‘উৎখাত’ রোগাক্রান্ত দেশের সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় by আবদুল মান্নান

রাতেই বিভিন্ন টিভি পর্দার নিউজ বারে সংবাদটি পড়েছিলাম। রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ধরে উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করে আসছেন।
২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমান প্রজন্মের একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয়। বলতে গেলে এটির একেবারেই শিশুকাল। শিক্ষক সংখ্যা সত্তরের নিচে আর ছাত্র সংখ্যা পাঁচ শ’ হবে। যখন দেশের সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয় তখন আমার অনুজপ্রতিম সহকর্মী ড. জাফর ইকবালের একটি লেখার শিরোনাম মনে পড়ে। বছর কয় আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র অসন্তোষের কারণে বন্ধ হয়ে গেলে একটি জাতীয় দৈনিকে তার লেখা একটি উপসম্পাদকীয়র শিরোনাম ছিল ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কী আদমজি পাটকলের ভাগ্য বরণ করবে?’ তিনি বুঝাতে চেয়েছেন, যেভাবে চলছে সেভাবে সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চলতে থাকলে একসময় হয়ত দেশের এ সব বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিতে হবে অথবা নিজেই বন্ধ হয়ে যাবে। তিনি কথা কয়টি খুব দুঃখ করে লিখেছিলেন। ড. জাফর ইকবাল যখন এই লেখা লিখেছিলেন তার চেয়ে বর্তমানে দেশের বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থার আরো অবনতি হয়েছে এবং এর জন্য দায়ী হাতে গোনা কিছু শিক্ষক এবং ছাত্র; আর এই ছাত্ররা মূলত ব্যবহৃত হন এই শিক্ষকদের দ্বারা। শিক্ষকদের সব দাবিই যে অযৌক্তিক তা হয়ত নয়, কিন্তু যে পদ্ধতিতে তারা এই সব দাবি আদায়ের চেষ্টা করেন তা কখনোই শিক্ষকসুলভ নয় এবং তাদের অজান্তেই তারা তাদের এই সব কাজে ছাত্রদের সম্পৃক্ত করে নিজে নিজে সর্বনাশ ডেকে আনেন; কারণ, এই ছাত্ররাই একদিন তাদের সামনে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে। বর্তমানে এই ধরনের শিক্ষকদের উপাচার্য উৎখাত আন্দোলন একটি সংক্রামক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। তথাকথিত এই সব আন্দোলনের ফলে বর্তমানে দেশের অন্তত অর্ধডজন সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠন-পাঠন লাটে উঠেছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। অথচ সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শুধু দেশের মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর সন্তানরাই পড়ালেখা করে না; এখনো দেশের সবচাইতে মেধাবী শিক্ষার্থীদের শেষ আশ্রয়স্থল সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় বলা হলেও বাস্তবে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মালিক দেশের জনগণ।
শিক্ষকদের বৈধ-অবৈধ আন্দোলন আর উপাচার্য উৎখাতের সংস্কৃতিটা সম্ভবত চালু হয়েছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বেগম জিয়ার প্রথম শাসনামলে। এরশাদ পতনের পর তৎকালীন উপাচার্য ছাত্র-শিক্ষকদের এক বিজয় মিছিল শেষে তার সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় কারও নাম না নিয়ে বলেছিলেন, দেশের মানুষকে এখন একাত্তরের ঘাতকদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। আর যায় কোথায়! এই বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ধরে শক্ত অবস্থানে থাকা নতুন প্রজন্মের বাচ্চা আলবদররা জামায়াত-বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের নিয়ে এক নারকীয় অবস্থার সৃষ্টি করল। দীর্ঘ প্রায় এক বছর বিশ্ববিদ্যালয় অচল থাকল। একজন ছাত্রের মৃত্যু হলো। অনেক শিক্ষক শারীরিকভাবে নিগৃহীত হলেন। অবশেষে উপাচার্যকে তার দায়িত্ব হতে অব্যাহতি দিয়ে একজন বিএনপিপন্থী শিক্ষককে সম্পূর্ণ বেআইনীভাবে উপাচার্য নিয়োগ করা হলো। যাকে অব্যাহতি দেয়া হলো তিনি সিনেট কর্তৃক রেকর্ড সংখ্যক একাত্তর ভোট পেয়ে উপাচার্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। আর যে সব শিক্ষক এই অবৈধ আন্দোলনে শরিক হয়েছিলেন তাদের কেউ কেউ পরবর্তীকালে সরকার কর্তৃক পুরস্কৃত হয়েছিলেন। বর্তমানে এই সব তথাকথিত আন্দোলনে কোন কোন ক্ষেত্রে আবার সম্পূর্ণ অযাচিতভাবে উপাচার্যরাও ছাত্রদের ব্যবহার করেন নিজেদের পেটোয়া বাহিনী হিসেবে যেটিও কখনও কাম্য নয়। এতে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়। এই যে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগ নামধারীরা ন্যক্কারজনকভাবে হামলা বা এসিড নিক্ষেপ করল এটা তো কোনভাবে সমর্থন করা যায় না। এর দায়দায়িত্ব কাউকে না কাউকে তো নিতে হবে এবং এর দায়দায়িত্ব উপাচার্যকেই নিতে হবে।
ইদানীংকালে এক শ্রেণীর শিক্ষক যে উপাচার্য উৎখাত আন্দোলনে লিপ্ত হয়েছে তার কারণ হিসেবে তারা বলছে, উপাচার্যরা দুর্নীতি আর স্বজনপ্রীতিতে ডুবে গেছেন। সুতরাং তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা এখন তাদের নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। আর মজার ব্যাপার হচ্ছে যারা এই উৎখাত আন্দোলনে শামিল তাদের অনেকেই দাবি করেন তারা বঙ্গবন্ধুর সৈনিক আর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি। এসব কথা বলে তারা প্রকৃত অর্থে যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি তাদের বিভ্রান্ত করে তাদের মাঝে বিভাজন সৃষ্টি করেন। আর বাস্তবে তারা সমর্থন পান জামায়াত আর বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের। কোন কোন ক্ষেত্রে অভিযোগ আছে, তারা উৎখাত আন্দোলনের জন্য অর্থের যোগান দেন। দুই একটি ক্ষেত্রে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ছাড়াও উপাচার্য আঞ্চলিকতাকে প্রশ্রয় দেন বলে উৎখাতওয়ালারা অভিযোগ করেন। আবার এই আঞ্চলিকতাকে জেলার উত্তর দক্ষিণে ভাগ করেন। তাতেও কাজ না হলে বলেন, উপাচার্য জামায়াত শিবির তোষণ করেন, সুতরাং তাকে উৎখাত করতে হবে। একটি বাস্তব উদাহরণ দেই। আমাকে উপাচাযের্র পদ হতে উৎখাত করতে হবে। নানা ধরনের গোপন বৈঠক, শলাপরামর্শ হচ্ছে। করছেন ওই তথাকথিত বঙ্গবন্ধুর সৈনিকরা। তারা তেমন একটা সুবিধা করতে পারছেন না। শুরু হলো আমার বিরুদ্ধে চ্যান্সেলরের কাছে চিঠি চালাচালি (যার একাধিক কপি আমার কাছে আছে)। তাতেও সুবিধা হচ্ছে না। আমার সম্পর্কে চ্যান্সেলরের স্বচ্ছ ধারণা আছে। এর মধ্যে সরকার সিদ্ধান্ত নিল দক্ষিণ চট্টগ্রামে বিদেশী অর্থায়নে একটি সমুদ্র বিজ্ঞান রিসার্চ সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হবে। আমার কাছে একজন প্রকল্প পরিচালকের নাম চাইল সরকার। বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সিনিয়র শিক্ষকদের সঙ্গে পরামর্শ করলে তারা সকলে একবাক্যে এই দায়িত্বের জন্য একজন সিনিয়র শিক্ষকের নাম প্রস্তাব করেন যার যোগ্যতা সম্পর্কে কারও কোন দ্বিধা ছিল না। তার নাম পাঠানো হলো। এবার উৎখাতওয়ালারা বলা শুরু করলেন, তিনি একজন জামায়াতপন্থী শিক্ষক। সুতরাং তাকে মনোনয়ন দিয়ে আমি একজন জামায়াতীকে পুরস্কৃত করেছি। তারা এর প্রতিবাদ করার জন্য এক অভিনব পন্থা বেছে নিলেন। একজন সম্পূর্ণ বহিরাগত, যিনি আজীবন বঙ্গবন্ধুর নাম ব্যবহার করে বাটপাড়ি, ফেরেববাজি, চাঁদাবাজি করে জীবন ধারণ করেন তাকে কাজে লাগিয়ে কিছু ছাত্রকে দিয়ে শহরে অনশন ধর্মঘটের আয়োজন করা হলো। প্রতিদিন নানা নামসর্বস্ব সংগঠনের প্যাডে ‘জামায়াত তোষণের’ অপরাধে আমার পদত্যাগ দাবি করে বিবৃতি প্রচার শুরু হলো, লিফলেট বিলি হলো। শেষ পর্যন্ত যেটি হলো সরকার ওই প্রকল্প বাতিল করতে বাধ্য হলো; কারণ, এরই মধ্যে বিদেশী দাতাগোষ্ঠী অর্থায়নের সিদ্ধান্ত বাতিল করেছে। এই সব অপরাজনীতির ফলে ব্যক্তিগতভাবে আমার কিছুই হলো নাÑ ক্ষতিগ্রস্ত হলো দেশ। সেই ব্যক্তি এখনও তার পুরনো বাটপাড়ি পেশায় আছেন এবং মাঝে মাঝে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তাকে দেখাও যায় বলে আমাকে কয়েকজন জানিয়েছেন।
এই সব উৎখাত আন্দোলনের মূল ইস্যু কিন্তু ক্ষমতার লোভ আর গদি দখল ছাড়া অন্য কিছু নয়। এই উৎখাত আন্দোলনের পিছনে মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সরকারের শেষ সময়ে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের বারোটা বাজিয়ে কিছু ফায়দা লুটতে পারলে ক্ষতি কী? যতদিন এই সরকার ক্ষমতায় আছে ততদিন সকলে বঙ্গবন্ধুর সৈনিক। আগামী নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে এই সৈনিকদের ইউনিফরম পাল্টাবেন না, আর অন্যথা হলে ইউনিফরমও পাল্টে যেতে কোন আপত্তি থাকার কথা নয়। ২০০১ সালে বেগম জিয়া ক্ষমতায় এলে ঠিক এমনটি হয়েছিল। কিন্তু বেগম জিয়া এ সব ব্যাপারে অনেক বেশি বাস্তববাদী এবং আপোসহীন। তিনি ঠিকই সব উপাচার্যকে সরিয়ে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের লোক বসিয়েছিলেন এবং যতদিন ক্ষমতায় ছিলেন ততদিন কোথাও নকল জিয়ার সৈনিকরা উৎপাত করেননি। অন্য কারণে কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের সরে যেতে হয়েছে; তবে সেই সব কারণ এই তথাকথিত বঙ্গবন্ধুর সৈনিকদের উদ্ভাবিত কারণের মতো নয়। এই যে উপাচার্য উৎখাত কর্মসূচী কিছু সংখ্যক শিক্ষক আর ছাত্রের মধ্যে সংক্রমিত হয়েছে সরকার যদি তা দৃঢ় হস্তে মোকাবেলা না করেন তাহলে কোন উপাচার্যের পক্ষেই আগামীতে সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় চালানো সম্ভব হবে না। এমনিতে দেশের সর্বক্ষেত্রে মধ্য আর নিম্নœমেধাবীদের দৌরাত্ম্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান তলিয়ে যেতে বসেছে। এর মধ্যে যদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে তা হলে তা হবে দেশের জন্য সবচেয়ে বড় সর্বনাশ। তবে এটাও, ঠিক সব সময়ে উপাচার্যরা সঠিকভাবে তাঁদের দায়িত্ব পালন করেন তাও নয়। তাঁদের অনেক সিদ্ধান্ত বা পদক্ষেপ বিশ্ববিদ্যালয়ে অনাহূত সমস্যার জন্ম দেয় এবং তাদের জন্য ভোগান্তির কারণ হয়। এ সব ব্যাপারে তাদের আরও সতর্ক হওয়া উচিত। আর সরকারেরও উচিত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেয়ার সময় মেধা, প্রশাসনিক দক্ষতা, বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারে গ্রহণযোগ্যতা এবং বিচক্ষণতাকে প্রাধান্য দেয়া। যারা সর্বক্ষণ বিশ্ববিদ্যালয়কে অচল করার ষড়যন্ত্রে ব্যস্ত থাকেন তাদের কাছ হতে যতদূরে থাকা যায় ততই সকলের জন্য মঙ্গলজনক। আর দুঃখজনক হলেও সত্য, এই আন্দোলনকারীদের মাঝে এমন অনেক ব্যক্তি আছেন যাদের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হওয়ার মতো কোন যোগ্যতাই নেই। বিভিন্ন সময় এরা শ্রেফ রাজনৈতিক পরিচয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। সকলের মাঝে বিশ্ববিদ্যালয় আর শিক্ষার্থীদের জন্য মমত্ববোধ তৈরি হোকÑ এই কামনা করি।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও বিশ্লেষক।
১২ জানুয়ারি, ২০১৩

No comments

Powered by Blogger.