বিএসএফ ভয়ংকর

চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার বিভীষণ সীমান্তে গতকাল বুধবার ভোরে গরু ব্যবসায়ী দুই বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যা করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। এর আগের দিন মঙ্গলবার ভোরে ঠাকুরগাঁও সীমান্তে হত্যা করা হয়েছিল দুই গরু ব্যবসায়ীকে।
এর বাইরে গতকাল বিকেল সাড়ে চারটার দিকে জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলায় বাংলাদেশে ঢুকে খেতে কর্মরত দুই কৃষককে ধরে নিয়ে গেছেন বিএসএফের সদস্যরা। মঙ্গলবার দিবাগত রাতেও লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী সীমান্ত থেকে এক বাংলাদেশিকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল বিএসএফ।
নতুন বছরের শুরুতে সীমান্তে চার বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যা এবং তিনজনকে ধরে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে আবারও নিজেদের ভয়ংকর রূপ প্রকাশ করল বিএসএফ।
এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর সাংবাদিকদের বলেছেন, ভারতের সঙ্গে সমঝোতা অনুযায়ী কেবল আত্মরক্ষার জন্যই গুলি চালানো যেতে পারে। তিনি বলেন, ‘হত্যার ঘটনাগুলো আমরা তদন্ত করছি। যদি দেখা যায়, এটা অন্য কারণে হয়েছে, তাহলে আমরা অবশ্যই যথাবিহিত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলব।’
বিএসএফ দাবি করছে, নিহত ব্যক্তিরা সবাই গরু পাচারকারী ছিলেন। তাঁরা বিএসএফ সদস্যদের ওপর হামলাও চালিয়েছিলেন। তাই আত্মরক্ষার স্বার্থেই গুলি চালানো হয়েছে।
ঢাকার বাইরে প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর:
চাঁপাইনবাবগঞ্জ: চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তে গতকাল নিহত দুই ব্যক্তি হলেন গোমস্তাপুর উপজেলার বিভীষণ গ্রামের মোহাম্মদ মাসুদ (২২) ও জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার তারাপুর-সাহাপাড়া গ্রামের শহীদুল ইসলাম (২৩)।
৪৩ বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) উপ-অধিনায়ক মেজর শরীফ মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল ভোর পাঁচটার দিকে দুই বাংলাদেশিকে বিভীষণ সীমান্তের মেইন পিলার ৪৮ এর ৮ নম্বর সাব পিলার সংলগ্ন এলাকায় গুলি করে হত্যা করা হয়। এ সময় ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলার টিলাসন ক্যাম্পের টহলরত বিএসএফ সদস্যরা গুলি চালিয়েছেন। দুপুরে বিজিবি ও বিএসএফের মধ্যে কোম্পানি কমান্ডার পর্যায়ে পতাকা বৈঠক হয়। বৈঠকে এই হত্যার তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়।
পতাকা বৈঠকে দুই বাংলাদেশির লাশ ফেরত চাওয়া হলে বিএসএফ জানায়, ভারতে ময়নাতদন্ত শেষে আজ বৃহস্পতিবার লাশ ফেরত দেওয়া হবে।
বিকেলে বিভীষণ সীমান্ত পরিদর্শন করেন বিজিবির রাজশাহী সেক্টর কমান্ডার কর্নেল সরকার শামসুদ্দীন। অন্যদিকে বিএসএফের মালদহ সেক্টরের আইজি কে কে শর্মা ও ডিআইজি অমরজিত সিং সীমান্ত পরিদর্শন করেন।
ঠাকুরগাঁও: মঙ্গলবার ভোর সাড়ে চারটার দিকে জেলার হরিপুর উপজেলার বুজরুক সীমান্তের ৩৬১ নম্বর মেইন পিলারের কাছ দিয়ে ভারত থেকে গরু নিয়ে সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া পার হওয়ার সময় বিএসএফ সদস্যরা গুলি করেন। এতে বুজরুক গ্রামের নূর ইসলাম (২৮) ও দেওগাঁও গ্রামের মুক্তার দাই (২৭) নিহত হন। বিএসএফ সদস্যরা তাঁদের লাশ নিয়ে যায়।
বিজিবি ২ ব্যাটালিয়নের অপারেশন কর্মকর্তা মেজর মুনতাসির মামুন সিদ্দিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘মঙ্গলবার বিএসএফের সঙ্গে পতাকা বৈঠকের পর গতকাল নূর ইসলাম ও মুক্তারের লাশ ফেরত দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আমরা এখনো (গতকাল সন্ধ্যা সাতটা) লাশ পাইনি।’
পাটগ্রাম (লালমনিরহাট): বিজিবি ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার দিবাগত রাত দুইটার দিকে ভারতের বাঘবাড়ী এলাকা দিয়ে বুড়িমারী সীমান্তের ৮৩৮ নম্বর মেইন পিলারের কাছ দিয়ে দেশে ঢুকছিলেন বুড়িমারী ইউনিয়নের আদর্শ গ্রামের বাসিন্দা অবতর হোসেন (৪০)। এ সময় ভারতের কোচবিহারের বিএসবাড়ী ক্যাম্পের বিএসএফ সদস্যরা তাঁকে ধরে নিয়ে যান। গতকাল সকালে তাঁকে প্রকাশ্যে নির্যাতন করা হয়।
নির্যাতনের প্রত্যক্ষদর্শী আদর্শ গ্রামের বাসিন্দা বাবলু মিয়া বলেন, আটক অবতরকে সকালে বিএসএফ ক্যাম্পের মাঠে প্রকাশ্যে মারপিটসহ নানাভাবে নির্যাতন করা হয়। ওই দৃশ্য দেখেন বাংলাদেশ সীমান্তসহ ভারতের আশপাশের গ্রামবাসী। এ সময় অনেকে কান্নাকাটিও করেন।
৩১ বিজিবির বুড়িমারী কোম্পানি কমান্ডার জাবিউল ইসলাম বলেন, ‘এক বাংলাদেশিকে আটকের খবর শুনেছি। তবে আটক ব্যক্তির পরিবার কিছু জানায়নি। ফলে তাঁকে ফেরতের জন্য বৈঠক করতে পারিনি।’
জয়পুরহাট ও পাঁচবিবি: এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, গতকাল বেলা সাড়ে চারটার দিকে পাঁচবিবির হাটখোলার পূর্ব উচনা গ্রামের সীমান্তবর্তী ফসলি জমিতে কাজ করছিলেন হাবিল উদ্দিন (২২) ও মজু মিয়া (৪০)। হঠাৎ বিএসএফের সদস্যরা বাংলাদেশে ঢুকে তাঁদের ধরে নিয়ে যান।
জয়পুরহাটে ৩ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক মো. খসরু সাব্বির আলী প্রথম আলোকে বলেন, এ বিষয়ে বিএসএফের ৯৬ ব্যাটালিয়ন সিধাই ক্যাম্পের ক্যাম্প কমান্ডার বরাবর কড়া প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে ওই দুই বাংলাদেশিকে ফেরত দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে। তবে গতকাল রাত আটটা পর্যন্ত দুই বাংলাদেশিকে ফেরত দেওয়া হয়নি।
বিএসএফের দাবি: বিবিসি বাংলা রেডিও জানিয়েছে, চার বাংলাদেশি নিহত হওয়া প্রসঙ্গে পূর্ব ভারতের বিএসএফ-প্রধান বিডি শর্মা তাদের বলেছেন, দুটি ক্ষেত্রেই ভারতীয় সীমানার বেশ কিছুটা ভেতরে পাচারকারীরা ঢুকে পড়েছিলেন। দুই দিনই বিএসএফ সদস্যদের ওপর আক্রমণ চালানো হয়।
গতকালের ঘটনা সম্পর্কে শর্মা দাবি করেছেন, জিরো লাইনের দেড় শ গজ পার করে কাঁটাতারের যে বেড়া রয়েছে, সেটি কেটে এর পাশ দিয়ে যে সীমান্ত সড়ক গেছে, সেই সড়কের একটি কালভার্টের নিচ দিয়ে গরু পাচার করা হচ্ছিল। এ সময় বিএসএফের সদস্যরা বাধা দিলে পাচারকারীরা তাঁদের আক্রমণ করেন। একজন বিএসএফ সদস্যের আঙুল কেটে দেওয়া হয়েছে। তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। একজন বিএসএফ সদস্যকে টেনে সীমান্তের ওপারে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হলে বিএসএফ তখন বাধ্য হয়ে গুলি চালায়।
আর বুধবার যেখানে দুজন বাংলাদেশি নিহত হয়েছিলেন, সে ব্যাপারে বিএসএফের দাবি, সেখানে কাঁটাতারের কোনো বেড়া নেই। তাই পাচারকারীরা সহজেই ভারতীয় সীমান্তে ঢুকে পড়েছিলেন। পাচার করার সময় ২৬টি গরু ধরাও পড়ে। এ সময় পাচারকারীরা বিএসএফের সদস্যদের আক্রমণ করেন। দুটি ঘটনাতেই বাধ্য হয়ে প্রাণ বাঁচাতে গুলি চালিয়েছে বিএসএফ।
বিডি শর্মা দাবি করেন, মারণাস্ত্রের ব্যবহার কমিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং অবৈধ কর্মকাণ্ড আটকাতে নতুন পদ্ধতিও গ্রহণ করা হয়েছে।
রাবার বুলেট, গ্রেনেড ছাড়া সেসব অস্ত্র বিএসএফ বন্দুকের বদলে ব্যবহার করে, সেগুলো খুব কাছে থেকে ব্যবহার করলেও প্রাণহানি ঘটতে পারে বলে স্বীকার করেছেন বিএসএফের কর্মকর্তারা। তা ছাড়া, মরিচ বোমা বা গ্রেনেড বোমা এখনো পরীক্ষামূলক স্তরেই রয়েছে, বিএসএফের হাতে পুরোপুরি আসেনি। তাই গুলি চালাতে হয় বলে তাঁদের দাবি।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া: সীমান্তে হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে মহীউদ্দীন খান আলমগীর বলেন, ‘আমি গত মাসে ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করেছি এবং নীতিগতভাবে একমত হয়েছি যে, সীমান্তে আমরা কোনো পক্ষ থেকেই গুলি চালনা করব না; যদি না আত্মরক্ষার্থে এটার প্রয়োজন হয়। এই সমঝোতার আলোকে গতকাল যে ঘটনা ঘটেছে, সেটা আমরা তদন্ত করে দেখছি। যদি দেখা যায়, আত্মরক্ষার্থে সীমান্তরক্ষীরা গুলি চালাতে বাধ্য হয়েছে, তাহলে সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বিষয়টি বিবেচনা করব। আর যদি দেখা যায়, আত্মরক্ষা নয়, ভিন্নতর কোনো কারণে কিংবা অসাবধানতাবশত বা ইচ্ছেকৃতভাবে এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে, তাহলে আমরা যে পদ্ধতিতে দুই সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছি, সেই পদ্ধতিতেই এ ধরনের ঘটনা যেন আর না ঘটে, সে জন্য তাদের নজরে আনব এবং আমাদের তরফ থেকেও ব্যবস্থা নেব।’
গতকাল মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ২৩তম বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ প্রতিক্রিয়া জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
সমঝোতার পরেও কেন হত্যাকাণ্ড ঘটছে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে যে সমঝোতা হয়, তাতে কেবল আত্মরক্ষার জন্যই গুলি চালানো যেতে পারে বলে দুই সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কারণ, ক্ষেত্র ও সময়বিশেষে দেখা গেছে, চোরাচালানকারীরা নিজেদের রক্ষার জন্য অস্ত্রের আশ্রয় নিয়ে থাকেন।’ তিনি বলেন, ‘হত্যার ঘটনাগুলো আমরা তদন্ত করছি। তদন্ত করে যদি দেখা যায়, এটা অন্য কারণে হয়েছে, তাহলে আমরা অবশ্যই যথাবিহিত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলব।’
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে, ২০১২ সালে সীমান্তে হত্যা ও নির্যাতনের ৩১৯টি ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৪৮ জন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন, আহত হয়েছেন ১০৬ জন, অপহূত হয়েছেন ১৪০ জন। ২০১১ সালে ১৫৫টি সীমান্ত নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছিল। সরকার ও বিজিবির পক্ষ থেকে দফায় দফায় উদ্যোগ নেওয়া হলেও পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না।

No comments

Powered by Blogger.