কেমন আছেন চা শ্রমিকরা ১ ॥ আট ঘণ্টা খেটে মেলে ৪৫ থেকে ৫৫ টাকা, মানবেতর জীবন- সব মৌলিক নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত ॥ নারী-পুরুষ মজুরি বৈষম্য

দিন যায় দিন আসে। সময়ের আবর্তে পাল্টায় অনেক কিছুই। শুধু পাল্টায় না দেশের চা শ্রমিকদের জীবনচিত্র। তাদের দিকে মুখ তুলে তাকান না ভাগ্যদেবী। মজুরি বৈষম্যসহ ছুটিহীন, অস্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ ও নিরাপত্তাহীনতায় দিন পার করতে হয় বাগানের সাধারণ শ্রমিকদের।
শিক্ষা, চিকিৎসাসহ অন্যান্য নাগরিক অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত এই গোষ্ঠীটি। ফলে তারা সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে। এসব অমানবিক জীবনযাপনের মধ্য দিয়েও তারা তাদের শ্রমের বিনিময়ে দেশের অর্থনীতির ভিত শক্ত করার ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা রেখে আসছে। একদিকে মালিকপক্ষের অধিক মুনাফা অর্জন, অন্যদিকে ন্যায্যবঞ্চিত শ্রমিকদের উর্ধমূল্যের বাজারে টিকে থাকতে দিতে হচ্ছে জীবনযাপনের চরম মূল্য। এদেশে ব্রিটিশদের শিখিয়ে যাওয়া চায়ের অভ্যাস বর্তমানে বাঙালী জাতির এখন অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে। প্রতিদিন সকালে কিংবা কাজের ফাঁকে এক কাপ চা না হলে যেন দিনই কাটে না! ১৮৪০ সালে এদেশে বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু হওয়ার পর একপর্যায়ে এ খাতটি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু উৎপাদনের তুলনায় দশ গুণ বেশি অভ্যন্তরীণ চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এখন দেশ চা আমদানি নির্ভর হয়ে পড়েছে।
দেশের মানুষের কাছে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠা এ চা শিল্পের বিকাশে যাদের অবদান সবচেয়ে বেশি সেই চা শ্রমিকরাই খেয়ে না খেয়ে বেঁচে আছেন! মানবেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন দেশের লাখ লাখ চা শ্রমিক। আট ঘন্টার বেশি সময় খেটে এ পেশার লাখ লাখ শ্রমিক বেতন পান ক্ষেত্র বিশেষে দিনে কেবল ৪৫ থেকে ৫৫ টাকা করে! এর মধ্যেই পরিবার পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত তারা।
পাহাড়ী জঞ্জাল পরিষ্কার করা, রাস্তাঘাট ও গৃহ নির্মাণ, আগাছা পরিষ্কার করা, পাতা তোলা ও ফ্যাক্টরিতে কাজ করার জন্য প্রয়োজন হয় হাজারো শ্রমিক। এসব শ্রমিক বছরের পর বছর স্বাস্থ্য, পুষ্টি, পরিবার পরিকল্পনা, পানীয় জলের অভাব, শিক্ষাসহ সব ধরনের মৌলিক নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। সম্প্রতি ইউনিসেফের সহযোগিতায় বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) আয়োজিত ‘শিশু ও নারী উন্নয়নে যোগাযোগ কার্যক্রম (চতুর্থ পর্যায়) প্রকল্পে’র আওতায় মৌলভীবাজার চা বাগানে এক সরেজমিন ভ্রমণে এমন চিত্রই উঠে আসে।
জেলার ৯২টি চা বাগানে কাজ করেন হাজারো শ্রমিক। পৌর সংলগ্ন প্রেমনগর চা বাগানে গিয়ে দেখা যায়, বাগানে নানান ধরনের কাজে ব্যস্ত নারী-পুরুষ শ্রমিকরা। শ্রমিকদের অধিকাংশই নারী। শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের আট ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে দাঁড়িয়ে কাটাতে হয়। প্রতিদিন তীব্র দাবদাহ অথবা ঘনবর্ষণ মাথায় নিয়ে কাজ করে থাকেন তারা। অস্থায়ী শ্রমিকরা প্রতি কেজি চা তোলার জন্য পান দুই টাকা আর স্থায়ী শ্রমিকরা সকাল-সন্ধ্যা কাজ করে সারাদিনে ৫৫ টাকা বেতন পান।
তাঁরা জানান, দিনে ২০-২৫ কেজির বেশি পাতা তোলা সম্ভব হয় না। সেক্ষেত্রে তাঁরা সর্বসাকুল্যে ৪০-৫০ টাকা আয় করতে পারেন। বর্তমান বাজারে এই টাকায় সংসার চালানো দুঃসাধ্য ব্যাপারে দাঁড়িয়েছে। একবার খেলে আরেক বার উপোস করে কাটান শ্রমিক পরিবারের সদস্যরা!
পাশাপাশি রেশন ও বাসস্থানের সুযোগ থাকলেও তা খুবই নগণ্য বলে জানালেন কর্মরত শ্রমিকরা। তাদের পূর্বপুরুষরা এ কাজ করতেন আর তাঁরাও অন্য কোন কাজ শিখেননি বলে এত অল্প পারিশ্রমিক পেয়েও কাজ করে যাচ্ছেন।
শ্রম আইন অনুযায়ী, ৯০ দিনের মধ্যে শ্রমিকদের চাকরি স্থায়ী করার কথা। কিন্তু বছরের পর বছর অস্থায়ীভাবে চাকরি করে যাচ্ছেন এমন শ্রমিকেরও দেখা পাওয়া যায় বাগানে। এদের মধ্যে অধিকাংশই নারী শ্রমিক। তারা মজুরির ক্ষেত্রেও পুরুষের সমান পরিশ্রম করে বৈষম্যের শিকার হন। এছাড়াও তাঁরা পান না রেশন, প্রভিডেন্ট ফান্ড কিংবা বেতনসমেত ছুটি। মালিক পক্ষ বছরের পর বছর তাদের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে যাচ্ছেন।
চা শ্রমিক অর্ডিন্যান্স-১৯৬২ ও চা শ্রমিক আইন-১৯৭৭ মতে শ্রমিকদের যেসব সুযোগ সুবিধা পাওয়ার কথা বাস্তবে তার সিকি ভাগও দেখা যায় না। আবাসন সঙ্কট এই চা শ্রমিকদের অন্যতম সমস্যা। খড়ের ছাউনি, কাদা-মাটির তৈরি এই বাড়িগুলোতে আসবাবপত্রের কোন বালাই নেই। ২০০৬ সালে প্রণীত নতুন শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরি ধার্য করা হয় ১ হাজার ৬০০ টাকা। কিন্তু চা বাগান মালিকরা এই আইন অনুযায়ী বেতন দিতে অসম্মতি জানালে ২০০৮ সালের জুলাইয়ে শ্রম কল্যাণ মন্ত্রণালয় এ আইনকে চা বাগান শ্রমিকদের আওতামুক্ত করে দেয়।
২০০৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর চা সংসদ ও চা শ্রমিক ইউনিয়নের বৈঠকে চা শ্রমিকদের মজুরি ৪৮ টাকায় উন্নীত করা হয়েছিল। একই বছরে চা-শ্রমিকদের জন্য পৃথক মজুরি বোর্ড গঠন করা হয় কিন্তু বাস্তবে তার কোন কার্যক্রম নেই বলে দাবি করেন শ্রমিকরা।
২০১১ সালের ১১ ডিসেম্বর মৌলভীবাজারের ১৮টি চা বাগানের শ্রমিকরা তাদের বিভিন্ন দাবি দাওয়া তুলে ধরে আন্দোলন শুরু করে। কিন্তু এ আন্দোলনের ফল দাঁড়ায় দৈনিক মজুরি সাত টাকা বৃদ্ধি। ৪৮ টাকা থেকে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৫৫ টাকায়। গত বছরের ১ জুলাই থেকে এ নতুন মজুরি নির্ধারিত হয়। কিন্তু এটুকুর বাস্তবায়ন নিয়েও হেলাফেলা করে মালিকপক্ষ। এ নিয়ে এখনও ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে শ্রমিকদের মাঝে। এর আগে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন এবং মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ চা বোর্ডের মধ্যে শ্রমিকদের মজুরি নিয়ে আলোচনায় বসার কথা থাকলেও তা মালিকপক্ষ তা বাস্তবায়নে কোন আগ্রহ প্রকাশ করেনি।

No comments

Powered by Blogger.