গোলাম আযমদের বাঁচাতে তৎপর পাকিস্তানি নেতারা by মেহেদী হাসান

গোলাম আযমের মতো যে জামায়াত নেতারা ১৯৭১ সালে মুক্তিকামী বাংলাদেশিদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষায় কাজ করেছেন, বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার থেকে তাঁদের মুক্ত করাকে নৈতিক দায়িত্ব মনে করছে পাকিস্তানের বিরোধী দলগুলো।
আর এ কারণে গোলাম আযমদের মুক্ত করতে জাতিসংঘ, ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি) এবং পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতাদের যথাসাধ্য ভূমিকা রাখার আহ্বান জানিয়েছেন তাঁরা।
বিষয়টিকে ঢাকার কূটনৈতিক মহল পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সুবিধাবাদীদের কৌশল এবং বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ঠেকানোর অপচেষ্টারই অংশ বলে আখ্যায়িত করেছে। সেখানকার এসব অপতৎপরতার কারণে বাংলাদেশের আরো বেশি সতর্ক হওয়া প্রয়োজন বলে বিশেষজ্ঞদের মত। কারণ পাকিস্তান এ দেশের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিয়ে আগে থেকেই প্রশ্ন তুলে আসছে। এর বিরোধীরা বিদেশে তদবির করে বিচারপ্রক্রিয়া ভণ্ডুল করারও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এর আগে গত মাসে গোলাম আযমদের ফাঁসি না দিতে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এ দেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি পাঠিয়েছেন। পরে ওই দেশটির একটি বেসরকারি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফরকালে মানবতাবিরোধী অপরাধে বিচারের মুখোমুখিদের পক্ষে তদবির করায় দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে উত্তেজনাও সৃষ্টি হয়।
গত সোমবার সাউথ এশিয়ান নিউজ এজেন্সি (সানা) 'অপজিশন ডিমান্ডস অব মিলিটারি, পলিটিক্যাল লিডারশিপ টু ফুলফিল রেসপনসিবিলিটি ফর রিলিজিং গোলাম আযম, আদারস' (সামরিক ও রাজনৈতিক নেতাদের গোলাম আযমসহ অন্যদের মুক্ত করার দায়দায়িত্ব পালন করার দাবি বিরোধীদের) শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। পাকিস্তানের বিরোধী দলগুলো সেখানে বলেছে, গোলাম আযমসহ অন্যরা (বাংলাদেশে বিচারের মুখোমুখি) পাকিস্তানের জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। বাংলাদেশে তাদের বিরুদ্ধে বিচার চলার সময় পাকিস্তান সরকারের নীরবতাকে 'অপরাধ' হিসেবে আখ্যায়িত করে একে 'দুঃখজনক' বলেও আখ্যা দিয়েছে তারা।
পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নেওয়াজের (পিএমএল-এন) চেয়ারম্যান ও মোতামির আলম-এ-ইসলামীর মহাসচিব সিনেটর রাজা জাফর উল হক গত সোমবার সানা নিউজকে বলেন, 'দেশের অখণ্ডতা রক্ষায় যাঁরা নিজেদের বিলিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁদের সাহায্য করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। বাংলাদেশে আটক নেতাদের মুক্তি কেবল করুণার ওপর নির্ভর করতে পারে না।' তিনি বলেন, পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতৃত্বের উচিত, নিজ নিজ অবস্থান থেকে প্রভাব খাটিয়ে গোলাম আযমদের মুক্ত করা। এটিই পাকিস্তানের জনগণের দাবি।
রাজা জাফর উল হক দাবি করেন, রাজনীতিতে ভিন্নমতাবলম্বী হওয়ার কারণেই বাংলাদেশে গোলাম আযমদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জাতিসংঘকে এ বিষয়টি দেখা উচিত।
মানবতাবিরোধী অপরাধে বাংলাদেশে আটক ব্যক্তিদের 'ধর্মীয় দলের নেতা' আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, ওআইসিও তাঁদের মুক্তির প্রয়াস চালাতে পারে। ইসলামী দেশগুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে আটকদের মুক্ত করতে সব ধরনের চেষ্টা চালানো উচিত পাকিস্তানের।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে 'ভারতের ষড়যন্ত্র' হিসেবে আখ্যায়িত করে তিনি আরো বলেন, যেসব বাংলাদেশী নেতা ওই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করেছিলেন, তাঁদের মুক্ত করা আমাদের (পাকিস্তান) সরকারের নৈতিক দায়িত্ব।
জামায়াত-ই-ইসলামী পাকিস্তানের আমির সাইদ মুনওয়ার হাসানও বার্তা সংস্থাটির কাছে গোলাম আযমদের একাত্তরের ভূমিকাকে দেশপ্রেমমূলক দায়িত্ব হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেন, একে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা যায় না। তাঁর দাবি, বাংলাদেশে কারাগারে আটক নেতাদের ইসলামের প্রতি ভালোবাসার জন্য শাস্তি পেতে হচ্ছে।
গোলাম আযমদের মুক্ত করতে পাকিস্তানের জনগণের বিবেক কেন জেগে উঠছে না- এমন প্রশ্নও করেন তিনি। সাইদ মুনওয়ার হাসান মনে করেন, গোলাম আযমরা পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা রক্ষায় দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বলেন, এ বিষয়ে পাকিস্তানের সামরিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনের সবার অবস্থান অভিন্ন।
প্রতিবেদনে মিলি্ল ইয়াকজেতি কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট কাজী হোসাইন আহমেদ বলেন, 'এটা কি মানবাধিকারের বিষয় নয়? রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে এখনই জেগে ওঠা উচিত।'
পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) হামিদ গুল দাবি করেন, বাংলাদেশের ওপর ভারতের প্রভাবের কারণেই গোলাম আযমসহ অন্য নেতারা আজ কারাগারে। তাঁদের মুক্তির জন্য পাকিস্তানের প্রভাবশালী সব মহলের সব ধরনের প্রচেষ্টা চালানো উচিত। এ ব্যাপারে বক্তব্য জানতে যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি। অন্যদিকে পাকিস্তানি কূটনৈতিক সূত্রগুলোও এ ইস্যুতে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানায়।
পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বনের কারণে নয়, মানবতাবিরোধী অপরাধে বিচার হচ্ছে : ঢাকায় কূটনৈতিক সূত্রগুলো গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় কালের কণ্ঠকে বলেন, পাকিস্তানে কী হচ্ছে তা পাকিস্তানের বিষয়। তবে বাংলাদেশের বিষয় নিয়ে সেখানে তৎপরতার কারণে এ দেশের আরো অনেক সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। কারণ পাকিস্তান বিভিন্ন ফোরামে অনানুষ্ঠানিকভাবে এ দেশের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
জাতিসংঘ সংশ্লিষ্ট নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কূটনীতিক বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের বিরোধীরা বিদেশে তদবির করে বিচারপ্রক্রিয়া ভণ্ডুল ও প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে। বিচারের বিরোধীরা অভিযোগ করছেন, পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার পক্ষের ব্যক্তিদের বিচার হচ্ছে। বাংলাদেশ জোর দিয়ে তা প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বনকারীদের নয়, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষ নিয়ে হত্যা, লুট, ধর্ষণের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করেছে বা সংঘটনে সহায়তা করেছে, তাদের বিচারের আওতায় আনার প্রক্রিয়া চলছে। আইন অনুযায়ী স্বচ্ছতার সঙ্গেই তা হচ্ছে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, বাংলাদেশ জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে চলতি মাসে মানবাধিকারবিষয়ক যে প্রতিবেদন উপস্থাপন করবে, তাতেও মানবতাবিরোধী বিচারের ইস্যুটি থাকবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও দায়মুক্তির সংস্কৃতি দূর করতেই এ বিচার হচ্ছে।
বিরোধীদের প্রচারণায় বিভ্রান্ত তুরস্ক : সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের বিরোধীরা এ বিচার ঠেকাতে বাংলাদেশের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টির অংশ হিসেবে গত ৪ ডিসেম্বর তুরস্কে সমাবেশ করেছে। সেখানে বিচারের মুখোমুখি ব্যক্তিদের নিষ্পাপ, ধর্মভীরু ও আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে উল্লেখ করে বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী বিচারকে এ দেশ থেকে ইসলাম ধর্ম নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ওই সমাবেশ ও প্রচারণা স্থানীয় মুসলমানদের মধ্যে প্রভাব ফেলে। পরে তাদেরই এক দল প্রতিনিধি গিয়ে তুরস্কের প্রেসিডেন্টকে বাংলাদেশ সরকারের কাছে এ ব্যাপারে চিঠি লেখার অনুরোধ জানান। এরপর তুরস্কের প্রেসিডেন্টের চিঠি এবং ২০ থেকে ২৪ ডিসেম্বর দেশটির বেসরকারি প্রতিনিধি দলের সফরে বিচারের মুখোমুখিদের পক্ষে তদবিরে দুই দেশের মধ্যে টানাপড়েন সৃষ্টি হয়।
এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, 'তুরস্কেও যারা যুদ্ধাপরাধ করেছিল, তাদের সবাইকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। আর আমাদের এটি তো দেশীয় আইনের অধীন একটি ট্রাইব্যুনাল। আইন অনুযায়ীই বিচার কাজ সম্পন্ন হচ্ছে এবং সে অনুযায়ীই রায় হবে ও রায় কার্যকর হবে। তাই এ বিষয়টি নিয়ে যাতে কোনো ধরনের অস্বচ্ছতা না থাকে, সে ব্যাপারটি নিশ্চিত করার জন্যই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নিয়েছে।'
যুদ্ধাপরাধের বিচারে মুখোমুখিদের ফাঁসি না দিতে তুরস্কের প্রেসিডেন্টের চিঠি প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, 'এ বিষয়টি যেহেতু আমাদের দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল, তাই আমরা মনে করি, খুব সরলভাবে এটা আমাদের পক্ষে দেখা সম্ভব নয়। আর এ কারণেই আমরা আমাদের অবস্থানটি খুব স্পষ্টভাবে তাদের কাছে তুলে ধরেছি।'
তিনি বলেন, 'সারা দেশে ওই চিঠি নিয়ে অনেক প্রতিক্রিয়া হয়েছে। মানুষ দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে বিচারের জন্য আশা নিয়ে অপেক্ষা করেছে। বাংলাদেশের মানুষের আশা, এ বিচার হবে। বিচারে দোষী ব্যক্তির ব্যাপারে বা দোষী সাব্যস্ত হতে পারেন সে রকম ব্যক্তির ব্যাপারে কেউ যাতে সুপারিশ না করেন, খুব স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের মানুষের সেটিই চাওয়া।'
বিচারের পক্ষে আরো প্রচার প্রয়োজন : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় কালের কণ্ঠকে বলেন, পাকিস্তানে কী হচ্ছে, সেটা আমাদের বিবেচ্য নয়। তবে বাংলাদেশ সরকারের উচিত ছিল আরো আগে থেকে সতর্ক হওয়া। যে অপরাধে বিচার হচ্ছে তা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তুলে ধরা এবং প্রচারণা চালানো প্রয়োজন। চার দশক আগের ওই দিনগুলোর চিত্র বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে হবে বলে তিনি মনে করেন।
তিনি বলেন, 'সরকারের প্রচারণা আমরা তেমন দেখছি না। এ কারণে বিরোধী দল, বিশেষ করে জামায়াতের প্রচারণা গুরুত্ব পাচ্ছে। তুরস্কের ক্ষেত্রে আমরা তা দেখেছি।'

No comments

Powered by Blogger.