চোখ ধাঁধানো দীপ্তিতে ভাস্বর, স্বতন্ত্র এক কৰপথ- হৃদয়ের অকুণ্ঠ অর্ঘ্য দিয়ে যশোরে মধুকবিকে স্মরণ by সাজেদ রহমান

যশোর অফিস 'হলপ করে বলতে পারি, আমি দেখা দেব একটা বিশাল ধূমকেতুর মতো-' বন্ধু রাজনারায়ণ বসুকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তাঁর এই আত্মঘোষণায় খাদ ছিল না। এ চিঠিটি যখন লেখা, তখনই তিনি খ্যাতি-অখ্যাতির তুঙ্গে।
বস্তুত বাংলা সাহিত্যের আকাশে বিরল ও বিশাল এক ধূমকেতুর মতোই আবিভর্াব মাইকেল মধুসূদনের। চোখ ধাঁধানো দীপ্তিতে ভাস্বর, ভিন্নতর গতিপ্রকৃতি, স্বতন্ত্র এক কপথ। নশ্বর দেহটি ধূমকেতুর মতোই দেখা দিয়ে অচিরে মিলিয়ে গেছে, কিন্তু রেখে গেছে চিরস্থায়ী ঔজ্জ্বল্য কীর্তিতে, জীবনে। মধুমেলায় গেলে সেটা সকলের মনে হয়। সাগরদাঁড়ি এখন কবিতীর্থ। মাইকেল মধুসূদন দত্তের ১শ' ৮৬তম জন্মবার্ষিকী সাগরদাঁড়িতে শুরম্ন হয়েছে ৭ দিনব্যাপী মধুমেলা। গত ২২ জানুয়ারি শুরম্ন হওয়া এই মেলা শেষ হবে আজ বৃহস্পতিবার। প্রতি বছর ২৫ জানুয়ারি থেকে মধুমেলা শুরম্ন হলেও মাধ্যমিক পরীার কারণে এবার মেলা শুরম্ন হয় ২২ জানুয়ারি। দিন দিন মেলায় মানুষের সমাগম হচ্ছে বেশি। সাগরদাঁড়ি ইনস্টিটিউশন মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠের মধুমঞ্চে প্রতিদিন বিষয়ভিত্তিক আলোচনাসভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নাটক, উন্মুক্ত যাত্রাপালা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এছাড়া জারি, অষ্টক, পালাগান, ঢোল বাদনসহ বাঙালী সংস্কৃতি ও লোকজ অনুষ্ঠানও হচ্ছে প্রতিদিন। রয়েছে কৃষিমেলা, সার্কাস, নাগরদোলা, জাদু প্রদর্শনী, মৃতু্যকূপ। এসব দেখতে মেলায় প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ আসছেন দূর-দূরানত্ম থেকে। মেলার এবারই প্রথম একদিন শিশু ও কবি সমাবেশের আয়োজন করা হয়। সেদিন মেলায় শত শত শিশুর সমাগম হয়।
মধুমেলায় কি নেই? প্রায় ৩শ' স্টলেই রয়েছে গৃহস্থালিতে ব্যবহৃত সবধরনের জিনিস। ম-া মিঠাই থেকে শুরম্ন করে ফার্নিচার, রকমারি পান। মেলার বাইরের রাসত্মায় পসরা সাজিয়ে বসেছে হকাররা। বুধবার মেলায় বড়দের পাশাপাশি শিশুদের ভিড় ছিল লণীয়। এছাড়া ছিল বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা। মেলা উপল েপ্রতিবছর স্কুল-কলেজ থেকে ছাত্রছাত্রীরা শিা সফর কিংবা পিকনিক করতে আসে এখানে। বুধবার মেলায় এসেছে মাগুরার শালিখা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৭ম শ্রেণীর ছাত্রী সায়লা খাতুন। তার ছোট ভাইয়ের জন্য মেলা থেকে কিনেছে বাঁশি, মুখোশসহ অন্যান্য খেলার জিনিস। এছাড়া ঘুরে ঘুরে দেখেছে মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাড়ি। এবারই প্রথম মেলায় আসায় তার খুব ভাল লাগছে বলে জানাল সে। মেলাকে প্রাণবনত্ম করতে সবকিছু করা হয়েছে বলে জানালেন মেলা উদযাপন কমিটির সদস্য সচিব ও কেশবপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহিদা সুলতানা। মেলার প্যান্ডেলের ভেতর অশস্নীল নৃত্য বন্ধ করা হয়েছে। এজন্য ১৫টি প্যান্ডেল ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। খ্রীস্টান ধর্ম গ্রহণ করার জন্য যিনি বাড়িতে প্রবেশ করতে পারেননি, কপোতা নদে নৌকায় কয়েকদিন কাটিয়ে আবার ফিরে যান কলকাতা। বাংলা সাহিত্যের সেই মহাত্তম কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তকে আজ গাঁয়ের সকল মানুষ স্মরণ করেন। ছোট শিশুরা এসে এখানে কবির সমাধি খোঁজেন। অনেকে জানেন না, মধুকবির সমাধি কলকাতার পার্ক সার্কাস এলাকায়। তাঁর বংশধররা আছেন এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। তাঁদের অনেকে বাংলা ভাষাই জানেন না। সাহেব হতে গিয়েও মধুকবি কিন্তু শেষ পর্যনত্ম সবকিছু ছাপিয়ে বাঙালী হয়ে উঠেছিলেন। মৃতু্যর মাত্র এক বছর আগে ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে ঢাকার পোগেজ স্কুলে দেয়া এক সংবর্ধনার জবাবে তিনি বলেছিলেন, 'আমি বাঙাল। আমার বাটি যশোহর।' যশোরে সাগরদাঁড়ি তাঁকে ত্যাগ করলেও সেদিন তিনি জন্মভূমিকে ত্যাগ করেননি। যার ঋণ সবাই আজ পরিশোধ করছেন হৃদয়ের অকুণ্ঠ অর্ঘ্য দিয়ে।

No comments

Powered by Blogger.