আমার পুলাডি আর নাই আর নাই’

‘আমার পুলাডি আর নাই, আর নাই। আল্লাহ আমার একটা পুলারে দিয়া গেলে কী ক্ষতি হইত।’  দুই ছেলেকে হারিয়ে এভাবেই বিলাপ করছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের কাইতলা গ্রামের সাজেদা বেগম। দুই ছেলের ছবি বুকে নিয়ে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন।
বাহরাইনের রাজধানী মানামায় গত শুক্রবার অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যাওয়া ১১ বাংলাদেশির দুজনই সাজেদার ছেলে। তাঁরা হলেন স্বপন মিয়া (২৫) ও সাইফুল ইসলাম (২০)। ওই অগ্নিকাণ্ডে নবীনগর উপজেলার আরও তিনজন নিহত হয়েছেন। তাঁরা হলেন: কাইতলা ইউনিয়নের গোয়ালী গ্রামের জসিম উদ্দিন, বিটঘর ইউনিয়নের গুড়িগ্রামের আবুল বাশারের ছেলে আনোয়ার হোসেন (২৫) এবং নাটঘর ইউনিয়নের খড়িয়ালা গ্রামের জারু মিয়া (৩৫)।
গোয়ালী গ্রামে গিয়ে দেখা যায় জসিমের বাড়িতে মানুষের প্রচণ্ড ভিড়। কারও সান্ত্বনাই থামাতে পারছিল না তাঁর মা-বোনের কান্না। তাঁর মা সাহানা বেগম ছেলেকে হারিয়ে পাগলপ্রায়। জসিমের বোন মিনা বেগম বিলাপ করে বলছিলেন, ‘আমার ভাইয়ের কথা আমি কেমনে ভুলোম গো মা। তারে ছাড়া কেমনে বাঁচোম।’ মিনা বেগম সাংবাদিকদের জানান, দুই ভাই এবং দুই বোনের মধ্যে জসিম ছিলেন সবার ছোট। জসিমের সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয় বৃহস্পতিবার রাতে। তখন জসিম জানিয়েছিলেন, দ্বিতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী ছেলে নাজমুলকে তিনি ঢাকায় পড়াবেন। যত টাকাই লাগুক ছেলেকে উচ্চশিক্ষিত করবেন। খোঁজ নিয়েছিলেন পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ুয়া মেয়ে নাদিয়ারও। ‘এখন সব স্বপ্নই শেষ। কে দেখবে ভাইয়ের ছেলেমেয়েদের।’ বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন মিনা বেগম।
নিহত স্বপন ও সাইফুলের বড় ভাই সুমন মিয়া জানান, বছর চারেক আগে বাহরাইন যান স্বপন। কয়েক মাস আগে দেশে ফিরে দোকান ও দুটি জমি বন্ধক দিয়ে বাহরাইন পাঠান ছোট ভাই সাইফুলকে। নিজেও আবার যান। কথা ছিল দেশে ফিরে পাকা ঘর তুলবেন তাঁরা। কিন্তু তা আর হলো না।
নিহত আনোয়ার ও জারুর বাড়িতেও চলছে মাতম। জারু মিয়ার ভাই মজনু মিয়া জানান, অনেক স্বপ্ন নিয়ে জারুকে চার লাখ টাকা দিয়ে বিদেশি পাঠানো হয়েছিল। এখন সব স্বপ্ন অন্ধকারে।
কাইতলার ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান ও নাটঘর ইউপির চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবির মুঠোফোনে প্রথম আলোকে জানান, নিহত পাঁচজনের বাড়িতে গতকাল সকাল থেকে মাতম চলছে।
বাহরাইন থেকে চার বছর পর আগামী ২০ জানুয়ারি দেশে ফেরার কথা ছিল চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার বাথুয়া গ্রামের মাহবুবুল আলমের (৫০)। গত শুক্রবার টেলিফোনে পরিবারের সদস্যদের জানিয়েছিলেন সেই কথা। স্ত্রী-সন্তানদের কাছ থেকে জেনে নিয়েছিলেন কার জন্য কী আনতে হবে। কিন্তু আর দেশে ফেরা হলো না মাহবুবুলের। ওই অগ্নিকাণ্ডে তিনিও প্রাণ হারিয়েছেন। এ ঘটনায় চট্টগ্রামের আরও দুজন নিহত হয়েছেন। তাঁরা হলেন: পটিয়া উপজেলার নাপিতাপাড়ার আবদুল আজিজের ছেলে মো. জামাল এবং বোয়ালখালী উপজেলার চরখিজির পাড়ার ছগীর আহমদের ছেলে নাজির আহমেদ।
এ ছাড়া ওই দুর্ঘটনায় মারা গেছেন নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীর ওসমান গনি। তিনি উপজেলার কাশিপুর গ্রামের আবদুর রহিমের ছেলে।
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নবীনগর ও পটিয়া (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি এবং নোয়াখালী অফিস]

No comments

Powered by Blogger.