জেনোসাইড ডটার by মানিক রহমান

জেনোসাইডের বিপরীতে গণহত্যা অভিধাটা যথার্থ হওয়ার কথা নয়। তারপরও আমরা ব্যবহার করি, এক শব্দে প্রকাশ করার জন্য এর চেয়ে ভালো অভিধা নেই বলে। জেনোসাইড মানে উদ্দেশ্যমূলকভাবে কোনো জাতিকে বা জাতির একটি অংশ বা জাতির কোনো একটি সম্প্রদায়কে হত্যা করা।
দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে নানা সময়ে জেনোসাইড হয়েছে; রুয়ান্ডা, আর্মেনিয়ার জেনোসাইডের সঙ্গে সঙ্গে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জেনোসাইডও ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ১৯৪৪ সালে জাতি হত্যা বোঝাতেই শব্দটির প্রবর্তন হয়েছিল।
দিন দিন আরও নানা পরিসরে এর ব্যবহার দেখা গেছে। তবে যেখানেই শব্দটি ব্যবহার হয়েছে প্রত্যেকটিই আঁতকে ওঠার মতো। ভারতের ক্ষেত্রেও কি তা নয়? দি 'জেনোসাইড' অব ইন্ডিয়া'জ ডটারস নামে শুক্রবার আল জাজিরা প্রকাশ করেছে ভারতে কন্যা শিশু, সামগ্রিকভাবে নারীদের অবস্থা । ভারতে কন্যা সন্তানদের ভ্রূণ হত্যা এমনকি কন্যা শিশু হত্যার যে চিত্র প্রতিবেদনটিতে প্রকাশ পেয়েছে তা সত্যিই ভয়াবহ। আল জাজিরার একে জেনোসাইড অভিধায় প্রকাশই যেন যথার্থ হয়েছে। ভারতের জন্য ঘটনাটি অনেক পুরনো হলেও আল জাজিরা এমন সময় বিষয়টি নতুনভাবে সামনে এনেছে, যখন গণধর্ষণের শিকার হয়ে তরুণীর মৃত্যু হয়েছে এবং তার বিরুদ্ধে সারাদেশ একযোগে ফুঁসে উঠেছে। এ রেশ এখনও মিলিয়ে যায়নি। প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও এ নিয়ে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ হচ্ছে। মোটের ওপর ভারতে প্রতিনিয়ত ধর্ষণের ঘটনায় সেখানে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি যেমন ধরা পড়েছে, তেমনি ব্যাপকহারে মেয়ে ভ্রূণ হত্যা আর কন্যা শিশু হত্যার চিত্রে সমাজে নারীর অবনমিত অবস্থানটাও মোটা দাগে উঠে এসেছে।
ভারতের সুপ্রিম কোর্টই অবশ্য বিষয়টা আরও স্পষ্টভাবে সামনে এনেছেন। সম্প্রতি সেখানে সংখ্যার দিক থেকে মেয়েদের হার উদ্বেগজনকভাবে কমায় সাতটি রাজ্যের স্বাস্থ্য সচিবের প্রতি এক আদেশ জারি করেন সুপ্রিম কোর্ট। উচ্চ আদালত এ ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য জানতে চেয়েছেন এসব রাজ্যের কাছে। ইউনিসেফ বলছে, ছেলে সন্তানদের প্রাধান্য দিতে গিয়ে লাখ লাখ মেয়ে ভ্রূণ নষ্ট করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, প্রতিদিন ভারতে দুই হাজারেরও বেশি অবৈধ গর্ভপাত হয়। যেটি দেশটিতে জনসংখ্যায় ভারসাম্যের ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে।
এটা ভারত সরকার আগেই বুঝেছিল। ২০১১ সালে মনমোহন সিংয়ের ভ্রূণ হত্যা আর শিশু হত্যার বিরুদ্ধে ক্রুসেড ঘোষণার মাধ্যমেই সেটা সবার কাছে পরিষ্কার হয়। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন বলেছিলেন, ক্রমহ্রাসমান কন্যা শিশুর হার সত্যিই আমাদের মূল্যবোধের এক বড় চ্যালেঞ্জ। অথচ মেয়ে, নারীরা আমাদের গর্বিত করছে। তারা ক্লাসরুমে ভালো করছে, বড় বড় দায়িত্বে থেকে ভালো করছে; এমনকি খেলায়ও তাদের অবদান অনন্য। এটা জাতীয় লজ্জা। মনমোহনের ক্রুসেড ঘোষণার ব্যাকগ্রাউন্ডটা দেখলেও বিষয়টা পরিষ্কার হয়, ১৯৯১ সালের ভারতের আদমশুমারিতে এক হাজার ছেলের বিপরীতে মেয়ের সংখ্যা ছিল ৯৪৫। ২০১১ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৮৩০-এ।
আমরা 'শাইনিং ইন্ডিয়ার' কথা শুনি, দেখিও। সে চিত্রের বিপরীতে প্রতিনিয়ত মেয়ে ভ্রূণ হত্যার এ চিত্র কতটা বেমানান বা অসামঞ্জস্যপূর্ণ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সেখানে একটি রাজ্যের সঙ্গে আরেক রাজ্যের আকাশ-পাতাল ফারাক। একটি পুত্র সন্তানের আশায় প্রতিনিয়ত মেয়ে ভ্রূণ হত্যা করছে মানুষ, যৌতুকে পিষ্ট বাবা হত্যা করছে মেয়েকে, কৃষক ঋণের দায়ে আত্মহত্যা করছে। অন্যদিকে নিয়ন সাইনের আলোকচ্ছটা। আমাদের দেশ-সমাজের সঙ্গে এই বৈসাদৃশ্যকে মিলিয়ে দেখলে আমরা দেখতে পাব বাংলাদেশেরও আশঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
আল জাজিরা অবলম্বনে

No comments

Powered by Blogger.