শর্তসাপেৰে পুঁজি বাজারে সরাসরি তালিকাভুক্তি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের- নীতিনির্ধারকদের নতুন ভাবনা by রাজু আহমেদ

পুঁজিবাজারে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের সরাসরি তালিকাভুক্তি নিয়ে নতুন করে ভাবছেন নীতি-নির্ধারকরা। এর আগে সরাসরি তালিকাভুক্তি বন্ধের সিদ্ধানত্ম নিলেও বাজারে বিদ্যমান শেয়ার সঙ্কট কাটাতে এখন শর্তসাপেৰে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের জন্য ওই সুযোগ খোলা রাখার পৰে অবস্থান নিয়েছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)।
বিক্রিত শেয়ার থেকে অর্জিত আয় কোম্পানির উন্নয়নে কাজে লাগানো কিংবা নতুন প্রতিষ্ঠানে বিনিয়েগের শর্তে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের সরাসরি তালিকাভুক্তির সুযোগ বহাল রাখার প্রসত্মাব করেছে ডিএসই। এ বিষয়ে ইতোমধ্যেই সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) সঙ্গে দুই শেয়ার বাজারের শীর্ষ কর্মকর্তারা আলোচনা করেছেন বলে সংশিস্নষ্ট সূত্রে জানা গেছে। ডিএসইর প্রসত্মাবিত শর্ত মেনে কোন প্রতিষ্ঠান সরাসরি তালিকাভুক্ত হলে বাজারে শেয়ার সঙ্কট নিরসনে ভূমিকা রাখবে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
জানা গেছে, ২০০৬ সালের ১২ এপ্রিল ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (সরাসরি তালিকাভুক্তি) বিধি জারি করে পুঁজিবাজারে সরাসরি তালিকাভুক্তির সুযোগ তৈরি করা হয়। ওই বিধি অনুযায়ী ১০ কোটি টাকার বেশি পরিশোধিত মূলধন থাকলে যে কোন কোম্পানি পুঁজিবাজারে সরাসরি তালিকাভুক্তির আবেদন করতে পারবে। তবে ওই কোম্পানির কোনো পুঞ্জীভূত লোকসান থাকতে পারবে না। পাশাপাশি কোম্পানিটিকে কমপৰে ৫ বছর ধরে উৎপাদনে থাকতে হবে এবং এই সময়ের মধ্যে কমপৰে তিন বছর মুনাফা অর্জন করতে হবে।
সরাসরি তালিকাভুক্তির সুযোগ সৃষ্টির পর প্রথম অবস্থায় সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকেই এই সুযোগ দেয়া হয়। মূলত সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুঁজিবাজারে নিয়ে আসার সহজ পথ তৈরির উদ্দেশ্যেই এ প্রক্রিয়া চালু করা হয়। তবে এ সংক্রানত্ম বিধিতে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের জন্য সরাসরি তালিকাভুক্তির সুযোগ বন্ধ করা হয়নি। সরাসরি তালিকাভুক্তির মাধ্যমে সর্বপ্রথম ২০০৬ সালের ১৮ মে পুঁজিবাজারে আসে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)। ২০০৭ সালে সরাসরি তালিকাভুক্ত হয় যমুনা অয়েল ও মেঘনা পেট্রোলিয়াম। পরের বছর সরকারী মালিকানাধীন তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির পাশাপাশি প্রথবারের মতো কোন বেসরকারী প্রতিষ্ঠানকে এই সুযোগ দেয়া হয়। বেসরকারী কোম্পানির মধ্যে সর্বপ্রথম সরাসরি তালিকাভুক্ত হয় শাইনপুকুর সিরামিকস লিমিটেড। এরপর এসিআই ফমর্ুলেশন লিমিটেড একই পদ্ধতিতে বাজারে আসে। পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ঢাকা ইলেকট্রিসিটি সাপস্নাই কোম্পানিকে (ডেসকো) তালিকাভুক্ত করা হয়।
সর্বশেষ ২০০৯ সালের ৩০ আগস্ট বেসরকারী প্রতিষ্ঠান নাভানা সিএনজি লিমিটেড সরাসরি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। মূলত এই কোম্পানির শেয়ার ছাড়ার পরই সরাসরি তালিকাভুক্তি নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হয়। লেনদেন শুরম্নর পর মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে কোম্পানির পরিচালকরা তাদের হাতে থাকা ১ কোটি ৮১ লাখ ৫০ হাজার শেয়ার বিক্রি হয়ে যায়_ যার অভিহিত মূল্য ছিল ১৮ কোটি ১৫ লাখ টাকা। কিন্তু ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের প্রতিটি শেয়ার সর্বনিম্ন ১৯০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২৭০ টাকায় লেনদেন হওয়ায় নাভানা ্িসএনজির পরিচালকরা বাজার থেকে প্রায় ৩৬০ কোটি টাকা তুলে নেয়ার সুযোগ পান। সরাসরি তালিকাভুক্তির মাধ্যমে মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে পুঁজিবাজার থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ উত্তোলনের ঘটনায় চোখ কপালে ওঠে বাজার সংশিস্নষ্টদের। এর পরই বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের সরাসরি তালিকাভুক্তির বিরম্নদ্ধে অবস্থান নেয় ডিএসইসহ অনেক বাজার বিশেস্নষক।
তাদের যুক্তি ছিল, বিদ্যমান ব্যবস্থায় সরাসরি তালিকাভুক্তির মাধ্যমে সংশিস্নষ্ট কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন বৃদ্ধি পায় না। কোম্পানির উদ্যোক্তাদের কাছে থাকা শেয়ারের একাংশ বিক্রি করা হয়। ফলে ওই শেয়ার বিক্রি করে অর্জিত অর্থ কোম্পানির উন্নয়নে ব্যয় হয় না। পুরো টাকাই পরিচালকদের ব্যক্তিগত হিসাবে চলে যায়। ফলে শেয়ারহোল্ডাররা কোনভাবেই এই অর্থ থেকে লাভবান হতে পারেন না। অন্যদিকে, সরকারী প্রতিষ্ঠান সরাসরি তালিকাভুক্ত হলে শেয়ারবাজার থেকে সংগৃহীত অর্থ সরকারী কোষাগারে জমা হয়_ যা পরবর্তীতে দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন ও জনকল্যাণে ব্যয় হয়। এতে অভিহিত মূল্যের অতিরিক্ত অর্থ কোন ব্যক্তির পকেটে যায় না। এ কারণে পুঁজিবাজারের ভারসাম্য ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রৰা এবং কোম্পানির সম্পদ মূল্যের সঙ্গে শেয়ারের দরের সমতা বজায় রাখার যুক্তি দেখিয়ে গত ৮ সেপ্টেম্বর ডিএসই বেসরকারী কোন কোম্পানিকে সরাসরি তালিকাভুক্ত না করার নীতিগত সিদ্ধানত্ম নেয়। পরে এসইসির কাছে এ সংক্রানত্ম প্রসত্মাব পাঠানো হয়। তবে ডিএসইর সিদ্ধানত্মের সঙ্গে একমত না হয়ে ওশন কন্টেনার নামে একটি বেসরকারী কোম্পানিকে সরাসরি তালিকাভুক্ত করে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই)।
গত ৫ নবেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ে শেয়ারবাজার বিষয়ে অনুষ্ঠিত একটি বৈঠকে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের সরাসরি তালিকাভুক্তি বন্ধের সুপারিশ করা হয়। কিন্তু ১০ নবেম্বর এসইসির পরামর্শক কমিটির সভায় ওই সুযোগ বহাল রাখার পৰে মতামত দেয়া হয়। তাঁদের মতে, এসইসি সূত্র জানায়, সরাসরি তালিকাভুক্তির সুযোগ বন্ধ করা হলে উদ্যোক্তারা পুঁজিবাজারের প্রতি উৎসাহ হারাতে পারে। এ কারণে এ পর্যনত্ম সরাসরি তালিকাভুক্তির বিধানে কোন পরিবর্তন করেনি এসইসি। এরই মধ্যে ২৫ নবেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের সরাসরি তালিকাভুক্তির সুযোগ বন্ধের সুপারিশ করা হয়। এরপর ১৪ ডিসেম্বর ডিএসই এবং সিএসইর যৌথ কমিটি সভায় বিষয়টি নিয়ে পরবর্তী আলোচনার সিদ্ধানত্ম হয়। মূলত সিএসইর বিরোধিতার কারণেই ডিএসই তাদের সিদ্ধানত্ম থেকে পিছিয়ে যায় বলে সংশিস্নষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
গত কিছুদিন ধরে শেয়ারবাজারে ধারাবাহিক উর্ধমুখী প্রবণতা এবং চাহিদার তুলনায় শেয়ার সরবরাহ কম থাকার কারণে আবারও আলোচনায় এসেছে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের সরাসরি তালিকাভুক্তির বিষয়টি। এর আগে এই প্রক্রিয়া বন্ধের সিদ্ধানত্ম নিলেও এখন ওই অবস্থান থেকে পিছিয়ে এসেছে ডিএসই।
ডিএসই সভাপতি রকিবুর রহমান এ বিষয়ে বলেন, শেয়ারবাজার থেকে সংগৃহীত অর্থ কোম্পানির উন্নয়নে ব্যয় কিংবা নতুন কোন কোম্পানি প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যয় করা হলে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানকে সরাসরি তালিকাভুক্তির সুযোগ দেয়া যেতে পারে। তবে আগের মতো উন্মুক্ত প্রসত্মাবনার মাধ্যমে দর নির্ধারণের পরিবর্তে বুকবিল্ডিং পদ্ধতিতে শেয়ারের মূল্য নির্ধারণ করতে হবে। তা ছাড়া সংগৃহীত অর্থে নতুন কোম্পানি করা হলেও ওই কোম্পানিকেও পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তি বাধ্যতামূলক করতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.