জাতীয় বেইমান মোশতাক by মামুন-অর-রশিদ

 মীরজাফর থেকে খন্দকার মোশতাক হত্যা, কু্য আর ষড়যন্ত্রের রাজনীতির এক সমানত্মরাল অধ্যায়। এখন থেকে ২শ' ৬৩ বছর আগের কথা। পলাশীর আম্রকাননে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা মীরজাফরের ষড়যন্ত্রে ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হন।
১৭৫৭ সালে ২৩ জুন রণাঙ্গনে সিরাজউদ্দৌলার প্রধান সিপাহশালার মীরজাফরের কূটচাল আর নিষ্ক্রিয়তায় বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অসত্মমিত হয়। সেই থেকে মীরজাফর কোন নাম নয়। একটি ধিক্কৃত শব্দ। বেইমান-বিশ্বাসঘাতকদের গালি দিতেই ব্যবহৃত হয় 'মীরজাফর'। প্রায় দু'শ' বছর (১শ' ৯০ বছর) ব্রিটিশ আর পাকিসত্মানী গোলামির জিঞ্জির ভেঙ্গে বি১শ্ব মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু স্বাধীনতার অল্পকাল পরেই বাঙালীর মুক্তির মহান জাদুকর, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ঠিক আগমুহূর্তে অক্টোবর-নবেম্বর মাসে বাংলাদেশকে পাকিসত্মানের ফেডারেল স্টেটে রূপ দেয়ার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হওয়ার পর ভিন্ন পথ অবলম্বন করেন আরেক খুনী। মীরজাফরীয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের প্রতু্যষে ধানম-ির ৩২ নম্বর বাড়িতে রক্ত স্রোত বইয়ে দেয়ার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে কাজ করে খুনী মোশতাক। সেই থেকে খন্দকার মোশতাক বাংলাদেশে একটি ধিক্কৃত শব্দ। বেইমান বিশ্বাসঘাতকদের গালির সমর্থক শব্দ হিসেবে পরিচিতি পায়। মীরজাফরের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে রাজবলস্নভ, জগত শেঠ, উমিচাঁদ, ঘসেটি বেগম আর লর্ডকাইভ 'সিরাজউদ্দৌলা উপাখ্যানের' অন্যতম খল চরিত্র। ৭৫-এর বিয়োগানত্মক আগস্ট ট্র্যাজেডিতে খুনী খন্দকার মোশতাক মুখ্য পরিকল্পনাকারী হলেও নেপথ্যে থাকা খল চরিত্রগুলোও শেষ পর্যনত্ম পর্দার অনত্মরালে থাকতে পারেননি। গত তিন দশকের রাষ্ট্র-রাজনীতিতে হত্যা,কু্য আর ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতায় তারা নিজেদের কর্মগুণে (!) যথার্থ পরিচয়ে তুলে ধরেছেন।
আজ জনে-জনে কথা হচ্ছে, 'ধর্মের কল বাতাসে নড়ে'। খুনীরা শত ৰমতাশালী হোক-শাসত্মি তাদের ভোগ করতেই হয়। মীরজাফরের যেমন করম্নণ পরিণতি হয়েছে, ঠিক একই পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের। ১৯৯৬ সালে খন্দকার মোশতাক মারা গেলে ঢাকাবাসী ঢাকায় তাঁর জানাজা হতে দেয়নি। গ্রামের বাড়িতেও জানাজা হয়নি। মৃতু্যর পর খুনী মোশতাকের প্রতি যে ঘৃণা নিন্দা এবং ধিক্কার মানুষ দিয়েছে তাতে মোশতাক পুত্র পিতার কর্মে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছেন, 'এমন পিতার ঔরসে যেন আর কোন সনত্মানের জন্ম না হয়।' চায়ের টেবিলে, ফুটপাথে পানের দোকানে, পাড়া-মহলস্নায়, বাড়িতে-আড্ডায় সর্বত্র আলোচনা হচ্ছে,অতঃপর দেশ ন্যায়ের ধারায় ফিরে এলো। প্রতিষ্ঠিত হলো আইনের শাসন। কথা হচ্ছে মীরজাফরদের চিরনত্মন পরিণতি নিয়ে। খুনীদের দোসর ও বেনিফিশিয়ারি ছাড়া গোটা দেশের মানুষই প্রত্যাশিত ফাঁসির রায় কার্যকরে স্বসত্মির নিশ্বাস ফেলেছে। ইতিহাসের দায়মুক্তিতে আজ সবাই উলস্নসিত, আবেগতাড়িত। মৃতু্যঞ্জয়ী মুজিব আজ জীবন দর্শনে, অসত্মিত্ব, বিশ্বাস আর অনুভূতির টানে,বাঙালীর মুক্তির নিশ্বাসে, সমৃদ্ধ সোনার বাংলা বিনির্মাণে 'বাঙালীকে' যেন 'মানুষ' করে তুলেছে। সবুজ বাংলার সজীব ইতিহাসে চির অমরত্বের ভাষা আন্দোলন আর স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে ১৫ আগস্টের শোকাবহ মুজিব উপাখ্যানের নামই আজ 'বাংলাদেশ'। আগস্টের ট্র্যাজিক কাহিনীতে খুনী খন্দকার মোশতাক গং চিহ্নিত খল চরিত্র। জাতির পিতাকে হত্যা করে খুনের অভিশাপ চাপিয়ে দিয়ে কুলাঙ্গার মোশতাক গোটা দেশবাসীতে গত ৩৪ বছর একবুক যন্ত্রণায় ফেলে দেয়। তার চেয়েও সত্য, ন্যায়-সত্যের সংগ্রাম আর সংযমের পরীৰায় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে হতে হয়েছে কালজয়ী। প্রথম মেয়াদে ৰমতায় এসেই তিনি অস্বাভাবিক কোন প্রক্রিয়ায় খুনীদের ফাঁসি না দিয়ে আইনের স্বাভাবিক পথ বেছে নিয়ে অনুপম দৃষ্টানত্ম স্থাপন করেছেন।
স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় থেকেই মোশতাক পাক-মার্কিনপন্থী হিসেবে পরিচিতি পান। মুজিবনগর সরকারকে তিনি মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ঠিক আগমুহূর্তে পাকিসত্মানের সঙ্গে কনফেডারেশন গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু অস্থায়ী মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরম্নল ইসলাম খন্দকার মোশতাকের এই চক্রানত্ম প্রতিহত করেন খুবই দৰতার সঙ্গে। ১৯৭১ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু কবিগুরম্নকে উদ্দেশ করে বাঙালীকে মানুষ করার কথা বলেছিলেন। সেদিন তাঁর হৃদয়ের বিশালতা এখানে মীরজাফরের অসত্মিত্বের কথা ভুলিয়ে দিয়েছিল! নাকি বাঙালী তাঁর কোন ৰতি করতে পারে না-তার এই বিশ্বাস পরাজিত হলো ? খুনী মোশতাকের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর একটি বিপথগামী দল সেদিন গোটা জাতির বিশ্বাসের সঙ্গে বেইমানি করেছিল। ৭৫-এর ১৫ আগস্টে এশার আজানের ধ্বনির সময় ধানম-ির ৩২ নম্বর বাড়ির গঙ্গাস্রোত দেশবাসীর যখন বাষ্পরম্নদ্ধ রক্তৰরণ ঘটাচ্ছে তখন খন্দকার মোশতাক স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি হন। সকাল থেকে নিজেকে স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি দাবি করলেও বিকেলে মোশতাক শপথ নেন এবং তাঁর শপথ বাক্যগুলো ছিল পাকিসত্মানী শাসকগোষ্ঠীর দেয়া বক্তব্যের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা ঢাকার সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফ জীবদ্দশায় স্মৃতিচারণ করে বলেছেন 'বঙ্গবন্ধু দুপুরে খাবারের পর যে পুকুর পাড়ে বসে মাছকে খাবার দিতেন সেখানে মোশতাক এলেই নাকি মাছগুলো খাবার ছেড়ে চলে যেত। তখন বঙ্গবন্ধু নাকি ঠাট্টা করে বলতেন-মাছগুলোও তোকে চিনে ফেলেছে।'
মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ'র গোপন দলিলে বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে মোশতাকের মুখ্য ভূমিকা পালন, জেনারেল জিয়ার সেনাপ্রধান এবং পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি হওয়ার পেছনে আগস্ট ট্র্যাজেডিতে মৌন সমর্থন, হত্যা, কু্য, ষড়যন্ত্রের রাজনীতি, জাতির জনককে সপরিবারে হত্যার বিচার আইন করে বন্ধ করে দেয়া আর খুনীদের পুনর্বাসনের ঘটনা ঠিক লর্ড কাইভের হাত ধরে মীরজাফরের সিংহাসনে আসন গ্রহণ করার মতোই চিত্রিত হয়েছে। পৈশাচিক হত্যাকা-ের মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মীরজাফর খন্দকার মোশতাক কতর্ৃক জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান নিয়োগ, আত্মস্বীকৃত খুনীদের নিরাপদে দেশত্যাগের সুযোগ দেয়া, তাদের রৰা করতে ইনডেমনিটি জারি, ৭ নবেম্বর কথিত বিপস্নবের নামে সামরিক শাসন দিয়ে ৰমতা দখল, জাতীয় সংসদে ইনডেমনিটি আইন পাস করে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার বন্ধ করে দেয়া, এরপর বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনীদের পুরস্কৃত করা, একাত্তরের ঘাতক ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করা এবং যুদ্ধাপরাধীদের কারাগার থেকে মুক্ত করে দেয়া, কথিত বহুদলীয় রাজনীতির শরাবের পেয়ালা ডান-বামের হাতে ধরিয়ে দেয়া, বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে যুদ্ধাপরাধী চোর ডাকাত লুটেরা চোরাচালানীদের রাজনীতিতে পুনর্বাসন, জেনারেল জিয়ার দল গঠন স্পষ্টতই তুলে ধরছে-কারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে। আর হত্যাকারীদের উদ্দেশ্যইবা কি ছিল। সবকিছুই জলের মতো হয়ে ওঠে। এই হত্যাকা-ের যারা বেনিফিসিয়ারি তাদের গতিবিধি এবং কর্মকা- সম্পর্কে আজ আর কোন কিছুই অজানা নয়।
নবাব সিরাজউদ্দৌলা উপাখ্যানে মীরজাফরের কূটচাল যখন বাংলার ভাগ্যাকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা তৈরি করে তখন সিংহাসন ছেড়ে যাওয়ার সময় দাদুর কাছে মার্জনা প্রার্থনা করে সিরাজ বলেছিলেন, 'বাংলা বিহার উড়িষ্যার মহান অধিপতি নবাব আলীবর্দী খান, দাদু তুমি বলেছিলে ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীদের এদেশে প্রশ্রয় দিও না। আমি তাদের প্রশ্রয় দেব না, সৈন্য সমাবেশে তারা সৰম হবে না। কিনত্মু না...তোমার শেষ উপদেশ আমি রৰা করতে পারলাম না। দাদু, তুমি আমাকে মার্জনা কর-ৰমা কর।' সিংহাসন ত্যাগের মুহূর্তে সিরাজ প্রতিশ্রম্নতি রৰায় ব্যর্থতার জন্য মার্জনা চেয়েছেন। ষড়যন্ত্রকারীদের কূটচালে পরাজয়ের পর মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন সিরাজ। কিন্তু পাকিসত্মানী ষড়যন্ত্র কিংবা বাংলাদেশের বিপথগামী একদল সৈনিকের বুলেটের সামনেও মাথা নোয়াননি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পাকিসত্মানের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে মৃতু্যকে আলিঙ্গন করেছেন কিন্তু বাঙালীর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেননি। বাঙালীর মুক্তির প্রশ্নে তিনি ছিলেন আপোসহীন-অনড়। শুধু তাই নয়, খুনীদের বুলেটের মুখে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছেন, 'কি চাও তোমরা? বাংলার বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করবে?' বঙ্গবন্ধুর সামনে উপস্থিত রাইফেল হাতে রাখা ঘাতকের হৃদকম্পন বাড়িয়ে দিয়েছিল। খুনী মোশতাক চক্র মৃত মুজিবকেও এতটাই ভয় পেত ঢাকায় তাঁকে সমাহিত না করে টুঙ্গিপাড়ায় তাঁকে সমাহিত করেন। খুনীর দুর্বল চিত্ত নিত্যপ্রায়শ্চিত্তে দগ্ধ হয় দহন যন্ত্রণায়। যে কারণে জীবদ্দশায়ই মোশতাক মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন। বাড়ির বাইরে বেরিয়ে পৃথিবীর আলো-বাতাসমুক্ত নিশ্বাস নিতে পারেননি।
দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের ১২ নবেম্বর কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি সংসদে বাতিল হবার পরই বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথে প্রশসত্ম হয়। এই দিনই জাতীয় সংসদে হত্যাকা-ের বেনিফিশিয়ারি বিএনপি-জামায়াত অনুপস্থিত থাকলেও জাতীয় পার্টি সদস্যরা উপস্থিত ছিল এবং ইনডেমনিটি রহিত করতে জাতীয় পার্টি সমর্থন দেয়।

No comments

Powered by Blogger.