কুয়াশায় ক্যাম্পাস

পৌষ পার্বণে পিঠা খেতে বসে/খুশীতে বিষম খেয়ে আরো উল্লাস বাড়িয়েছে মনে /মায়ের বকুনী খেয়ে।’ পৌষের হিমেল হাওয়ায় পিঠা খাওয়ার ঐতিহ্য বাঙালীর পুরনো।
শীত আসলে স্কুলের সমাপনী পরীক্ষাটি শেষে কৈশোরে যেমন ছুটে চলে যাওয়া যায় নানাবাড়ি,খাওয়া যায় নানি-খালা-মামির হাতে বানানো নানাধরনের পিঠা। একটা সময় সে সুযোগ আর থাকে না। শীত এসে শৈশব- কৈশোরের মতো ধরা দেয় না এই বাস্তবতায়। ব্যস্ত রাজধানীর নাগরিকরা তো সময়ই পান না এই শীতের পিঠা খাওয়ার জন্য দলবেঁধে নাড়ির টানে ছুটে যাওয়ার। তেমনি পড়াশোনার ব্যস্ততার কারণে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের অনেক শির্ক্ষাথীও ছুটে যেতে পারেন না বাড়িতে মায়ের হাতের পিঠা খাওয়ার জন্য। শীতের পিঠা তো আছেই। সেই সঙ্গে আছে শীতের মিষ্টি রোদ এবং নানারকমের সবজি। আর এই শীতে ক্যাম্পাসে নিজের শীত পোশাকটা নিয়ে কিছুটা ফ্যাশন করে ফেলেন ফ্যাশনেবল তরুণ-তরুণীরা। কেমন হয় ক্যাম্পাস জীবনের শীতকালীন সময়টা কিংবা শীতের ক্যাম্পাস কতটা মোহনীয় হয়ে ধরা দেয় ছাত্রছাত্রীদের নিকট? আসুন জেনে নিই তার বিস্তারিত।
আবাসিক হলের জানালার বাইরে হাল্লা কুয়াশার সাদা চাদর, আর শিশির পড়ার টপটপ শব্দÑএসবই জানিয়ে দেয় এখন শীতের সময়। ঋতুর পালাবদলে আবহমান বাংলায় প্রতিবছর এভাবেই শীতের আগমন ঘটে। বর্ষপঞ্জিকার ছকে আবদ্ধ হয়ে যায় হেমন্তকাল। মৃদু ছন্দে ঝড়েপড়া কুয়াশা, হিমশীতল বাতাস এসবই যেন ঠা-ার আভাস বহন করে। পৌষের শীতে বন্ধুদের সঙ্গে রোদে আড্ডা দেয়ার মাঝেই যেন সব সুখ নিহিত। শীতে সুখের আরেক নাম হলো লেপমুড়ি দিয়ে আয়েস করে ঘুম। কিন্তু পরীক্ষা,এ্যাসাইনমেন্ট মুখ ভেঙচিয়ে সেই ঘুমের আরামকে হারাম করে দেয়।
শীতের সকালে ক্লাস করার অনুভূতির কথা জানালেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র কাজল, আযানসহ কয়েক শিক্ষার্থী। তারা বলেন, শিক্ষকরা যদি শীতকে উপেক্ষা করে এসে আমাদের ক্লাস নিতে আগ্রহী হয় তাহলে আমাদের ক্লাস করতে অসুবিধা কোথায়। তাদের মতে শীতের দিনে সকাল ৮টায় যেদিন ক্লাস থাকে সেদিন খুব তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠতে হয় এবং কোন কোন সময় সকালের নাস্তা ক্যাম্পাসে এসে করতে হয় যা সত্যি বিরক্তিকর ব্যাপার। তবে রোদে দাঁড়িয়ে চা-সিঙ্গাড়ায় সবার সঙ্গে গল্প করাটা খুবই আনন্দের ব্যাপার।
অদিতি আবাসিক হলে থাকেন না বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে এসে তাকে ক্লাস করতে হচ্ছে। আর তাই তাকে ৮টার ক্লাসে ৭টার মধ্যেই বাসা থেকে শীতকে উপেক্ষা করে ঘুম বাদ দিয়ে ক্যাম্পাসে আসতে হয়। সময়মতো বাস ধরার জন্য অনেক সময় তাকে মায়ের এত কষ্ট করে বানানো নাস্তাও খেয়ে আসা সম্ভব হয় না। তাই এই ফাঁকে তিনি আহ্লাদে আবদার করে ফেলেন ‘ইস্ এই শীতে সকাল ৮ টার ক্লাসগুলো যদি সকাল ৯ টায় হতো তাহলে কত ভাল হতো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় এই শীতে দেখা যায় ভাপাপিঠার উৎসব। ধোঁয়াওঠা চা আর ভাপাপিঠার সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা মারে ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরা। ঢাঃবিঃর হাকিম চত্বর, চারুকলার রাস্তা-ছবির হাটে, পাবলিক লাইব্রেরীর সামনে শীতের শাল, হাতমোজা কিংবা মাঙ্কি টুপিতে শীতের কুয়াশাকে উপেক্ষা করে বন্ধুত্বে উষ্ণতা খোঁজার জন্য ক্যাম্পাসের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরাও নিয়মিত চলে আসেন এই ক্যাম্পাসে।
চলতি পথে হঠ্যাৎ ক্যাম্পাসের কোন কোন জায়গায় শীতের রাতে দেখা যায় শিক্ষার্থীরা সবাই মিলে আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণ করছে। এটাও এক ধরনের ক্যাম্পাস মজা। গ্রামের মানুষের সেই জীবনটা এই শহুরে প্রাণে কিছুটা হলেও প্রাণের দোলা লাগায়। সকাল থেকে ক্লাস-ল্যাব-প্র্যাকটিক্যাল-গল্প-ডিসকাশন শেষে শীতের শেষ বিকেলে বন্ধুদের সঙ্গে প্রাণখোলা আড্ডা। চায়ের কাপে ঝড় তোলা। এই তো নিত্য ক্যাম্পাস রুটিন। শীত এই আড্ডার আমেজ বাড়িয়ে দেয় কয়েকগুণ।
ক্যাম্পাসের আবাসিক ছাত্র এবং ছাত্রীদের হলে শীতের এ সময়টায় দেখা যায় ব্যাডমিন্টনের কোর্ট। গোধূলিবেলায় ক্লাস-পড়াশোনা শেষে কিছুটা নিজেদের কৈশোরের স্বাদ নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন আবাসিক শিক্ষার্থীরা। কখনওবা এই খেলার জন্য হলের অন্যান্য কিছুর মতো লাইনের সিরিয়ালে দাঁড়াতে হয় শিক্ষার্থীদের। বিকেলে শুরু হওয়া ব্যাডমিন্টন শেষ হতে হতে গভীর রাত অবধি চলে যায়। শীতের আমেজে প্রাণভরে উপভোগ করা হয় নেট আর পালকের এই খেলা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের আবাসিক ছাত্রী অর্থনীতি বিভাগের ফাতেমাতুজ জোহরা জানান আমরা যারা হলে থাকি শীতকাল এলেই আমরা যেন একটু বেশি আরামপ্রিয় হয়ে যাই। অলসতা আমাদের জেঁকে বসে। এই ক্যাম্পাস এবং হলের হিমহিম বাতাসে ঠা-া লেগে যায়। কোনরকম দরজা বন্ধ করে রুমমেটরা মিলে একসঙ্গে চা বানিয়ে খেয়ে জম্পেশ আড্ডা। লেপের মধ্যে পা ঢুকিয়ে প্রিয় গল্পের বইয়ে হারিয়ে যাওয়া। শীতের এত মাধুর্য কার না ভাল লাগে। এই যে এত আনন্দ এটা তো সারাজীবনের সঞ্চয়।
জোহরা শিউলি

No comments

Powered by Blogger.