বিশ্বায়নের কাল- ওয়েস্টমিনস্টার গণতন্ত্রে দলের সম্মেলন মানে কী by কামাল আহমেদ

ব্রিটেনে কোনো রাজনৈতিক দলের জাতীয় সম্মেলনে আমার প্রথম অভিজ্ঞতা ১৯৯৭ সালে, সৈকতশহর ব্রাইটনে অনুষ্ঠিত লেবার পার্টির সম্মেলনে। টনি ব্লেয়ারের নেতৃত্বে লেবার পার্টি ১৮ বছর পর ক্ষমতায় ফিরে আসার মাস পাঁচেকের মাথায় ছিল এই সম্মেলন।
বিবিসি থেকে যে কজন সাংবাদিক ওই সম্মেলনের খবর সংগ্রহের জন্য গিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে ওয়ার্ল্ভ্র সার্ভিসের হয়ে আমিও হাজির ছিলাম, সেখানে পুরো তিন দিন। লেবার পার্টির নেতৃত্বে সে সময়ে ব্লেয়ারের কর্তৃত্ব প্রায় নিরঙ্কুশই বলা চলে। তাঁর অনুসৃত নীতি-কৌশল ও কর্মপরিকল্পনাকে দলের ভেতরে চ্যালেঞ্জ করার মতো কোনো বিকল্পের কথা তখন ছিল সবার কল্পনারও বাইরে। কিন্তু তার পরও দেখলাম, সম্মেলনের অধিবেশনগুলোতে মন্ত্রীরা নিজ নিজ বিভাগের কর্মপরিকল্পনা ও কৌশলের ভালোমন্দ ব্যাখ্যা করে চলেছেন। শেষ দিনে দলের নির্বাহী কমিটির নির্বাচনে দেখা গেল প্রথম বিস্ময়। বামপন্থী আদর্শ ও অর্থনৈতিক নীতি থেকে দলকে মধ্যপন্থী অবস্থানে এনে ‘নিউ লেবার’-এ রূপান্তরের মাধ্যমেই ব্রিটিশ ভোটারদের মন জয় করেছিলেন টনি ব্লেয়ার। কিন্তু সেই নিউ লেবারের মূল কুশলী ব্লেয়ারের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সহযোগী পিটার ম্যান্ডেলসন নির্বাহী কমিটির নির্বাচনে হেরে গেলেন। তাঁকে হারিয়ে দেন কট্টর বামপন্থী গোষ্ঠীর প্রতিনিধি ‘রেড কেন’ নামে অধিক পরিচিত কেন লিভিংস্টোন।
তার পর থেকে ব্রিটেনের প্রধান দুটি দল লেবার ও টোরিদের প্রতিটি জাতীয় সম্মেলনই আমি ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করি। এসব দলের সম্মেলন দেখলে যে কারোরই মনে প্রশ্ন জাগবে, কবে বাংলাদেশের রাজনীতিকেরা এভাবে দলের কর্মী-সমর্থকদের কাছে তাঁদের নীতিমালা এবং কাজকর্মের জন্য জবাবদিহি করবেন। লেবার পার্টির মতোই টোরিদের সম্মেলনেও দেখা যায়, দলীয় প্রধানের পর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পান তিনি, যিনি দলের অর্থনৈতিক নীতিমালার দায়িত্বে থাকেন। অর্থাৎ ক্ষমতাসীন দলের সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর পর অর্থমন্ত্রী আর বিরোধী দলের সম্মেলনে বিরোধী দলের নেতার পর ছায়া অর্থমন্ত্রী। দলগুলোর বার্ষিক সম্মেলনের মৌসুম হচ্ছে সেপ্টেম্বর। দেখা যায়, এপ্রিলে ঘোষিত বাজেটের প্রতিক্রিয়ায় দলের মধ্যে যদি কোনো অসন্তোষ সৃষ্টি হয়, তাহলে সম্মেলনের বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী সম্ভাব্য পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়ে থাকেন।
প্রধান এই দুটি দল ছাড়াও অন্য দলগুলোর বার্ষিক সম্মেলনও সেপ্টেম্বরেই হয়ে থাকে। প্রধান দল দুটির সম্মেলনগুলোর মধ্যে ব্যবধান থাকে এক সপ্তাহের। আর সে কারণে বিরোধী দলের সম্মেলনে বিরোধী ছায়ামন্ত্রীদের তুলে ধরতে হয় সরকারের বিকল্প নীতি। প্রতিবছর এসব নীতি ও কর্মসূচি পর্যালোচনা এবং তার রূপান্তর স্থানীয় সরকারগুলোর নির্বাচন ও উপনির্বাচনে দলীয় ইশতেহারের কাজ করে থাকে। অর্থনৈতিক নীতির পাশাপাশি শিক্ষা, স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র, স্বাস্থ্য, বৈদেশিক সাহায্য—এগুলোর কোনো কিছুই দলীয় সম্মেলনে বিতর্ক থেকে বাদ যায় না। শুধু পার্লামেন্টে জবাবদিহি করলেই মন্ত্রীদের রেহাই নেই, দলীয় ফোরামেও তাঁদের জবাবদিহি করতে হয়। এ ছাড়া প্রতিবছরই ফেব্রুয়ারি মাসে সংক্ষিপ্ত আরেকটি করে সম্মেলন করে এসব দল, যেগুলো বসন্তকালীন সম্মেলন বা স্প্রিং কনফারেন্স নামে পরিচিত।
এসব সম্মেলনের আরও যেসব বিষয় লক্ষণীয়, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে একে ঘিরে গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের ভূমিকা। বিরল ব্যতিক্রম ছাড়া এসব সম্মেলনের পুরোটাই গণমাধ্যমের খবর সংগ্রহ, এমনকি সরাসরি সম্প্রচারের জন্যও উন্মুক্ত থাকে। দলীয় সদস্যদের প্রশ্নের বাইরেও নানা প্রশ্নের জবাব আদায়ে সংবাদকর্মীদের ভূমিকা থাকে দেখার মতো। টোরিঘেঁষা বলে টেলিগ্রাফ বা ডেইলি মেইলকে যেমন লেবার পার্টি বয়কট করে না, তেমনি লেবারঘেঁষা বলে গার্ডিয়ান বা ইনডিপেনডেন্টকে টোরিরাও এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে না।
আর নাগরিক সমাজের অংশগ্রহণ তো অনেকটা উৎসবের মতো। সম্মেলনের দু-এক দিন আগে থেকে শুরু হয় সেমিনার, জনমত জরিপ, তার ফলাফল বিশ্লেষণ ইত্যাদি। দলের ভেতরের ভিন্নমতাবলম্বী ও বিশেষ বিশেষ স্বার্থের প্রতিনিধিত্বকারী গোষ্ঠীগুলোর মত প্রকাশের মঞ্চ হয়ে ওঠে এসব সভা-সেমিনার। দলগুলোর মূল নেতৃত্ব নির্বাচনের বিষয়টি অবশ্য একেবারেই আলাদা। সাধারণত জাতীয় নির্বাচন বা কোনো রাজনৈতিক সংকটের কারণে দলীয় প্রধানেরা সরে দাঁড়াতে বাধ্য হলে তখন শূন্য পদে নির্বাচনের জন্য দীর্ঘ প্রস্তুতি নিয়ে ভোটের মাধ্যমে তা সম্পন্ন করা হয়ে থাকে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায়ই ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নজির টেনে ওয়েস্টমিনস্টার ধাঁচের গণতন্ত্রের কথা বলে থাকেন। ২০১২ সালে লন্ডনে তিনি যে দুটি সফর করেন, তার মধ্যে প্রথমটির সময়ে লেবার পার্টির নেতা ডেভিড মিলিব্যান্ডের সঙ্গে এক বৈঠকে শেখ হাসিনা বলেছিলেন যে লেবার পার্টি আওয়ামী লীগের বন্ধুপ্রতিম দল এবং তার সঙ্গে বন্ধুত্বের ইতিহাস দীর্ঘকালের।
কিন্তু সেই ওয়েস্টমিনস্টার ধাঁচের গণতন্ত্রচর্চায় তাঁর নিজের দল এবং বিরোধী দল বিএনপির রেকর্ডগুলোর তুলনা করা অর্থহীন। কিন্তু দলের জাতীয় সম্মেলনগুলোকে কি আরেকটু গণতান্ত্রিক করা যায় না? আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রথম ও মধ্যম সারির নেতাদের অনেকেই কোনো না কোনোভাবে রাজনৈতিক দলের গণতন্ত্রায়ণ, প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা ও সক্ষমতা অর্জনের প্রশিক্ষণ পেয়েছেন ওয়েস্টমিনস্টার ও ক্যাপিটল হিলের একাধিক প্রকল্পে। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানো, ভোটারদের সঙ্গে জনসংযোগ, জবাবদিহি ইত্যাদি নানা বিষয়ে ওয়েস্টমিনস্টার ফাউন্ডেশন ফর ডেমোক্রেসি ওয়ার্ক, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউট, রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের একাধিক প্রকল্প চালু আছে। আন্তসংসদীয় সহযোগিতা ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ে গত দুই দশকে (নব্বইয়ে গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের পর থেকে) এদের বিদেশ সফরও হয়েছে বহুবার। লেবার পার্টির প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, ২০১০ সালের আগস্ট মাস থেকে তারা বাংলাদেশের তিনটি প্রধান দল—আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির জন্য এ ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতার ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু সেগুলো কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে বলে তো মনে হয় না।
সদ্য অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে যদি অর্থমন্ত্রী দলীয় নেতা-কর্মীদের কাছে তাঁর ‘আমি শেয়ারবাজার বুঝি না’ মন্তব্যের ব্যাখ্যা দিতেন কিংবা তাঁর চোখের সামনে দিয়ে কীভাবে সোনালী ব্যাংকের সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা হল-মার্ক লোপাট করল, ডেসটিনির হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা মোকাবিলায় সময়মতো ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থতা ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর ভাষ্য তুলে ধরে তিনি যদি জাতিকে বাধিত করতেন, তাহলে তাতে কি দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ক্ষতি হতো, না দলটি নিজেকে সংশোধনের সুযোগ পেত? অন্যান্য মন্ত্রী-উপদেষ্টা, যাঁদের নানা কর্মকাণ্ডে দলের ক্ষতি হচ্ছে বলে দলীয় কর্মী-সমর্থকেরা মনে করেন, তাঁদের যদি সম্মেলনে একইভাবে জবাবদিহি করতে হতো, তাহলে নিকট ভবিষ্যতে সরকারের ওপর তার প্রভাব নিশ্চয়ই ইতিবাচক হতো।
বাংলাদেশে কোনো দলই তো প্রতিবছর সম্মেলন করে না। নেতা নির্বাচনের সুযোগও তাদের সামান্যই। বড় নেতাই ঠিক করেন, পরের সারির নেতৃত্বে কে থাকবেন। তার পরের সারির নেতৃত্বও ওই একই নিয়মে ঠিক হয়। সুতরাং, বছরের পর বছর কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে নেতাদের সম্পর্ক থাকে হুকুমদাতার সঙ্গে হুকুম তামিলকারীর। সময়ে সময়ে সভা-সমাবেশে হাজির হওয়া, স্লোগান দেওয়া, চাঁদা তোলা এবং মাঠ দখলে লাঠিয়ালের কাজ করার সম্পর্ক। এই ব্যবস্থার পরিবর্তন না হলে এবং দলের ভেতরে গণতন্ত্রায়ণ না হলে দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তৃণমূলের অংশগ্রহণের সুযোগ কোথায়? দলের ভেতর গণতন্ত্রায়ণ ছাড়া পারিবারিক উত্তরাধিকারের চলমান রাজনৈতিক ধারায় রাজনৈতিক দলের সম্মেলনকে এসব দলের আর দশটা রাজনৈতিক সমাবেশ বা শক্তি প্রদর্শনের মহড়া ছাড়া কি অন্য কিছু বলা চলে?
প্রধান দলগুলোর সম্মেলনকে কেন্দ্র করে নাগরিক সমাজ বা গণমাধ্যমও যেসব বিতর্ক সামনে আনতে পারত, সেই সুযোগটাও কিন্তু কেউ তেমন একটা কাজে লাগাল না। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে কোনো পরিবর্তন ঘটবে এমনটি আসলেই কেউ আশা করেছিলেন বলে মনে হয় না। আর যেহেতু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে কোনো পরিবর্তন নেই, সেহেতু ধরে নেওয়া যায় যে বিএনপিতেও কোনো পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই। অথচ, এই প্রধান দুই দলের নেতৃত্বে কোনো পরিবর্তন ভোটাররা প্রত্যাশা করেন কি না, সেটা যাচাইয়ের জন্য একাধিক জনমত জরিপের সুযোগ ছিল। আর জনমত জরিপের ফল যদি ইঙ্গিতবহ হতো, তাহলে তাকে খুব বেশি দিন উপেক্ষা করা বোধ হয় দলগুলোর পক্ষে সম্ভব হতো না।
একইভাবে বিভিন্ন নীতির বিষয়ে বৃহত্তর বিতর্কের সূচনা করতে পারত বিভিন্ন নাগরিক গোষ্ঠী। বিশেষ করে কয়েক বছর ধরে অনুসৃত সরকারি নীতিমালাগুলোর প্রভাব ও প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে গবেষণামূলক তথ্য-উপাত্ত তুলে এনে বিতর্কের ব্যবস্থা করা হলে তাতে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মত প্রকাশেরও সুযোগ তৈরি হতো। এ ধরনের সামাজিক চাপ ছাড়া রাজনৈতিক দলগুলো নিজে থেকেই জনমুখী সংস্কার করবে, এমনটি আশা করলে সে আশা সম্ভবত অপূর্ণই থেকে যাবে।
লন্ডন
কামাল আহমেদ: প্রথম আলোর লন্ডন প্রতিনিধি।

No comments

Powered by Blogger.