উইকিলিকস: মার্কিন নথিতে এক-এগারো—৩- সামরিক বাহিনীর ওপর প্রচণ্ড চাপ by মশিউল আলম

২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সকাল। বাংলাদেশে রাজনৈতিক অচলাবস্থা এমন কানাগলিতে গিয়ে ঠেকেছে যে সর্বশেষ পন্থা হিসেবে সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনার জল্পনাকল্পনা তুঙ্গে উঠেছে।
ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২২ জানুয়ারি নির্ধারিত একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানে বদ্ধপরিকর। রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি সেনাবাহিনীকে আদেশ দিয়েছেন ১০ থেকে ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বেসামরিক আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষকে সহযোগিতা করতে। ফলে সেনাবাহিনী ইতিমধ্যে মোতায়েন ২৫ হাজার সেনাসহ শিগগিরই দেশের উপজেলা পর্যায়ে মোট ৬৫ হাজার সেনা পুনর্মোতায়েন করবে। সামরিক কর্তৃপক্ষের দ্বারা নির্ধারিত রুলস অব এনগেজমেন্টের অধীনে সেনাদের মোতায়েন করা হবে তাজা গুলিসহ।
এ রকম মুহূর্তে ঢাকা থেকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিসিয়া বিউটেনিস একটি তারবার্তা পাঠালেন ওয়াশিংটনে পররাষ্ট্র বিভাগের সদর দপ্তরে। ‘সিক্রেট/নোফর্ন’ (বিদেশিদের জন্য নয়) শ্রেণীভুক্ত সে তারবার্তায় তিনি লিখেছেন, চলমান রাজনৈতিক সংকটের ‘সামরিক সমাধানের’ জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশের কূটনৈতিক মিশনের শরণাপন্ন হচ্ছেন। সামরিক সমাধান চাইছেন নেতৃত্বস্থানীয় ব্যবসায়ী সংগঠন ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরাও। এই তিনটি পক্ষই সামরিক সমাধানের পক্ষে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন পাওয়ার চেষ্টা করছে। ফলে সংকট নিরসনের লক্ষ্যে কিছু একটা করার জন্য সামরিক বাহিনীর ওপর তীব্র চাপ সৃষ্টি হয়েছে। সামরিক হস্তক্ষেপের পক্ষে বিদেশি কূটনীতিকদের সমর্থন চেয়েছেন যেসব রাজনীতিক, তাঁদের মধ্যে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদের কথা বিউটেনিস ১১ জানুয়ারির তারবার্তায় উল্লেখ করেছেন। বিউটেনিস লিখেছেন, এরশাদের অনুরোধে তিনি ৮ জানুয়ারি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তখন এরশাদ তাঁকে বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থার একটি সমাধান হতে পারে সামরিক বাহিনীর সমর্থিত একটি জাতীয় ঐকমত্যের সরকার।
বিউটেনিস লিখেছেন, সামরিক সমাধানের পক্ষপাতী সবাই চাইছেন, সামরিক বাহিনী যেন রাষ্ট্রপতি/প্রধান উপদেষ্টা ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে ২২ জানুয়ারি নির্ধারিত নির্বাচন ছয় মাসের জন্য স্থগিত ঘোষণা করতে রাজি করায়। সামরিক বাহিনী যেন এমন উদ্যোগ নেয় যাতে ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে ইস্তফা দেন, তারপর একজন নতুন প্রধান উপদেষ্টা ও একটি উপদেষ্টামণ্ডলী নিয়োগ করেন, অথবা একটি ‘জাতীয় ঐকমত্যের সরকার’ গঠন করেন।
এমন পরিস্থিতিতে সামনে কী ঘটতে যাচ্ছে, তা সম্পর্কে রাষ্ট্রদূত বিউটেনিস ওই তারবার্তায় কয়েক ধরনের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেছেন। প্রথম সম্ভাবনা: ‘বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে পাঠানো হচ্ছে রাজনৈতিক নির্বাসনে, সম্ভবত অন্য কোনো দেশে।’ অন্য সম্ভাব্য ঘটনাবলির মধ্যে: ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার, অথবা ২২ জানুয়ারি নির্ধারিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে সে নির্বাচনে নতুনভাবে নির্বাচিত বিএনপি সরকার জরুরি অবস্থা জারি করবে। ওই জরুরি অবস্থার সময় সামরিক বাহিনীর ‘বিরাট নীতিগত/রাজনৈতিক ভূমিকা থাকবে’। অন্যান্য সম্ভাবনার মধ্যে আছে সামরিক আইন জারি, অথবা সামরিক অভ্যুত্থান।
রাষ্ট্রদূত বিউটেনিস লিখেছেন, ৭ জানুয়ারি তিনি ও তাঁর দূতাবাসের প্রতিরক্ষা অ্যাটাশে সেনাবাহিনীর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার মেজর জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর সঙ্গে বৈঠক করেন। উদ্দেশ্য, সামরিক হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের দৃঢ় অবস্থান আবার তুলে ধরা এবং জেনারেল জাহাঙ্গীরের মতামত জেনে নেওয়া। একই উদ্দেশ্যে ৯ জানুয়ারি সেনাপ্রধান লে. জেনারেল মইন উ আহমেদের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রতিরক্ষা অ্যাটাশে। জেনারেল মইন ও জেনারেল জাহাঙ্গীর দুজনেই মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও প্রতিরক্ষা অ্যাটাশেকে বলেন, সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা বা সাধারণ সৈনিক—কোনো পর্যায়েই সামরিক আইন, অভ্যুত্থান বা অন্য কোনো সংবিধান-বহির্ভূত পদক্ষেপের ব্যাপারে কোনো আগ্রহ নেই। দুই জেনারেল বলেন, তাঁরা সে রকম কোনো পদক্ষেপের প্রতি সমর্থন জানাবেন না।
জেনারেল জাহাঙ্গীর বলেন, ‘বর্তমানের সেনা মোতায়েনই তো আমাদের পছন্দ নয়, কেন আমরা অভ্যুত্থানকে সমর্থন দিতে যাব?’ তিনি মন্তব্য করেন, এ ধরনের কথাবার্তা উচ্চারণ করাই বেআইনি কাজ, কোনো সেনাসদস্য এ রকম কথাবার্তা বলার সময় ধরা পড়লে তাঁকে গ্রেপ্তার করা যাবে। বিউটেনিসের তারবার্তার ভাষ্য অনুযায়ী, জেনারেল জাহাঙ্গীর তাঁকে অনুরোধ করেন, তিনি (বিউটেনিস) যেন রাজনৈতিক দলগুলোকে বলেন যে তারা যেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত সামরিক বাহিনীর জন্য উসকানি সৃষ্টি না করে।
বিউটেনিস লিখেছেন, জেনারেল জাহাঙ্গীর ও জেনারেল মইন দুজনেই তাঁকে বলেছেন, বেসামরিক সরকারের সংবিধানসম্মতভাবে জরুরি অবস্থা জারি করা রাষ্ট্রপতির জন্য একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। তাঁরা বলেন, সামরিক বাহিনী বেসামরিক কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণাধীন এবং পক্ষপাতহীন থাকা সামরিক বাহিনীর দায়িত্ব। দুজনের কেউই মনে করেন না যে তাঁদের বা অন্য সামরিক নেতাদের উচিত রাষ্ট্রপতিকে ‘চাপ দেওয়া’, ‘পরামর্শ দেওয়া’ বা ‘সুপারিশ করা’ বা রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনের ব্যাপারে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাঁকে অন্য কোনোভাবে প্রভাবিত করা।
জেনারেল জাহাঙ্গীর বলেন, তিনি রাষ্ট্রপতিকে জরুরি অবস্থা জারি করার বিষয়টি এড়াতে বলেছেন। তিনি এই যুক্তি তুলে ধরেছেন যে জরুরি অবস্থা করার ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বেসামরিক আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষকে সহযোগিতা করার ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর সামর্থ্য বৃদ্ধি পাবে না। তা ছাড়া জরুরি অবস্থা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কোনো পরিষ্কার কৌশল নেই।
বিউটেনিস লিখেছেন, জেনারেল মইন মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতি জরুরি অবস্থা দাবি করে না, তবে তিনি স্বীকার করেন যে সেনাবাহিনী আপৎকালীন পরিকল্পনা করছে। জেনারেল মইন বলেন, তিনি জরুরি অবস্থার কথা ভাবতে পারেন ‘যদি নৈরাজ্য বেড়ে যায়’। কিন্তু তিনি মনে করেন, ২২ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে তেমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে না, বরং তিনি বেশি চিন্তিত নির্বাচনের পরের সম্ভাব্য গণ-অস্থিরতা নিয়ে।
বিউটেনিস তাঁর সদর দপ্তরকে জানিয়েছেন, বাংলাদেশে জাতিসংঘের প্রতিনিধি তাঁকে বলেছেন, সেনাপ্রধান মইন জাতিসংঘের প্রতিনিধিকে জানিয়েছেন, জরুরি অবস্থার অধীনে বা অন্য কোনোভাবে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সেনাপ্রধানের ওপর প্রচণ্ড চাপ রয়েছে। জেনারেল মইন জাতিসংঘের কাছ থেকে এমন একটি চিঠি চান, যেটির বক্তব্য হবে এ রকম যে সামরিক বাহিনী যদি সংবিধান-বহির্ভূত পদক্ষেপ নেয়, তাহলে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে তাদের দায়িত্ব পালনের সুযোগ হারানোর হুমকি সৃষ্টি হবে। জেনারেল মইন জাতিসংঘের প্রতিনিধিকে বলেন, সেনাবাহিনীর জন্য এ রকম গুরুতর পরিণতির প্রমাণ ছাড়া তিনি রাষ্ট্রপতি/প্রধান উপদেষ্টার কাছে গিয়ে সামরিক বাহিনীকে কোনো ধরনের রাজনৈতিক ভূমিকা নেওয়া থেকে নিষ্কৃতি দেওয়ার অনুরোধ জানানোর ঝুঁকি নিতে পারছেন না।
বিউটেনিস লিখেছেন, মার্কিন দূতাবাস, ব্রিটিশ হাইকমিশন ও ঢাকায় অন্যান্য দেশের কূটনৈতিক মিশনগুলো প্রকাশ্যে ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে সামরিক বাহিনীর কোনো ধরনের সংবিধান-বহির্ভূত ভূমিকা গ্রহণের বিরোধিতা করে চলেছে। রাষ্ট্রদূত বিউটেনিস ও মার্কিন দূতাবাসের অন্যরা সামরিক বাহিনীর নেতাদের সঙ্গে একান্ত বৈঠকে এবং প্রকাশ্যে এটা পরিষ্কার করেছেন যে ‘আমরা সামরিক বাহিনীর কোনো ধরনের সংবিধান-বহির্ভূত ভূমিকা একেবারেই সমর্থন করি না। আমরা জোর দিয়ে আরও বলি যে বর্তমান পরিস্থিতি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার মতবিরোধের ফল, এর জন্য প্রয়োজন একটি বেসামরিক, রাজনৈতিক সমাধান; সামরিক বাহিনীকে কেবল বেসামরিক সরকারের অধীনে ও সমর্থনে, সংবিধানের আওতার ভেতরে থেকেই কাজ করে যেতে হবে।’
তারবার্তার মন্তব্য অংশে বিউটেনিস লিখেছেন, ‘বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার মধ্যে তিক্ত ব্যক্তিগত বৈরিতা এমনই তীব্র যে তাঁরা উভয়েই বলেছেন, একজন অন্যজনকে ক্ষমতায় দেখার চেয়ে বরং ক্ষমতা সামরিক বাহিনীর হাতে গেলেই তাঁরা খুশি হবেন। কিন্তু সামরিক শাসনের অধীনে তাঁরা নিজেরাই যে বহিষ্কৃত হতে পারেন, এটা দুজনের কেউই কল্পনা করতে পারছেন বলে মনে হচ্ছে না। উভয় পক্ষ নিজ নিজ অবস্থানে এতটাই অনড় রয়েছে যে নাগরিক সমাজ ও ব্যবসায়ী নেতাদের হতাশা বিএনপি ও আওয়ামী লীগের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপের উপায়গুলো নিয়ে জনগণের মধ্যে চলমান জল্পনাকল্পনাকে বেগবান করছে। এমনকি দুই দলের কর্মীদের মধ্যেও অনেকে এমন সমাধানের জন্য সমর্থন চাওয়া অব্যাহত রেখেছেন, যার ফলে “দুই ভদ্রমহিলা”কে সরিয়ে দেওয়া যাবে। অন্ততপক্ষে নির্বাচনের দিনের মধ্য দিয়ে সামরিক বাহিনীকে টেনে আনার প্রয়াসগুলোর প্রতি আমরা নজর রেখে চলব; এ মুহূর্তে সামরিক বাহিনী নিজের অবস্থানে অটল রয়েছে।’”
তারবার্তাটির এক জায়গায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত এ কথাও লিখেছেন: ‘কেউ কেউ বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সংকেত ছাড়া সামরিক বাহিনী পদক্ষেপ নিতে দ্বিধাবোধ করছে।’

‘প্রথমা’ থেকে প্রকাশিতব্য বই উইকিলিকসে বাংলাদেশ অবলম্বনে
আগামীকাল পড়ুন: রাষ্ট্রদূতের কাছে সেনা কর্মকর্তার ব্যাখ্যা

মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.