নাটকের ফাঁদে মেয়েটি-রিমান্ডে ৫, সব রকম সহায়তার আশ্বাস

টাঙ্গাইলের মধুপুরে স্কুলছাত্রীকে গণধর্ষণের অভিযোগে গ্রেপ্তার পাঁচ আসামিকে গতকাল বুধবার রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে, মেয়েটিকে সুস্থ করতে এবং দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু মেয়েটি ওই ঘটনা কিছুতেই ভুলতে পারছে না।
হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে আছে সে। 'নিয়তি'র শিকার মেয়েটির চোখ দিয়ে প্রায়ই গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু।
ডিবি পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, ওই স্কুলছাত্রীর বান্ধবী বীথি আক্তার ইভা বিয়ের কথা বলে তাকে বাড়ি থেকে নিয়ে যায়। কিন্তু উদ্দেশ্য ছিল তাকে দিয়ে নাটক 'নিয়তি'তে অভিনয় করানো।
ডিবির ওসি হুমায়ুন কবীর আকন্দ জানান, টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার কথিত মডেল বীথি আক্তার ইভা, মধুপুরের কুড়িবাড়ী গ্রামের হারুনুর রশিদ, জটাবাড়ী গ্রামের শাহজাহান আলী, আউশনারা ইউনিয়নের বোকারবাইদ গ্রামের এস এম নুরুজ্জামান ওরফে গেদা ও বোয়ালী গ্রামের মনিরুজ্জামান ওরফে মনিরা নাটক নির্মাণ করত। মধুপুরে হারুনের 'সুপ্তি কম্পিউটার' নামে একটি দোকান আছে। আর মনিরুজ্জামান ভিডিওর ব্যবসা করে। ইভা তাদের সঙ্গে নাটকে অভিনয় এবং বিভিন্ন সময়ে মডেলিং করত।
তিনি জানান, ইভার সঙ্গে তাদের গ্রামে ওই স্কুলছাত্রীর পরিচয় হয়। এরপর মিথ্যা কথা বলে নিয়তি নামের একটি নাটক তৈরি করার জন্য ওই ছাত্রীকে মধুপুরে নিয়ে যায় ইভা। প্রথম দিন মধুপুর বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনে (বিএডিসিতে) নাটকের শুটিং করা হয়। নাটকের একটি গানে স্কুলছাত্রীটিকে দিয়ে অভিনয় করানো হয়। রাতে তাকে মধুপুরের আউশনারার ইদিলপুর বোকারবাইদ গ্রামে এস এম নুরুজ্জামানের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। এ বাড়িতেই তাকে চার দিন আটকে রেখে ধর্ষণ করা হয়। পরে ইভা তাকে কালিহাতীর পৌলী রেললাইনের পাশে ফেলে রেখে যায়। সেখান থেকে পরিবারের সদস্যরা তাকে উদ্ধার করে।
ঘটনা আড়ালের চেষ্টা : লোকলজ্জার ভয়ে ধর্ষণের কথা কাউকে বলা থেকে বিরত থাকে মেয়েটি। বাড়ি আসার পর সে ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়ে। একপর্যায়ে পাশবিক নির্যাতনের কথা সে মাকে জানায়। বাড়ির লোকজনও বিষয়টি গোপন করে। দুই দিন পর প্রচণ্ড ব্যথার কারণে তাকে টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালের বহির্বিভাগে নিয়ে যাওয়া হয়। অবস্থার অবনতি হলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ওই স্কুলছাত্রীর বড় ভাই জানান, ২০ ডিসেম্বর ইভা তার বোনকে হাসপাতালে দেখতে আসে। এ সময় তাকে আটক করা হয়। পরে এলাকার লোকজন গ্রামে বিচার বসানোর কথা বলেন।
আসামিরা রিমান্ডে : গ্রেপ্তার করা পাঁচ আসামিকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। গতকাল আসামিদের টাঙ্গাইলের আমলি আদালতে হাজির করে সাত দিনের রিমান্ডের আবেদন করা হয়। ম্যাজিস্ট্রেট জান্নাতুল ফেরদৌস ইবনে হক শুনানি শেষে চারজনকে তিন দিনের এবং ইভার এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। মধুপুর থানার ওসি ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মজিবর রহমান এ তথ্য জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা টাঙ্গাইল জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আতাউর রহমান খান আজাদ ওই ছাত্রীর পরিবারকে আইনগত সহায়তা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন।
বিচারের দাবিতে মানববন্ধন : এদিকে জড়িতদের বিচার দাবিতে গতকাল বিকেলে মধুপুরে মানববন্ধন করেছে জেলা বাস্তবায়ন সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে সর্বস্তরের মানুষ। মানববন্ধন কর্মসূচিতে বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগ নেতা মাসুদ পারভেজ, মধুপুর পৌরসভার প্যানেল মেয়র খন্দকার শামসুল আরেফিন শরীফ, মধুপুর শহীদ স্মৃতি স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ বজলুর রশিদ চুন্নু প্রমুখ। তাঁরা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।
সহায়তা দেবে সরকার : স্কুলছাত্রীর পরিবারকে পুনর্বাসন সহায়তা দেবে সরকার। রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ওই ছাত্রীকে দেখতে গিয়ে গতকাল এ কথা বলেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। তিনি বলেন, মেয়েটির সুস্থ হয়ে ওঠা ও আইনি ব্যবস্থার জন্য যা কিছু করা দরকার সরকারের পক্ষ থেকে তা করা হবে। এমনকি সুচিকিৎসার জন্য যদি তাকে বিদেশে পাঠানোর প্রয়োজন হয়, তবে সে বিষয়ে সরকার ভেবে দেখবে। এ সময় মেয়েটি প্রতিমন্ত্রীর কাছে বাড়ি ফিরে যাওয়ার আকুতি করে।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, ইতিমধ্যে আসামিরা ধরা পড়েছে। তাদের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। দোষীদের সাজা নিশ্চিত করতে সরকার কাজ করবে বলেও জানান তিনি।
বিএডিসি যখন এফডিসি : মধুপুরের বিএডিসিকে বানানো হয়েছিল এফডিসি। সেখানে তারা শুটিং করত। ডিবির ওসি হুমায়ুন কবীর আকন্দ জানান, গ্রেপ্তার বীথি আক্তার ইভা পুলিশকে জানিয়েছে, বিএডিসি তাদের কাছে এফডিসি নামেই পরিচিত। মনোরম পরিবেশের কারণে এখানে শুটিং করা হতো।
একাধিক সূত্রে জানা যায়, মধুপুর বাসস্ট্যান্ডে আরো একটি ভিডিওর দোকান রয়েছে। এ দোকানের লোকজনও জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে নাটক ও মডেলিংয়ের কথা বলে স্কুল-কলেজের ছাত্রীদের নিয়ে আসে। অভিনয়ের নামে তাদের অসামাজিক কাজে বাধ্য করে তারা।

No comments

Powered by Blogger.