বঙ্গবন্ধুর আদর্শের আইনজীবীদের এক থাকতে হবে- মতবিনিময় অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা

 প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া এখন তত্ত্বাবধায়কের জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার এলে তিনি কি পার পেয়ে যাবেন? বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমাকে এবং খালেদা জিয়াকে জেলে পুরেছিল।
তাঁর দুই পুত্রকে দেশ ছাড়া করেছিল। এসব কি তিনি ভুলে গেছেন? শনিবার গণভবনে সারাদেশের আওয়ামী লীগের আইন সম্পাদক ও সিনিয়র আইনজীবীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, সম্প্রতি খালেদা জিয়া নিজেই হরতাল দিয়ে আবার নিরাপত্তাহীনতার অভিযোগে আদালতে যাননি। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার এলে তিনি কি এই সুযোগ পেতেন?
বৈঠকে সারাদেশ থেকে আগত আইনজীবীরা দলীয় আইনজীবীদের মধ্যে বিভাজনের কারণে বার কাউন্সিলসহ বিভিন্ন স্থানে পরাজয়ের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রীকে এ ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান। তাঁরা বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের জন্য জামায়াত-শিবির অর্থের বিনিময়ে আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করছে, ঐক্যে ফাটল ধরাচ্ছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করতে আমাদের ভেতরে থেকে যারা বিভাজনের চেষ্টা করছে তাদের চিহ্নিত করতে হবে। কারণ সাপকে যতই দুধ-কলা দেয়া হোক না কেন একদিন সে ছোবল মারবেই।
জবাবে প্রধানমন্ত্রী বিভাজন নয়, সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, বঙ্গবন্ধু আইনজীবী পরিষদ পঁচাত্তরের পর বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নে সোচ্চার ছিল। পরে আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ গঠিত হয়। এই দুই সংগঠনের মধ্যে সমন্বয় থাকা দরকার। সংঘাত থাকা উচিত নয়। কাউকে অবহেলা না করে সকলের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। সঠিকভাবে প্যানেল নির্বাচনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
সূচনা বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী হলমার্ক ও ডেসটিনি কেলেঙ্কারি প্রসঙ্গে বলেন, সূত্র ধরলে দেখা যায় এসব ঘটনা অনেক আগে থেকে ঘটছে। আমরা আর্থিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার স্বার্থে ব্যবস্থা নিচ্ছি। অথচ আমাদের ওপর দোষ চাপানো হচ্ছে। যেন চোর ধরতে যাওয়াটা অন্যায়। তিনি বলেন, দেশবাসীকে একটা কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, পঁচাত্তরের পর মার্শাল ল জারি করে ক্ষমতায় আসা জিয়াউর রহমানের সময়ই ঋণ খেলাপীর সংস্কৃতি দেশে প্রথম শুরু হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্তমান সরকারের অধীনে উপনির্বাচনসহ বিভিন্ন পর্যায়ে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার নির্বাচন হয়েছে। এর মাধ্যমে প্রায় ৬৩ হাজার জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন। একটি নির্বাচন নিয়েও কোন অভিযোগ ওঠেনি। জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছি। নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী হয়েছে। তিনি বলেন, দেশের উন্নয়নের স্বার্থে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে হবে।
সবাইকে সজাগ ও সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করতে নানা অপচেষ্টা চলছে। এ নিয়ে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। কারণ ঐক্য ছাড়া কোন কিছু অর্জন করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে অর্ডিন্যান্স জারি করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেছিলেন। সে সময় ২২ হাজার যুদ্ধাপরাধী আটক ছিল। এর মধ্যে সাজাপ্রাপ্ত ছিল ১০ হাজার।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী জিয়াউর রহমান মার্শাল অর্ডিন্যান্স জারি করে সংবিধানকে সঙ্গিনের খোঁচায় ক্ষতবিক্ষত করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করে দেন, কারাগার থেকে সকল যুদ্ধাপরাধীকে মুক্তি দিয়ে রাজনীতিতে পুনর্বাসন করেন। এমনকি পাকিস্তানী পাসপোর্টে দেশে আসা গোলাম আযমকে নাগরিকত্ব দেয়া হয়। যুদ্ধাপরাধী, স্বাধীনতাবিরোধী ও পরাজিত শক্তিরা পঁচাত্তরের পর দীর্ঘ ২১ বছর ধরে অবৈধভাবে ক্ষমতায় থেকে জনগণের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে। ক্ষমতায় থেকে তারা অনেক টাকা মজুদ করেছে। এখন যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য লবিস্ট নিয়োগ করে সেই টাকা ব্যয় করছে।
আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র সব সময় লেগেই থাকে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতা অর্জনের পর বঙ্গবন্ধু যখন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তোলেন, ঠিক তখনই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে তাঁকে হত্যা করা হয়। গণতন্ত্র যাতে আর ফিরে না আসে সে চেষ্টা চলে। মার্শাল ল জারি করে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস করেন। ইতিহাস বিকৃত করেন। ক্ষমতা দখলকারী ওই সরকারের (জিয়াউর রহমানের সরকার) একটাই কাজ ছিল আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া। পরাজিত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার এজেন্ডা বাস্তবায়নই যেন ছিল জেনারেল জিয়াউর রহমানের প্রধান কাজ।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগকে চিহ্নিত করা অত সহজ নয়, কারণ আওয়ামী লীগ এদেশের মাটি ও মানুষের দল। একমাত্র ১৯৯৬ সালেই দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানার সুযোগ পায়। সরকার মানে ভোগ নয়, জনগণের কল্যাণ ও সেবা করা এটা উপলব্ধি করে জনগণ। তিনি বলেন, এবার আমরা ক্ষমতায় এসে জনগণের মাঝে শান্তি, আস্থা ও বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে পেরেছি। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। বিশ্বে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ।
‘প্রিন্ট মিডিয়া আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে লিখছে’ মর্মে আওয়ামী আইনজীবী তৃণমূল নেতৃবৃন্দের অভিযোগের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অধিকাংশ পত্রিকার স্বত্বাাধিকারী অনেক ধন-সম্পদের মালিক। তাদের অর্থ-সম্পদ কিভাবে হয়েছে তা দেখলেই বুঝতে পারবেন। অথচ বেসরকারী টিভি চ্যানেল, পত্রিকাসহ গণমাধ্যমের সম্প্রসারণ আওয়ামী লীগই করেছে। এতে কর্মসংস্থান বেড়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা বিচার বিভাগকে স্বাধীন করেছি। বিচার বিভাগ, প্রশাসন ও জাতীয় সংসদ রাষ্ট্রের এই তিনটি প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। আইনজীবীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, কেউ যাতে অকারণে হাজতবাস না করে, হয়রানি না হয় সে দিকে খেয়াল রাখবেন।
আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক আইনমন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরু এমপির পরিচালনায় সভায় উপস্থিত ছিলেন প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, এ্যাডভোকেট সৈয়দ রেজাউর রহমান, আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ও মন্ত্রী এ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন এমপি, আইন প্রতিমন্ত্রী এ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম এমপি, প্রতিমন্ত্রী ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী প্রমুখ।
বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক এ্যাডভোকেট মমতাজউদ্দিন মেহেদী বলেন, সারাদেশে প্রায় ৫০ হাজার আইনজীবী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ। গুটিকয়েক আইনজীবী বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছেন।
রংপুর জেলার আইনজীবী এ্যাডভোকেট আব্দুল মালেক বলেন, গুটিকয়েক আইনজীবী বিভাজন সৃষ্টি করে আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবীদের ঐক্যে ফাটল ধরাচ্ছেন। এঁদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে।
রাজশাহী জেলার আইনজীবী আসলামুল হক সরকার বলেন, অনৈক্য ও বিভক্তি নয়, কতিপয় ব্যক্তির ষড়যন্ত্র চলছে। এঁদের চিহ্নিত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। আইনজীবীদের মধ্যে আদর্শের ঐক্য বড় প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধু আইনজীবী পরিষদ ও আওয়ামী আইনজীবী পরিষদকে এক করা যায় কিনা সে ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীকে সিদ্ধান্ত নেয়ার আহ্বান জানান তিনি।
মৌলভীবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির নেতা আজাদুর রহমান বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করতে আমাদের ভেতরে থেকে যারা চেষ্টা করছে তাদের চিহ্নিত করতে হবে। কারণ সাপকে যতই দুধ-কলা দেয়া হোক না কেন একদিন সে ছোবল মারবেই। তিনি প্রশ্ন তুলে বলেন, রাজধানীসহ সারাদেশে যাদের পিপি নিয়োগ দেয়া হয়েছে তারা কারা? তাদের অর্ধেকেরও বেশি আওয়ামী লীগপন্থী নয়। এদের চিহ্নিত করে দলের নিবেদিতদের নিয়োগ দেয়ার অনুরোধ জানান তিনি।
বগুড়া জেলা আইনজীবী নেতা রেজাউল করিম মন্টু বলেন, আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীদের ঐক্যের বিভাজনের কারণে সারাদেশের বার কাউন্সিলে গত নির্বাচনে আমাদের ভরাডুবি হয়েছে। ঐক্যবদ্ধভাবে প্যানেল হওয়া জরুরী উল্লেখ করে তিনি বলেন, এক্ষেত্রে শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ খুবই জরুরী।
খুলনা আইনজীবী সমিতির নেতা মুজিবুল হক বলেন, বিভাজনের কারণে বার কাউন্সিলের গত নির্বাচনে আমাদের পরাজয় হয়। আমরা কোথাও গেলেই বলা হয়, আপনার প্যানেল কোন্টা? তিনি বলেন, শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপে এর সমাধান এখনই হওয়া প্রয়োজন।
বরিশাল আইনজীবী সমিতির নেতা কানাইলাল বিশ্বাস বলেন, গত বার কাউন্সিল নির্বাচনে উল্টো প্যানেলে ভোট দিতে ঢাকা থেকে লোক পাঠানো হয়েছিল। জামালপুর আইনজীবী সমিতির নেতা জাহিদ আনোয়ার বলেন, আমাদের মধ্যে ঐক্যের প্রয়োজন। কারণ বিরোধ হলে পরাজয় হবেই।
ঢাকা জেলা আইনজীবী সমিতির নেতা নজিবুল্লাহ হীরু বলেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী আইনজীবীরা বিভাজনের মধ্য দিয়ে চলছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের জন্য জামায়াত-শিবির অর্থের বিনিময়ে এ বিভাজন সৃষ্টি করছে।
চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অশোক কুমার সাহার বক্তব্যের পর সামনে উপস্থিত আইনজীবীরা চেঁচামেচি করলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যে যখন বক্তব্য দেন তখন তাঁকে কথা বলতে দিবেন। নিজেরা বলবেন আবার শুনবেন না- এটা তো আইনজীবীদের চরিত্র হতে পারে না।

No comments

Powered by Blogger.