পৌর নির্বাচন-ঝিনাইদহ ও রামগড়ে নির্বাচন বাতিল-সাভার ও পরশুরামের ইউনএও প্রত্যাহার

সহিংসতার কারণে ঝিনাইদহ এবং মনোনয়নপত্র জমা দিতে বাধা দেওয়ার অভিযোগে রামগড় পৌরসভার নির্বাচনের তফসিল বাতিল করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
এ ছাড়া পক্ষপাতিত্ব এবং প্রভাব বিস্তারের অভিযোগে সাভার ও পরশুরামের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (পৌর নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তা) বদলির জন্য সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে নির্দেশনা পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি। ফেনী জেলা প্রশাসককেও সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। গতকাল রবিবার কমিশনের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানান নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনী অপরাধের কারণে পৌরসভা নির্বাচন বাতিলের ঘটনা এটাই প্রথম। এদিকে হাইকোর্ট গাইবান্ধার সৈয়দপুর পৌরসভা নির্বাচন এক মাসের জন্য স্থগিত করেছেন।
এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, �বিদ্যমান পরিস্থিতি নির্বাচনের জন্য সন্তোষজনক না হওয়ায় ঝিনাইদহ জেলার সদর পৌরসভা এবং খাগড়াছড়ির রামগড় পৌরসভার নির্বাচনের তফসিল বাতিল করা হয়েছে। পরে এ দুই পৌরসভা নির্বাচনের নতুন তফসিল দেওয়া হবে।� তিনি জানান, ঝিনাইদহ পৌরসভায় নির্বাচনী সংঘর্ষে তিনজন নিহত হওয়ার ঘটনা সম্পর্কে স্থানীয় জেলা প্রশাসন, পুলিশ ও ইসির নিজস্ব কর্মকর্তার কাছে প্রতিবেদন চাওয়া হয়েছে।
এদিকে একটি অস্ত্র মামলায় সাত বছরের সাজাপ্রাপ্ত সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক পৌরসভার কাউন্সিলর পদপ্রার্থী মো. ইরাজ মিয়াকে বৈধ প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ দিতে নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। এ ছাড়া আদালত গাইবান্ধার সৈয়দপুর পৌরসভা নির্বাচন এক মাসের জন্য স্থগিত করেছেন। পাশাপাশি ওই পৌরসভার ভোটার তালিকায় আটকে পড়া পাকিস্তানিদের নাম অন্তর্ভুক্ত করাকে কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তিন সপ্তাহের মধ্যে তার কারণ জানাতে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
হাইকোর্টের পৃথক দুটি বেঞ্চ গতকাল পৃথক দুটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ আদেশ দেন। ছাতক পৌরসভার কাউন্সিলর পদপ্রার্থী মো. ইরাজ মিয়ার ক্ষেত্রে বিচারপতি মো. মিফতাহ্ উদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেনের বেঞ্চ এবং সৈয়দপুর পৌরসভার ক্ষেত্রে বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেনের বেঞ্চ আদেশ দেন। সৈয়দপুর পৌরসভার বাসিন্দা অ্যাডভোকেট আরিফুন্নাহার এবং ছাতক পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদপ্রার্থী ইরাজ মিয়া পৃথকভাবে এ রিট করেছিলেন।
কমিশন সচিবালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, সাভারের ইউএনওকে প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত হয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া পৌরসভায় নিকটা�ীয় প্রার্থীর প্রচারণায় অংশ নেওয়ার অভিযোগে।
আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি জানান, আখাউড়া পৌরসভার মেয়র পদপ্রার্থী মো. মোবারক হোসেন রতনের পক্ষে গত বুধবার রাতে পৌরশহরের তারাগণ গ্রামের এক জনসমাবেশে ভোট চান তাঁর ভাই সাভারের ইউএনও মো. রাব্বি মিয়া। এর আগেও তাঁর বিরুদ্ধে এ ধরনের নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর অভিযোগ উঠেছিল। ইউএনও রাব্বি মিয়া ভাইয়ের পক্ষে ভোট চাওয়ার সময় ছবি তুলতে গেলে �বাংলাদেশ প্রতিদিন�-এর আখাউড়া প্রতিনিধি সমীর চক্রবর্তীকে আটক করে একটি ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়। পরে তিনি ছাড়া পান।
ফেনীর পরশুরাম সদর পৌরসভার মেয়র পদপ্রার্থী আবু তালেব গত ২৬ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশনের কাছে এক অভিযোগপত্রে জানান, প্রধানমন্ত্রীর সাবেক প্রটোকল অফিসার আলাউদ্দিন চৌধুরী নাসিমের নাম ভাঙিয়ে তাঁর চাচাতো ভাই মেয়র পদপ্রার্থী নিজাম উদ্দিন চৌধুরী সজল প্রশাসনকে ব্যবহার করছেন। গত ১০ ডিসেম্বর সজলের বাড়িতে তাঁর সঙ্গে জেলার তিন উপজেলা চেয়ারম্যান, জেলা প্রশাসক (পৌর নির্বাচনের আপিল কর্তৃপক্ষ), উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (নির্মল কান্তি চাকমা, পদাধিকারবলে রিটার্নিং অফিসার) ও ওসি বৈঠক করেছেন। সজলের পক্ষে বৈঠকে কেন্দ্র দখলের পরিকল্পনা নেওয়া হয় বলেও অভিযোগ করেন প্রার্থী তালেব। তিনি বলেন, কমপক্ষে ছয়টি ভোটকেন্দ্র বহিরাগত ৬০০ ভাড়াটে সন্ত্রাসী দিয়ে দখল করা এবং যেখানে তাঁর সমর্থন কম, সেসব কেন্দ্রে ভোটারদের যেতে বাধা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বৈঠকে।
আবু তালেব অভিযোগপত্রে আরো বলেন, �২৫ ডিসেম্বর পরশুরামের একটি কমিউনিটি সেন্টারে কেন্দ্রীয় যুবলীগ সদস্য খায়রুল বাশার তপন আমাদের নির্বাচন কর্মকাণ্ড প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছেন। এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ জানানো হলেও তাঁরা নিজেদের অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন। এ অবস্থায় বর্তমান প্রশাসনকে দিয়ে কোনোভাবেই পরশুরাম পৌরসভার নির্বাচন সম্ভব নয়।�
ধারণা করা হচ্ছে, এ অভিযোগের কারণেই পরশুরামের ইউএনওকে প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং ফেনীর জেলা প্রশাসককে সতর্ক করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন এর আগে অসৌজন্যমূলক আচরণের কারণে রাউজান ও কুষ্টিয়ার মিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে প্রত্যাহারের নির্দেশ দেয়।
যে কারণে রামগড়ের নির্বাচন বাতিল : গত ২২ ডিসেম্বর খাগড়াছড়ির রামগড় পৌরসভার মো. শহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী কাজী শাহজাহান রিপন ও তাঁর সমর্থকদের হামলা ও হুমকি এবং সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং অফিসারের অসহযোগিতার কারণে তিনি মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেননি। পুলিশের উপিস্থিতিতেই তাঁর লোকজনের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। প্রায় একই অভিযোগ ওই পৌরসভার অপর প্রার্থী বাবু প্রবীণ চন্দ্র চাকমার।
আমাদের খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি জানান, খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক আনিস উল হক ভুইয়া গতকাল বিকেলে রামগড়ের নির্বাচন বাতিলের চিঠি হাতে পাওয়ার কথা নিশ্চিত করেছেন। এদিকে নির্বাচনী তফসিল বাতিলের আগেই রামগড় পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদে তিন প্রার্থীর মধ্যে দুজন আবু তাহের (বিএনপি-সমীরন গ্র�প) ও রফিকুল ইসলাম প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন। ফলে আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী কাজী শাহাজাহান রিপনের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল।
ঝিনাইদহে প্রতিক্রিয়া : আমাদের ঝিনাইদহ প্রতিনিধি জানান, ঝিনাইদহ পৌরসভার নির্বাচন স্থগিত ঘোষণা করার খবরে প্রার্থীসহ কিছু রাজনৈতিক নেতা মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। বেশির ভাগ প্রার্থীই এই তফসিলেই নির্বাচন দাবি করেছেন।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আজিজুর রহমান বলেন, ট্রিপল মার্ডারের ঘটনা নির্বাচনের ওপর কোনো প্রভাব ফেলত না। জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক এমপি মসিউর রহমান বলেন, �মাথাব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলতে হবে�এটা ঠিক নয়। নির্বাচনের শেষ মুহূর্তে এসে নির্বাচন স্থগিত করা ঠিক হয়নি। সহিংস ঘটনার আশঙ্কা থাকলে তা দমন করে নির্বাচন সম্পন্ন করা উচিত ছিল। এটা না করতে পারা সরকারেরই ব্যর্থতা।�
ঝিনাইদহ পৌরসভার আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী সাইদুল করিম মিন্টু বলেছেন, নির্বাচনের সুষ্ঠু ও শান্ত পরিবেশ ছিল। নির্বাচনের ব্যাপারে প্রশাসন যথেষ্ট তৎপর। তিনি গতকাল বাতিল হওয়া তফসিলেই নির্বাচনের দাবি জানান। বিএনপি সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী আক্তারুজ্জামান বলেন, �এ নির্বাচনে আমার বিজয় নিশ্চিত ভেবে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে নির্বাচনী তফসিল বাতিল করা হয়েছে। আগামী ১৩ জানুয়ারি ঝিনাইদহ পৌরসভার নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা ছিল।�
এদিকে নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন গতকাল বলেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতা হলে ভোটের দিনও নির্বাচন বাতিল করা হতে পারে। তিনি আরো বলেন, �কোনো প্রার্থী বা সমর্থকগোষ্ঠী কোনো ধরনের প্রভাব বিস্তার করার অপচেষ্টা চালালেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ভোটের দিনও অপ্রীতিকর কোনো ঘটনা ঘটলে বন্ধ করে দেওয়া হবে নির্বাচন।�

No comments

Powered by Blogger.