামি তানভীর রহমান নিখোঁজ হন গত ১ অক্টোবর। এর নয় দিন পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর সংবাদ সম্মেলন করে তাঁকে গ্রেপ্তারের কথা স্বীকার করেন। সাগরের বাসার দারোয়ান পলাশ রুদ্র ২ অক্টোবর গ্রেপ্তার হলেও নয় দিন পর র‌্যাব গ্রেপ্তারের কথা স্বীকার করে।
গত বছরের ২১ জানুয়ারি মিরপুরের মধ্য পীরেরবাগে ব্যবসায়ী কাজী জিয়া হায়দার খুনের ঘটনায় ইমরান হোসেন ওরফে জিতু নামের একজনকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। গত ৩০ আগস্ট রাজধানীর মিন্টো রোডে পুলিশের মিডিয়া সেন্টারে প্রেস ব্রিফিংয়ে ডিবি দাবি করে, ২৯ আগস্ট মিরপুরের শাহআলী থানার দিয়াবাড়ি এলাকা থেকে ইমরানকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে এলাকাবাসী জানান, ২১ আগস্ট জিতুকে গ্রেপ্তার করে প্রায় ১০ দিন আটক রাখে ডিবি। একইভাবে ২৪ ঘণ্টার বেশি আটক রাখা হয় মামুন নামের আরেক আসামিকে। কিন্তু ২৪ ঘণ্টা মাথায় রেখেই আদালতে কাগজপত্র দেওয়া হয়।
ওই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির পরিদর্শক নিবারণচন্দ্র বর্মণ এভাবে আটক রাখার কথা স্বীকার করেন। এটা আইনবিরুদ্ধ ও আদালতের সঙ্গে মিথ্যাচার নয় কি, প্রশ্ন করলে নিবারণ বলেন, ‘তা তো অবশ্যই।’
র‌্যাবের গণমাধ্যম শাখার পরিচালকের দায়িত্বে থাকার সময় সম্প্রতি এসব অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে এম সোহায়েল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের আদালতে হাজির করার চেষ্টা করি। কিন্তু অনেক সময় দূরের কোনো জায়গা থেকে কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের পর যানজট ও পরিবহনের সমস্যার কারণে আদালতে হাজির করতে কিছুটা বিলম্ব হয়।’
মানবাধিকারকর্মীরা যা বলছেন: আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করা হয় না। এর পেছনে অনেক ধরনের কারণই রয়েছে। তিনি বলেন, এটি মানবাধিকার, গণতন্ত্র, আইনের শাসন—প্রতিটি ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান মনে করেন, এ ধরনের আইন ভঙ্গের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা না নিলে এ প্রবণতা কমবে না।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক এ এস এম শাহজাহান বলেন, ‘২৪ ঘণ্টার বেশি আটক রাখার আইনগত কোনো ভিত্তি নেই। এমনকি ন্যায়বিচারের স্বার্থেও কোনো বেআইনি পদক্ষেপ নেওয়া উচিত নয়। এতে তদন্তে ভালো ফল আসে না। এ ধরনের বেআইনি পদক্ষেপের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’
কিছুদিন আগেও গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের ‘খুনি’, ‘চোর’ প্রভৃতি লিখে বুকে সেঁটে দিয়ে গণমাধ্যমের সামনে হাজির করা হতো। অথচ এটার কোনো আইনগত ভিত্তি ছিল না। পরে আদালতের নির্দেশের পর তা বন্ধ হয়ে যায়। মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার স্বার্থে ২৪ ঘণ্টার বেশি আটকের ব্যাপারেও একটি নির্দেশনা অত্যন্ত প্রয়োজন।

No comments

Powered by Blogger.