আমাকে ছুঁইয়ো না...হরেক নাম, বিশ্ব জুড়ে কৌতূহল- লাজুক লতা লজ্জাবতী

সবুজ ছোট্ট পাতাগুলো খুবই মজার। এতই লাজুক যে সামান্য ছুঁয়ে দিলেই বুজে যায়। ফের মেলে ওঠে। গোলাপীর মিশ্রণে বেগুনী রঙের ফুল ফুটলে মিটিমিটি করে তাকায়।
সমতলের মাটিতে কোন ফসলের মধ্যে, ঝাউবনে, ঝোপঝাড়ে, নদী তীরে, কাশবনে অনাদরে বেড়ে উঠে বিছিয়ে যায় এই গাছ। গ্রামের মেঠোপথ ধরে হাঁটলে ধারেই দেখা মেলে। শহরের সবুজ চত্বরের কোথাও না কোথাও চোখে পড়ে। এক সময় এই গাছ দেখলে শিশু-কিশোরদের কাজই হতো সব গাছে আঙুল ছুঁয়ে পাতা বুজিয়ে দেয়া। এতেই ছিল অপার আনন্দ। তবে গাছের ক্ষতি হতো না। কেউ কৌতূহলী হয়ে বুজে থাকা পাতার দিকে তাকিয়ে থাকত কখন ফের মেলে। এই পাতা কখন মেলে, তা টের পাওয়া সহজ নয়। এভাবেই বুঝি এই গাছটির নাম হয়েছে লজ্জাবতী।
প্রবীণ ও মধ্যবয়সীরা লজ্জাবতী নাম শোনার সঙ্গেই অতীতে ফিরে গিয়ে এবং মনে মনে বলবেন, শিশুকালে কতবার যে এই গাছের পাতা বুজিয়ে দিয়েছি...। এই গাছ কি এখন সহসা চোখে পড়ে, আগে যেমন পথে বের হলেই দেখা মিলত! বেশিরভাগেরই সম্ভাব্য উত্তর- না। এর অন্যতম কারণ, শহরে ও গ্রামে এই গাছের বেড়ে ওঠার পথ রুদ্ধ হয়েছে। গ্রামে এখন প্রকৃতির ঘাসই মেলে না। ঘাসের আবাদ করতে হয়। গো-চারণভূমি যেখানে কমে গিয়েছে সেখানে লজ্জাবতীর আবাস আর টেকে কেমন করে, এমন মন্তব্য বগুড়ার রানীরপাড়া গ্রামের প্রবীণ কৃষক আজাহার উদ্দিনের।
ঘাস প্রজাতির গাছ লজ্জাবতীকে নিয়ে বিশ্বজুড়েই আছে নানা কৌতূহল। কোথাও এই গাছ ক্ষতিকর, কোথাও এই গাছের আছে বহুমুখী উপকারিতা। বিশেষ করে কৃষি ক্ষেত্রে উপকারিতা সবচেয়ে বেশি, যা প্রকৃতিই এই গাছের মধ্যে দিয়েছে। বিশ্বের দেশে দেশে এই গাছের আছে মজার অনেক নাম। বগুড়া কৃষি বিভাগের উদ্যানতত্ত্ববিদ মাসুদুর রহমান জানালেন, লজ্জাবতীর উৎপত্তিস্থল দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকায়। বৈজ্ঞানিক নাম ‘মাইমোসা পুডিকা’। ব্রাজিল, কোস্টারিকা, আর্জেন্টিনা হয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। গাছের চেয়ে ঘাস হিসেবেই এর পরিচিতি বেশি।
সেনসেটিভ প্ল্যান্ট (স্পর্শকাতর উদ্ভিদ) নামে এর যাত্রা শুরু হয়ে বর্তমানে যে যেভাবে পেরেছে নামকরণ করেছে। স্পর্শেই পাতা বুজে যায় বলে নামকরণ হয়েছে করপত্রাঞ্জলি। করজোড়ে মিনতি করার পাতা। ইংরেজীতে ‘হাম্বল প্ল্যান্ট’। কেউ নাম দিয়েছে ঘুমন্ত পাতা (শ্লিপিং লিফ)। রোমান্টিক নাম লাজুক লতা (সেমফুল প্ল্যান্ট)। আরেকটি রোমান্টিকতার নাম ‘টাচ মি নট’ (আমাকে ছুঁয়ো না)। কেউ বলে পিপীলিকা (এ্যান্ট) গাছ। এইসব ইংরেজী নামের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশেও এর নানা নাম। যেমন ইন্দোনেশিয়ায় নাম পুত্রি মালু, বাংলা অর্থ লাজুক রাজকন্যা। হিন্দী ও উর্দুতে নাম ‘ছুই মুই’। ওয়েস্ট ইন্ডিজে নাম মিছেমিছি মরা। ফিলিপিন্সে নাম লাজুক হিয়া। যত নামই থাক এর সঙ্গে লাজুক শব্দটি আছেই। আবার অনেক লজ্জাবতীর লাজ লজ্জা বেশ কম। এরা পুরো পাতা না বুজে একটু বোজার মতো করেই ফের মেলে যায়। লজ্জাবতীর পাতা কেন বুজে যায়Ñ এ বিষয়ে উদ্যানতত্ত্ববিদ মাসুদুর রহমান বললেন, প্রকৃতি এই গাছকে এই ক্ষমতা দিয়েছে, যা সাধারণ চোখে মনে হবে বুজে যাওয়া। বিজ্ঞানের ব্যাখ্যায় তা এ রকম- লতায় স্পর্শ করার সঙ্গেই স্টিমুলেটিং কেমিক্যাল সিক্রেশনে পটাশিয়াম আয়ন সৃষ্টি করে, যা পাতার মধ্যে ওয়াটার ভেকল বের করে দেয়। ওয়াটার ডিফিউজ সেল সঙ্কুচিত হয়ে গেলে জোড়ায় জোড়ায় পাতা বুজে যায়। অর্থাৎ রাসায়নিক ক্ষরণে কোষ থেকে পানি বের হয়ে যাওয়ার সঙ্গেই কোষের ক্রিয়া শক্তি হঠাৎ লোপ পেয়ে এক পাতা থেকে আরেক পাতা বুজে পায়। মিনিটখানেকের মধ্যে পূর্বাবস্থায় ফিরে আসে। বিজ্ঞানীরা বলছেন লজ্জাবতী শত্রু থেকে রক্ষা পেতে বা শত্রুর বিরুদ্ধে লড়তে এই পন্থা কাজে লাগিয়েছে। পাতার এমন অবস্থা দেখে পোকামাকড়, অন্য প্রাণী লজ্জাবতী থেকে দূরে সরে যায়। বিশেষ করে সাপ লজ্জাবতীর আশপাশে যায় না। এ ছাড়াও লজ্জাবতীর উল্টো করা কাঁটা তাকে রক্ষা করে। লজ্জাবতী টিকে থাকার জন্য এসব গুণ জিন থেকেই অর্জন করেছে।
মাসুদুর রহমান বললেন, লজ্জাবতী এভাবেই টিকে থেকে কৃষি ক্ষেত্রে বড় অবদান রাখছে। এর শিকড়ে এক ধরনের গুটি ব্যাকটেরিয়ার সৃষ্টি হয়। এই গুটি বাতাস থেকে নাইট্রোজেন নিয়ে শক্তিশালী করে। এই নাইট্রোজেন উন্নতমানের সার। জৈবপন্থার এই নাইট্রোজেন ফসলের সবুজ সার হিসেবে ব্যবহার হয়। একই সঙ্গে এর শিকড় পানি সংরক্ষণ করে জমিকে উর্বর করে রাখে। তিনি বললেন কৃষি বিভাগের বগুড়া হর্টিকালচারে থাই লজ্জাবতী গাছের চারা আছে। এই জাতের লজ্জাবতীর লজ্জা কম। পাতা সহজে বোজে না। তবে সার হিসেবে উন্নতমানের।
লজ্জাবতীর এসব গুণাগুণ আবার সব দেশে সমানও নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই দ্বীপের লজ্জাবতীকে পশুখাদ্যের জন্য টক্সিক হিসেবে বলা হয়েছে। কোথাও বলা হয়েছে ক্ষতিকর ঘাস। অনেক দেশে লজ্জাবতীকে ব্যবহারের জন্য নিষেধ করা হয়েছে। তবে ঘাস হিসেবে রেখে সৌন্দর্যের ফুল ফোটানোর জন্য টিকিয়ে রাখতে বলা হয়েছে। অনেকে বাড়ির টবে লজ্জাবতীর চারা লাগিয়ে ফুল ফোটায়। গ্রীষ্মের মধ্যভাগে এই ফুল ফোটে। অনেক সময় শীতের শেষেও ফোটে। লজ্জাবতীর পাতা যতই বুজুক এর রোমান্টিকতা অন্য রকম। মধুময় প্রণয়ে লজ্জাবতী কাছে থাকলে লাজুক লতা অনেকদূর এগিয়ে নেয়।

No comments

Powered by Blogger.