জার্সিরও অবসর!

ফুটবলার অবসরে গেলেন তো অবসরে তাঁর জার্সিও। স্বীকৃতি জানানোর এটাও একটা উপায় বিখ্যাত খেলোয়াড়দের সম্মান জানানোটা উত্তর আমেরিকায়, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের একটি রীতি। যেখানে প্রতিটি দলেরই আছে ‘হল অব ফেম’। যেখানে অন্তর্ভুক্ত করে সম্মান জানানো হয় সেসব দলের কিংবদন্তিদের।
অবসর নেওয়ার পর স্বীকৃতি হিসেবে তাঁদের জার্সিটাকেও দেওয়া হয় অবসর। আর এ কারণেই আর কখনো শিকাগো বুলসের হয়ে ২৩ নম্বর জার্সিটা গায়ে তুলবেন না অন্য কেউ। এই জার্সিটা যে পরতেন বাস্কেটবল মহাতারকা মাইকেল জর্ডান।
যুক্তরাষ্ট্রের এই রীতিটাই এখন ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বজুড়ে, অন্য খেলায়। একসময় ফুটবলে ১ থেকে ১১ নম্বর পরার বাধ্যবাধকতা ছিল। সেই বাধ্যবাধকতাটা উঠে যাওয়ার পরই ফুটবল অঙ্গনও নায়কদের সম্মান জানাতে আলিঙ্গন করেছে এই রীতিটার।
দলের প্রতি প্রশ্নাতীত আনুগত্য, বছরের পর বছর দলের সুখ-দুঃখের সাথি হয়ে থাকা, অর্থের লোভ সামলে এক ক্লাবে পড়ে থাকা অনেক ফুটবলারকেই বসিয়েছে নায়কের আসনে। সমর্থকদের অকুণ্ঠ ভালোবাসা তো আছেই। এই আনুগত্যের আনুষ্ঠানিক প্রতিদানও পেয়েছেন অনেক ফুটবল মহাতারকাই। ইতালির ডিফেন্ডার ফ্রাঙ্কো বারেসির কথাই ধরা যাক। ২০ বছরের ক্যারিয়ারের পুরোটাই এসি মিলানে কাটিয়েছেন ইতালির হয়ে ৮২টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা এই ফুটবলার। ১৯৯৭ সালে অবসরের পর থেকে এসি মিলানের কারও গায়ে আর ওঠেনি বারেসির ৬ নম্বর জার্সিটা। জার্সিটাকে অবসরে পাঠিয়েই ক্লাবের জন্য বারেসির অবদানের স্বীকৃতিটা দেয় রোজোনেরিরা।
ঠিক এক যুগ পর ওই এসি মিলানই অবসরে পাঠাল ৩ নম্বর জার্সিটাকেও। এবারের সম্মানটা পাওলো মালদিনির জন্য। ফ্রাঙ্কো বারেসির উত্তরসূরি মালদিনি মিলানের হয়ে জিতেছেন সম্ভাব্য প্রায় সব শিরোপাই। একেবারে ছোটবেলা থেকেই এসি মিলানকে ঘরবাড়ি বানিয়ে ফেলা মালদিনি হয়ে উঠেছিলেন ক্লাবটির প্রতীক। যে কারণে ২০০৫ সালের জানুয়ারিতেই ক্লাবটির ভাইস প্রেসিডেন্ট আদ্রিয়ানো গ্যালিয়ানি ঘোষণা করে দেন, ‘পাওলোই আমাদের ক্লাবের ইতিহাস। সে যখন ক্যারিয়ার শেষ করবে, আমরা তাঁর জার্সিটা তুলে রাখব।’
সেটা রাখাও হয়েছে। আপ্লুত মালদিনি স্বীকার করেছেন, একদিন এই সম্মান পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাটা তাঁর মনে সব সময়ই ছিল। ২০০৯ সালে তাঁর অবসরের সঙ্গী হয় ৩ নম্বর জার্সিটাও। তবে মিলান মালদিনির জার্সিটা চিরতরে উঠিয়ে রাখেনি। ভবিষ্যতে মালদিনির কোনো ছেলে যদি মিলানে মূল দলে জায়গা করে নিতে পারে, তবে তাঁর গায়েই উঠবে ৩ নম্বর জার্সি।
একই শহরের ক্লাব ইন্টার ৩ নম্বর জার্সিটা তুলে রেখেছে আরও আগেই। এই নম্বরের জার্সি গায়েই নেরাজ্জুরিদের হয়ে মাঠ মাতাতেন ২০০৬ সালে প্রয়াত জিয়াচিন্তো ফাচেত্তি। ১৯৬১ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত ইন্টারের পক্ষে ৬৩৪টি ম্যাচ খেলেছেন অনেকের চোখেই সর্বকালের সেরা এই ডিফেন্ডার। চারটি সিরি ‘আ’ ও দুটি ইউরোপিয়ান কাপ জয়ী ফুলব্যাক ছিলেন ১৯৭০ বিশ্বকাপের ইতালি দলেও।
সিরি ‘আ’তে এই সম্মান পেয়েছেন রোমার ব্রাজিলিয়ান ডিফেন্ডার আলদাইর ও ক্যালিয়ারির গিগি রিভাও। ব্রাজিলের ১৯৯৪ বিশ্বকাপজয়ী সদস্য আলদাইর পরতেন ৬ নম্বর জার্সি আর রিভা ১১ নম্বর। আলদাইর রোমার ডিফেন্সে খেলেছেন ১৩ বছর। স্ট্রাইকার রিভা ক্যালিয়ারিতে খেলেছেন ১৪ বছর। একই ক্লাবে অনেক দিন ধরে খেলার পুরস্কার পেয়েছেন এই সম্মান। কিন্তু রবার্তো বাজ্জো তা পেয়েছেন ব্রেসিয়াতে মাত্র চার বছর কাটিয়েই।
১৯৯৩ সালে ব্যালন ডি’অর ও ফিফার বর্ষসেরা ফুটবলারের স্বীকৃতি পাওয়া এই ইতালিয়ান ক্যারিয়ারের পড়ন্ত বেলাতেই এসেছিলেন ব্রেসিয়াতে। ২০০০ সালে ইন্টার মিলান ছেড়ে ব্রেসিয়াতে এসেই ক্লাবটির ইতিহাস পাল্টে দিয়েছিলেন দীর্ঘ ১৬ বছর জাতীয় দলে খেলা এই স্ট্রাইকার। তাঁর ডিভাইন পনিটেলের ছোঁয়াতেই কিনা বদলে গিয়েছিল ক্লাবটি। সিরি ‘আ’তে টিকে থাকতেই হিমশিম খাওয়া ক্লাবটি জায়গা করে নিয়েছিল উয়েফা কাপেও। ২০০৪ সালে ব্রেসিয়ার হয়েই ক্যারিয়ারের ইতি টানা বাজ্জো পরতেন ১২ নম্বর জার্সি। বাজ্জোর বিদায়ের পর পুরোনো রূপে ফেরা ক্লাবটি সিরি ‘আ’ থেকে অবনমিত হয় পরের মৌসুমেই।
বাজ্জোর বিদায়ের বছর দশেক আগেই এই সম্মান পেয়েছেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা। তাঁর সম্মানে ১০ নম্বর জার্সিটা তুলে রাখে দক্ষিণ ইতালির ক্লাব নাপোলি। নেপলসের ক্লাবটির জন্য তো আর কম করেননি ম্যারাডোনা। নাপোলির মতো অখ্যাত ফুটবল ক্লাবকে বিশ্বজুড়ে পরিচিত করিয়েছেন তিনি। ক্লাবটির শোকেসে থাকা দুটি সিরি ‘আ’ ট্রফি, একটি উয়েফা কাপই যে ম্যারাডোনার বাঁ পায়ের জাদুতে আসা। ১৯৯১ সালে ম্যারাডোনার বিদায়ের পর বিস্মৃতির অন্ধকারে হারিয়ে যেতে সময় লাগেনি ইতালিয়ান ক্লাবটির। যদিও সম্প্রতি আবার পরিণত হয়েছে সমীহজাগানো দলে।
ম্যারাডোনাকে সম্মান জানিয়েছে আর্জেন্টিনাও। একান্ত বাধ্য না হলে জাতীয় বা যুব দলে কাউকে দেওয়া হয় না ১০ নম্বর জার্সিটা। ফিফা টুর্নামেন্টে ১ থেকে ২৩ নম্বর জার্সি থাকার বাধ্যবাধকতা থাকায় ১০ নম্বরটা কাউকে না কাউকে দিতেই হয়। তবে আর্জেন্টিনা মনে হয় সব ধরনের আন্তর্জাতিক ম্যাচেই ১০ নম্বর জার্সি পরার যোগ্য একজনকে পেয়েই গেছে। ম্যারাডোনার উত্তরসূরি হিসেবে টানা চারবারের ফিফা বর্ষসেরা ফুটবলার লিওনেল মেসি ছাড়া আর কাকেই বা বেশি মানাত!
তবে ব্রাজিলের ফুটবল কিংবদন্তি পেলেকে এই সম্মানটা পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছে অনেক দিন। ১৮ বছরের ক্যারিয়ারে সান্তোসের হয়ে হাজারের ওপর গোল করলেও ব্রাজিলিয়ান ক্লাবটি সব সময়ই কাউকে না কাউকে দিয়ে গেছে ১০ নম্বর জার্সিটা। তবে পেলেকে এই সম্মান দিয়েছে কসমস ক্লাব। ক্যারিয়ারের পড়ন্ত বেলায় নিউইয়র্কের এই ক্লাবে মাত্র দুই বছর খেললেও পেলের সঙ্গেই অবসরে গেছে তাঁর বিখ্যাত ১০ নম্বর জার্সি।
মালদিনি-ম্যারাডোনারা সম্মানটা পেয়েছেন দলের প্রতি নিবেদন বা সাফল্যে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে। কিন্তু এমন অনেকে আছেন, যাঁরা এই সম্মানটা পেয়েছেন ঘটনাচক্রে। এঁদের বেশির ভাগই খুব অল্প বয়সেই পৃথিবীর মায়া কাটিয়েছেন। ক্লাবগুলো ভোলেনি তাঁদের।
২০০৩ সালে ফিফা কনফেডারেশন কাপের সেমিফাইনালে ক্যামেরুন-কলম্বিয়ার ম্যাচের সময় হূদেরাগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান মার্ক-ভিভিয়ান ফো। ক্যামেরুনিয়ান এই ফুটবলারের সম্মানে ফ্রান্সের দু্ই ক্লাব লেসঁ ও লিঁও ১৭ নম্বর এবং ইংলিশ ক্লাব ম্যানচেস্টার সিটি ২৩ নম্বর জার্সিটা তুলে রাখে। ক্যারিয়ারের কোনো না কোনো পর্যায়ে এই তিনটি ক্লাবেই খেলেছেন ফো। একই ধরনের মর্মান্তিক ঘটনায় শিয়োভো, ব্রেসিয়া, সেভিয়া ও এসপানিওল চিরতরে তুলে রেখেছে ৩০, ১৩, ১৬ ও ২১ নম্বর জার্সি। এই নম্বরের জার্সি পরেই যে খেলতেন অকালেই ঝরে পড়া জেসন মেইল, ভিত্তোরিয়া মেরো, আন্তোনিও পুয়ের্তো ও দানি জার্ক।
অনেক ক্লাবই সমর্থকদের দেখে দ্বাদশ খেলোয়াড় হিসেবে। মাঠের বাইরে থেকে কম অনুপ্রেরণা তো এঁরা জোগান না। তাই ফেনেরবাচে, লেসঁ, ফেইনুর্দ, পোর্টসমাউথ, নরউইচ সিটি, মালমো ও জেনিতের মতো ক্লাবগুলোর ১২ নম্বর জার্সিটা তোলা সমর্থকদের জন্যই।
ওয়েবসাইট অবলম্বনে
মোহাম্মদ সোলায়মান

No comments

Powered by Blogger.