সপরিবারে শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকি নিরপেক্ষ থাকার সময় এটা নয় by মুনতাসীর মামুন

সঙ্কটকালে, এ দেশে সবাই নিরপেক্ষ থাকতে চায়। যারা নিরপেক্ষ থাকতে চায় না, তাদের ভুগতে হয়। সমাজ রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায় থেকে তাদের ‘বহিষ্কার’ করা হয় বা বাদ দেয়া হয়। নিরপেক্ষতার অর্থ বিদ্যমান ব্যবস্থার নীরব সমর্থন। রাজনৈতিক পরিসরে এবং পৃষ্ঠপোষকতায় নিরপেক্ষরা স্থান করে নেয়।
যেমন, এখন বিভিন্ন ইস্যুতে যারা নীরব থাকবেন, পরবর্তীকালে ক্ষমতার বদল হলে তারা বলতে পারবেন, আমরা তো আওয়ামী লীগকে সমর্থন করিনি। একইভাবে যারা বিএনপি সমর্থক বা জামায়াত সমর্থক তারা তাদের আমলে সুযোগ-সুবিধা নেয়ার পর হঠাৎ নিরপেক্ষ হয়ে যান। পরবর্তীকালে তারা একইভাবে আওয়ামী লীগে স্থান করে নিয়ে এবং নীরবে বিএনপি-জামায়াতের পক্ষে কাজ করে যান।
নিরপেক্ষ থাকার সুবিধাটা এই, যে কোন সময় সুযোগ বুঝে যে কোন পক্ষে যাওয়া যায়। বর্তমানে, অনেকের ধারণা, বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে যে সব ইস্যু নিয়ে বিতর্ক চলছে সে সব বিষয় নিয়ে চুপ থাকলে বা সরকারী দল যে সব ইস্যুর পক্ষে সে সব বিষয়ের বিরোধিতা করলেও নিরপেক্ষ প্রমাণ করা যায় নিজেকে। সব দলে এ ধরনের নিরপেক্ষর সংখ্যা কম নয়। আদতে, নিরপেক্ষতা যায় বিএনপি-জামায়াত জোটের পক্ষেই। এভাবে, যাদের মনে করা হয় প্রগতিশীল বা মিডিয়া বা প্রশাসনিক কর্মকর্তারা নিরপেক্ষ থাকছেন। কয়েকটি উদারহণ দেয়া যাক।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট যুদ্ধাপরাধ বিচার না করার দাবি জানিয়েছেন। তুরস্কের ১৪ দলের প্রতিনিধি পরিচয় গোপন করে যুদ্ধাপরাধ বিচারের ট্রাইব্যুনাল পরিদর্শন করে গেছেন। আদতে তারা এসেছিলেন জামায়াতী পৃষ্ঠপোষকতায়। তবে তাদের থেকেও তুরস্কের প্রেসিডেন্টের বিষয়টি ছিল মারাত্মক। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ ব্যাপারে তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। আর প্রতিবাদ জানিয়েছে নির্মূল কমিটি। তুরস্কের প্রেসিডেন্টের চিঠিটি ছিল সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত। বিএনপি সব সময় বলে এসেছে, ভারত সব সময় আমাদের সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ করছে। তারা যুদ্ধাপরাধ বিচারের পক্ষে। কিন্তু, এ চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে তারা কোন কথা বলেনি। প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আওয়ামী লীগ সমর্থক শিক্ষকদের বিরাট গ্রুপ আছে যাদের আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে পৃষ্ঠপোষকতা বিতরণ করে, তারাও নিশ্চুপ। কলামিস্ট, টকশো’র ব্যক্তিবর্গ সবাই নিশ্চুপ। অর্থাৎ নিরপেক্ষ। কেউ বলতে চায়নি, তুরস্কের এ ধরনের বক্তব্য স্বাভাবিক, কারণ তারা গণহত্যার পক্ষে। আর্মেনীয়দের ওপর, কুর্দিদের ওপর তারা গণহত্যা চালিয়েছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর উচিত কুর্দি নেতা ওসলানের মুক্তি দাবি করা। আর যা হোক, তিনিতো মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত নন।
আদালত তো ‘নিরপেক্ষ’ থাকবেই। যেমন ট্রাইব্যুনালে সাকা চৌ মনের সুখে সবাইকে গালাগাল করে, কিন্তু তার বা তার উকিলের কোন শাস্তি হয় না, মৃদু তিরস্কার ছাড়া। সবাই জানে আদালত নিরপেক্ষ। তাই যে সব আবেদনের শুনানি হতে পারে না আইন অনুযায়ী তারও শুনানি চলে। দিনক্ষেপণ হয়Ñযা চায় আসামি পক্ষ আর ক্ষুণœ হয় জনস্বার্থ। কিন্তু সেই নিরপেক্ষতা জনস্বার্থের বিরুদ্ধে গেলে তাকে কি নিরপেক্ষতা বলা যাবে? ন্যাচারাল জাস্টিসকে আমলে না নিয়ে আমাদের দেশের আদালত সামরিক শাসনের পক্ষে, গোলাম আযমের নাগরিকত্বের পক্ষে মত দিয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আসামি পক্ষের প্রতি সদয় থেকেছে নিরপেক্ষতার খাতিরে। চোরাইমাল আদালতে পেশ করে বিচার বানচালের প্রচেষ্টা নিয়েছে আসামিপক্ষ। আদালত নিরপেক্ষতার খাতিরে তারও শুনানি করছে। নির্মূল কমিটি ছাড়া কেউ বলেনি, হ্যাকিং দেশী এবং বিদেশী আইনে অপরাধ। হ্যাকিং করা মালপত্র আদালতে পেশ করা অপরাধ। এ কারণে কোন আসামিপক্ষের প্রতি কারণ দর্শানো হবে না। চোরাইমাল কাগজে ছাপলে সে কাগজ প্রকাশনা কেন বন্ধ হবে না? সাংবাদিকরা সব সময় নাকি এথিকাল প্রশ্ন নিয়ে সোচ্চার, কিন্তু এ ব্যাপারে নিশ্চুপ। কারণ এ বিষয়ে কথা বললে নিরপেক্ষতা ক্ষুণœ হবে। বিচারপতি খায়রুল হক বা বিচারপতি শামসুদ্দীন চৌধুরীর রায় নিয়ে বিতর্ক হয়, কেননা তারা ন্যাচারাল জাস্টিসের পক্ষে, সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে, হ্যাকিংয়ের বিরুদ্ধে রায় দেন। তারা তো ‘নিরপেক্ষ’ হতে পারেন না। যুদ্ধাপরাধ বিচারের রায়ের জন্য সারাদেশের মানুষ অপেক্ষা করছে। কিন্তু সারাদেশের মানুষের ইচ্ছা আকাক্সক্ষা বড় কথা নয়, বিএনপি-জামায়াত কষ্ট পাচ্ছে কিনা তা বিচার্য। বেগম জিয়া যখন বলেন, ঘুষ দিয়ে খায়রুল হকের রায় কেনা হয়েছে, তখন আদালত অবমাননা হয় না। বার কাউন্সিল মনে করে না এ বিষয়ে তাদের বলার কিছু থাকতে পারে। এ বক্তব্যে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কেউ আদালত অবমাননার রুলও জারি করেন না। কারণ সবাই নিরপেক্ষ। শেখ হাসিনা যদি আজ এ ধরনের কোন মন্তব্য করতেন তা হলে আদালতপাড়ায় মিছিল হয়ে যেত। বিচারপতি হকের রায় সিভিল সমাজের পক্ষে, কিন্তু সুজন, সুশীল কেউ বেগম জিয়ার বক্তব্যের প্রতিবাদ করেনি। না, আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবরাও নন। নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে হবে না !
মিডিয়াতো নিরপেক্ষ, কী যেন বলে অবজেকটিভ। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার টকশোতে ভারসাম্য রাখতে হয়। জামায়াত বা যুদ্ধাপরাধ বিচারের ইস্যু নিয়ে আলাপ হলে তারা এই ইস্যুতে ভারসাম্য রাখতে চায়। তারা লেফটি, প্রগতিশীল এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ হিসেবে ‘নিরপেক্ষ’দের আনেন যারা জামায়াত-বিএনপির পক্ষে বক্তব্য প্রচারের সুযোগ পায়। মানবতাবিরোধী অপরাধের স্বচ্ছতা নিয়ে তারা প্রশ্ন তোলে। এভাবে নিরপেক্ষ থেকে মানবতাবিরোধী অপরাধের বা বিএনপি- জামায়াতের পক্ষে প্রচার চলে। পৃথিবীর কোন যুদ্ধাপরাধ/মানবতাবিরোধী অপরাধ, নাজী/ফ্যাসিস্টদের ব্যাপারে মিডিয়া নিরপেক্ষ থাকে না কেননা সেটি অপরাধ বলে বিরোচিত। আমাদের এখানে তা নিরপেক্ষতা ও ভারসাম্য রক্ষা বলে বিবেচিত। এই সরকার কাদের দেখে এত টিভি লাইসেন্স দিয়েছিল?
এ বিষয়ে অনেক কথা বলা যায়। কিন্তু এ বিষয়ে লিখতে আমি বসিনি। আমার বিষয় অন্য। যা লিখলাম তা ভূমিকা হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
কয়েক দিন আগে টিভির নিউজে দেখলাম, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলছেন। সরকার দাবি না মানলে আরেকটি ১৯৭৫ হবে। দৈনিক সমকালে এ সম্পর্কে সংবাদও ছাপা হয়েছে। খন্দকার বলেছেনÑ“সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আবার ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাবা শেখ মুজিবুর রহমানও ১৯৭৫ সালে বাকশাল কায়েম করে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তার সে স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি। এ সরকারও যদি জোর করে ক্ষমতায় থাকতে চায়, তাহলে তাদেরও ’৭৫-এর মতো পরিণতি বহন করতে হবে।” (১.১.১৩)
সরকার জোর করে ক্ষমতায় থাকতে চায় কিনা সেটা বোঝা যাবে তার মেয়াদ শেষ হলে। এখন তা কিভাবে বুঝলেন জনাব খন্দকার? তিনি যেভাবে বক্তব্য রেখেছেন, তাতে মনে হয় ১৯৭৫ সালের মতো ঘটনা ঘটবে বলে তার কাছে নির্দিষ্ট তথ্য আছে। তাহলে সেনাবাহিনীর একটি অংশ কি ১৯৭৫ করার কথা ভাবছে? খন্দকার সেনাবাহিনীকে এক অস্বস্তিকর অবস্থায় ফেলেছেন। কারণ বিএনপি ডিজিএফআইয়ের তৈরি। তাদের নেতা যখন ১৯৭৫-এর কথা বলে তখন নিশ্চয় তাকে এ বিষয়ে তথ্য দেয়া হয়েছে। না হলে খন্দকার এ রকম বলবেন কেন? তিনি তো অজ্ঞমুর্খ নন, শিক্ষকতা করেছেন। উচ্চডিগ্রী আছে। প্রকারান্তরে তিনি শেখ হাসিনা ও তার পরিবার এবং সরকারের কিছু নেতাকে হত্যার হুমকি দিয়েছেন। একজন সভ্যভব্য লোক প্রকাশ্য সভায় এ রকম হুমকি দিতে পারেন। শুনেছি গু-াপা-ারা এ ধরনের হুমকি দিতে পারে রাস্তায়। একজন একুশ শতকের রাজনীবিদ এ কথা বলতে পারেন? তার মানে কি বাইরে এরা স্যুটেড বুটেড, ভেতরে প্রস্তরযুগ? আমরা জানি ১৯৭৫ সাল না হলে বিএনপি হতো না। জনভোটে নির্বাচিত হওয়ার আশা কম দেখে কি খন্দকাররা ১৯৭৫ সালের মতো ক্ষমতায় যেতে চান?
রাজনীতিতে এই উক্তি অগ্রহণযোগ্য, অভব্য, অপরাধের শামিল এবং জঘন্য। রাজনীতিতে চাপান-উতোর থাকবে, কিন্তু কথায় কথায় সপরিবারে শেখ হাসিনাকে হুমকি ভদ্র রাজনীতিতে চলতে পারে না। বিএনপি নেতারা কিন্তু আজকাল প্রায় ১৯৭৫ ঘটানোর কথা বলছেন। কিন্তু কোন টকশোতে, কোন কলামে কেউ এর প্রতিবাদ করেননি। আওয়ামী লীগার ও তাদের সমর্থকরা যারা বঙ্গবন্ধু বলতে অজ্ঞান এবং নেত্রী শব্দ উচ্চারণে যাদের চোখে ভক্তিতে পানি চলে আসে, তারাও বঙ্গবন্ধু কন্যাকে খুন করার হুমকির বিরুদ্ধে রাস্তায় একটি মিছিলও করেনি। সাগর-রুনীর জঘন্য হত্যাকা-ের বিরুদ্ধে ইকবাল সোবহানের নেতৃত্বে আওয়ামী সমর্থক সাংবাদিকরা নিয়ত সমাবেশ করেন, মানববন্ধন করেন, প্রতিবাদ জানান। তাদেরও দেখলাম সপরিবারে শেখ হাসিনাকে খুনের হুমকির ব্যাপারে নিশ্চুপ। তারা সাগর-রুনিকে নিয়ে যতবার মানববন্ধন করেছেন, প্রতিবাদ জানিয়েছেন, সমাবেশ করেছেন তার এক দশমাংশবার যদি ১৯৭১ সালের খুনীদের বিচার ত্বরান্বিত ও তা বানচালের অপচেষ্টার বিরুদ্ধে সমাবেশ, মিছিল, মানববন্ধন করতেন তা হলেও দেশের মানুষ সচেতন হতেন, উজ্জীবিত হতেন। কিন্তু সেটি করলে তো জামায়াতী-বিএনপি সমর্থকরা ক্ষুব্ধ হতে পারে। নিরপেক্ষতা বলে একটা ব্যাপার আছে না?
আমি একজন প্রায় প্রান্তিক মানুষ, সামান্য শিক্ষক ও লেখক, যে নিরস্ত্র এবং যার কোন অর্থ বা পেশি শক্তি নেই। তবুও আর কেউ না হোক, আমি এই জঘন্য উক্তির প্রতিবাদ জানানোর জন্য লিখলাম। আমি ১৯৭৫ সালের ঘটনার ব্যাপারে নিরপেক্ষ থাকতে পারি না। সুশীল, সুজন, সাংবাদিক, ‘রাজনীতিবিদ’দের মতো নিরপেক্ষ না থাকলে, বিএনপি-জামায়াত এলে কি হতে পারে বা আমার পরিণতি জেনেও আমি প্রতিবাদ জানাচ্ছি এই খুনের হুমকির। আরও বলছি, এভাবে খন্দকার মোশাররফরা রাজনীতি কলুষিত করছেন। সে কারণেও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। সভ্য দেশে এ ধরনের অভব্য আচরণ চলতে পারে না। এ ধরনের উক্তি শাস্তিযোগ্য অপরাধের শামিল। এবং এ ক্ষেত্রে যারা নিরপেক্ষ থাকে তারাও অপরাধী।

No comments

Powered by Blogger.