যোগাযোগ মন্ত্রণালয়-ব্যর্থতার কালো মেঘে সাফল্য আড়াল by পার্থ সারথি দাস

মহাজোট সরকারের যে কটি মন্ত্রণালয় ব্যর্থতার জন্য বিশেষভাবে আলোচিত তার মধ্যে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় অন্যতম। বারবার মন্ত্রী বদল, পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ, মহাসড়কে নানা বিপর্যয়ের ঘটনায় সরকারের চার বছরের বিভিন্ন সময় মন্ত্রণালয়টি ঘিরে ছিল সমালোচনার ঝড়।
সরকারের 'ক্ষত' হিসেবে এই মন্ত্রণালয়কে এগিয়ে রাখার পক্ষে অনেকেই। একের পর এক বড় বড় প্রকল্প হাতে নিলেও মাঠপর্যায়ে তা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে এ মন্ত্রণালয়। ছোট ছোট সাফল্য তাই ঢাকা পড়ে গেছে বড় বড় ব্যর্থতার আড়ালে। তবে চার বছরের মাথায় বিভিন্ন প্রক্রিয়ার ফাঁদ থেকে শেষ পর্যন্ত মাথা তুলে দাঁড়াতে পেরেছে মেট্রো রেলের মতো বড় স্বপ্ন। অর্থায়ন ও অনুমোদন শেষে এখন এটি বাস্তবায়নের অপেক্ষায়। রাজধানীর উত্তরা থেকে পল্লবী হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত যাবে মেট্রো রেল। প্রকল্পে ব্যয় হবে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা। এতে জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা জাইকা দিচ্ছে ১৬ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। জাইকার সহযোগিতায়ই এই প্রকল্প ছাড়াও তিনটি সেতু সংস্কার ও নির্মাণ প্রকল্প অবশেষে আলোর মুখ দেখছে। বিআরটিএর স্মার্টকার্ড ড্রাইভিং লাইসেন্স চালু, বিআরটিসির বহরে আর্টিকুলেটেড ও দ্বিতল বাস যোগ হওয়ার সাফল্যও দেখিয়েছে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়। যদিও শেষ পর্যন্ত প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতার কারণে গত চার বছরে যোগাযোগ খাতে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের বিভিন্ন অঙ্গীকার ও প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।
দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় দেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প পদ্মা সেতুর কাজ এই সরকারের সময় শুরু হওয়া এখন আর সম্ভব বলে মনে হচ্ছে না। প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকার ক্ষমতায় আসার পরই বিভিন্ন প্রক্রিয়া শুরু হয়। মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তের চারটি পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রস্তুত থাকলেও পরামর্শক নিয়োগে বিশ্বব্যাংকের তোলা দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তদন্ত ও সরকারের একেক সময় একেক সিদ্ধান্তের কারণে প্রকল্পের ভবিষ্যৎ ঝুলে গেছে। এই হাল হয়েছে। অন্যদিকে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া পয়েন্টে দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নির্মাণের পরিকল্পনাও থমকে আছে অর্থায়নের অনিশ্চয়তায়।
জনদুর্ভোগের অন্যতম কারণ যানজট নিরসনে সরকারের নেওয়া বড় বড় সব প্রকল্পও অনিশ্চিত অবস্থায় আছে। সেতু বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিলেও যানজট নিরসনে নেওয়া প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা ব্যয় সাপেক্ষে ঢাকা উড়াল সড়ক প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়েছে। ২০১১ সালের ৩০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী এই প্রকল্পের ভিত্তি স্থাপন করেন। এখন সেই প্রকল্পের নকশা পরিবর্তন করা হচ্ছে। ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের দাবির মুখে নেওয়া ঢাকা-আশুলিয়া উড়াল সড়ক প্রকল্পও ফাইলবন্দি হয়ে আছে। দ্রুত বাস চলাচল পদ্ধতি বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট-বিআরটির সুপারিশ করা হয়েছে কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায়। এই সুপারিশের ভিত্তিতে দুটি রুটে বিআরটি চালুর কাজ গত চার বছরে ধরেই বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। এর মধ্যে বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার বিআরটি প্রকল্প চার বছরেও বাস্তবরূপ পায়নি। দ্রুত বাস চলাচলের এই পদ্ধতিতে পিক আওয়ারে ঘণ্টায় ৪০ হাজার যাত্রী যাতায়াত করতে পারবে এই রুটে। দুই হাজার ৪০ কোটি টাকা ব্যয় হবে প্রকল্পে। অন্যদিকে ২০০৯ সালে প্রক্রিয়া শুরু হলেও সদরঘাট থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত বিআরটি চালুর লক্ষ্যে এখন পর্যন্ত কেবল সমীক্ষার কাজ শেষ হয়েছে।
অবশ্য যানজট নিরসনে নেওয়া বনানী রেলওয়ে ওভারপাসের কাজ নির্ধারিত সময়ের কয়েক মাস আগেই শেষ হয়েছে। গত ২৭ ডিসেম্বর ওভারপাসটি যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।
মহাজোট সরকারের নেতৃত্বে থাকা আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চার লেন প্রকল্প বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করা হয়। চার বছরে এই প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র শতকরা ৩১ ভাগ। ২০১৩ সালের এপ্রিল নাগাদ এই অগ্রগতি শতকরা ৭৩ ভাগ হওয়ার কথা ছিল। সড়ক খাতে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত ৫৩টি প্রকল্পের অন্যতম জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ চার লেন প্রকল্প। ৯০২ কোটি টাকা ব্যয় সাপেক্ষে নেওয়া এই প্রকল্পের চারটি অংশের মধ্যে দুটি অংশের কাজ গত চার বছরে শুরুই হয়নি। কার্যাদেশ দেওয়ার পর জালিয়াতির অভিযোগ ওঠায় প্রকল্পের দুটি অংশের কাজ বন্ধ রয়েছে দুই বছর ধরে। এ ছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত ৫১টি প্রকল্প বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় আটকে আছে। সওজ অধিদপ্তর, পরিকল্পনা কমিশন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে এই প্রকল্পগুলো চার বছরেও লালফিতার বাঁধন থেকে মুক্ত হতে পারেনি। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় চলতি অর্থবছরে ১৪৮টি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। দুর্নীতি, গাফিলতি, অর্থের অভাব, ভূমি অধিগ্রহণে জটিলতাসহ বিভিন্ন কারণে এসব প্রকল্প সময়মতো শেষ হবে কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। সওজ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী আমিনুর রহমান লস্কর এ বিষয়ে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য কাজ করছি। এখন তদারকি জোরদার করা হয়েছে।'
জানা গেছে, যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বড় বড় প্রকল্প নেওয়া হলেও দেশের মহাসড়কগুলোর রক্ষণাবেক্ষণে এই মন্ত্রণালয়ের যথাযথ তদারকি ছিল না। ফলে মহাসড়কে বিপর্যয় নেমে আসে গত বছর। বিতর্কের মুখে সৈয়দ আবুল হোসেনের বিদায়ের পর এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান ওবায়দুল কাদের। দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই তিনি দেশের বিভিন্ন মহাসড়কে ছুটে বেড়িয়েছেন। মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, এক বছর তিনি ৫৯টি জেলা সফর করেছেন। কোনো কোনো জেলায় বারবার গেছেন। কিন্তু বাস্তব অবস্থার উন্নতি সেই গতিতে হতে দেখা যায়নি। সড়ক রক্ষণাবেক্ষণে নেওয়া এক হাজার ৪১০ কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ কাগজে-কলমে গত জুনে শেষ হয়েছে। কিন্তু প্রকল্পের অগ্রগতি প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, প্রকল্পের ৬০ ভাগ কাজ হয়েছে। বাকি ৪০ ভাগ কাজ না করেই প্রকল্প বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী আগামী এপ্রিলের মধ্যে দেশের সব জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কের সংস্কারকাজ শেষ করার কথা রয়েছে। এই সময়ের মধ্যে জেলা সড়কগুলো যান চলাচলের উপযোগী করা হবে। প্যাকেজ কার্যক্রমের আওতায় সারা দেশে ১৫০ কিলোমিটার সড়ক পুনর্বাসন, ৪০০ কিলোমিটার কার্পেটিংসহ সিলকোট, ৮৫০ কিলোমিটার ওভারলে, ১০০ কিলোমিটার ডিবিএসটি, ১৫০০ কিলোমিটার সিলকোট, ১০টি সেতু ও ১১০টি কালভার্ট পুনর্নির্মাণের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিটুমিনের দাম বেড়ে যাওয়ায় এসব কাজ নির্দিষ্ট সময়ে শেষ হবে কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। একই সময়ে নবীনগর-চন্দ্রা সড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ কাজ শেষ হওয়া নিয়েও সংশয় রয়েছে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী বরিশাল-পটুয়াখালী মহাসড়কে পায়রা নদীর ওপর পায়রা সেতু (লেবুখালী সেতু) ও আড়িয়াল খাঁ নদের ওপর সপ্তম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতুর (কাজীরটেক সেতু) নির্মাণকাজও শুরু হয়নি। কাচপুর, মেঘনা ও মেঘনা-গোমতী সেতু সংস্কার ও নির্মাণে জাইকার আর্থিক সহযোগিতার আশ্বাস পাওয়া গেছে। কবে কাজ শুরু হবে তা এখনো নিশ্চিত নয়।
কিছু সাফল্য : গত এক বছরে যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর সংযোগ উড়াল সেতু, রংপুর-কুড়িগ্রাম মহাসড়কে তিস্তা সেতু এবং বান্দরবান জেলায় রুমা ও থানচি সেতু, রংপুর-বদরগঞ্জ-পার্বতীপুর সড়কে যমুনেশ্বরী সেতুসহ বেশ কয়েকটি সেতু, ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের ১১টি, কেরানীরহাট-বান্দরবান সড়কে তিনটি বাঁক ডিভাইডারসহ প্রশস্ত করার কাজ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। এ ছাড়া বাথুলী, মেঘনা সেতু, গোমতী সেতু, সীতাকুণ্ড, ময়নামতি ও মরিচ্যা বাজার এলাকার সড়কে ছয়টি ওভারলোড কন্ট্রোল স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে। মোটরযানের রেট্রো-রিফ্লেক্টিভ নম্বর প্লেট, রেডিও ফ্রিক্যুয়েন্সি আইডেন্টিফিকেশন (আরএফআইডি) ট্যাগ, ডিজিটাল রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট প্রবর্তন করা হয়েছে। ডিজিটাল স্মার্ট কার্ড ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার কাজে গতি আনা হয়েছে। ২০১২ সালের নভেম্বর পর্যন্ত দুই লাখ ৪২ হাজার স্মার্টকার্ড ড্রাইভিং লাইসেন্স বিতরণ করা হয়েছে। বিআরটিসির বহরে যে এক হাজার ৩০৬টি নতুন বাস যুক্ত করার কথা রয়েছে তার মধ্যে ২০১২ সালে ৭৮৪টি বাস কেনা হয়েছে। জানুয়ারিতে আসছে ৫০টি আর্টিকুলেটেড বাস।
মন্ত্রীর কথা : গত ৫ ডিসেম্বর যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের তাঁর দায়িত্ব গ্রহণের বর্ষপূর্তির দিন বলেছেন, দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই দুর্নীতিমুক্ত, স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক কর্মপরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে আমি টিমওয়ার্কের মাধ্যমে কাজ শুরু করি। শুরুতেই আমি কাজের প্রাধিকার নির্ধারণ করি। মন্ত্রণালয়ের কাজে গতিশীলতা আনাসহ অধীনস্থ অধিদপ্তর, কর্তৃপক্ষ ও সংস্থাগুলোর ইমেজ পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হই। আমি বলব না আমরা যতটুকু করেছি তাতে সন্তুষ্ট, তবে জনগণকে আগের তুলনায় কিছুটা স্বস্তি দিতে পেরেছি।

No comments

Powered by Blogger.