ফাঁসি যেভাবে কার্যকর হলো

 বুধবার বেলা আড়াইটায় বঙ্গবন্ধুর ৫ খুনীর আত্মীয়স্বজনকে ডেকে পাঠানো হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে খুনীদের আত্মীয়স্বজনরা কারাগারে গিয়ে খুনীদের সঙ্গে সাৰাত করেন। সাৰাতের পরই পুরো চেহারা পাল্টে যায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে।
বিকেলে খুনীদের ডা. রথীন্দ্রনাথ কু-ু ও শামসুদ্দিনসহ সঙ্গীয় এ্যাসিসটেন্টরা চেকআপ করেন। ফাঁসির মঞ্চ সকাল থেকেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভিতরে দু'টি ফাঁসির মঞ্চ প্রস্তুুতির কাজ শুরম্ন হয়। নির্বাচিত ৩৫ জলস্নাদ আরাম আয়েশে খাওয়াদাওয়া সেরে খোশগল্প করছিল। সন্ধ্যায় জলস্নাদরা যায় ফাঁসির মঞ্চের দিকে। ফাঁসির মঞ্চে দ-িতকে দাঁড় করানোর জন্য আনা হয় কাঠের পাটাতন। মঞ্চের চারদিকে হ্যালোজেন লাইট লাগানো হয়। দিনের মতো ঝকঝক করতে থাকে ফাঁসির মঞ্চ ও আশপাশের এলাকা। রাত ১০টার পর জলস্নাদরা ফাঁসি কার্যকর করার বিষয়ে কসরত করে। এরপর জলস্নাদরা আবার চলে যায়। আরাম আয়েশ করে। আধ ঘণ্টা পর আবার ফাঁসির মঞ্চে আসে জলস্নাদরা। মঞ্চের কপিকল চেক করা হয়। লিভার লাগানো হয়। মঞ্চের চারদিকে সারি সারি চেয়ার রাখা হয়। এসব চেয়ারে মঞ্চে উপস্থিতদের মাঝে মাঝে বসে আরাম করার নিয়ম রয়েছে।
ফাঁসির মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন যাঁরা
এদিকে ফাঁসির মঞ্চে আগে থেকেই উপস্থিত হন ঢাকা জেলার ডিসি জিলস্নার রহমান, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার একেএম শহীদুল হক, ঢাকা জেলার ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন মুশফিকুর রহমান, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অমিতাভ সরকার, কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আশরাফুল ইসলাম খান, অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিন, কারা উপমহাপরিদর্শক গোলাম হায়দার, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারগারের সিনিয়র জেল সুপার তৌহিদুল ইসলাম, জেলার ও ডেপুটি জেলারসহ উর্ধতন কারা কর্মকর্তারা।
খুনীদের ফাঁসিতে ঝোলানোর সংবাদ পেঁৗছে দেয়া
রাত সাড়ে ৮টার দিকে খুনীদের সেলে সেলে ভাল খাবার পাঠানো হয়। খাবার খেয়ে খুনীরা আরাম করছিল। রাত ১০টায় উর্ধতন কারা কর্মকর্তারা খুনীদের সেলে প্রবেশ করে খুনীদের আজ রাতেই ফাঁসি কার্যকর করা হবে জানান। খুনীদের শেষ ইচ্ছার কথা জানতে চান কারা কর্মকর্তারা। খুনীরা কোন ইচ্ছার কথাই জানায়নি। এ সময় খুনীদের চোখেমুখে ভয় ছড়িয়ে পড়ে। খুনীদের মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়। এরপর খুনীদের তওবা পড়াবার জন্য সেলে প্রবেশ করেন মনির হোসেন। খুনীরা তওবা পড়ে। কেউ কেউ একা একাই পড়ে।
সেল থেকে যমটুপি ও হ্যান্ডকাফ পরিয়ে খুনীদের যেভাবে নিয়ে যাওয়া হয় ফাঁসির মঞ্চে
খুনীরা এরপর থেকে দোয়া দরম্নদ পড়তে থাকে। রাত ১২টা ৫ মিনিটে লে. কর্নেল (অব) ফারম্নক রহমান ও লে. কর্নেল (অব) শাহরিয়ার রশিদ খানের সেলে হ্যান্ডকাফ ও একটি করে যমটুপি হাতে নিয়ে প্রবেশ করে ৪ জলস্নাদ। দুই জলস্নাদ ঢোকে ফারম্নক রহমানের সেলে আর বাকি দুই জলস্নাদ ঢোকে শাহরিয়ার রশীদের সেলে। জলস্নাদ দেখেই চমকে ওঠে ফারম্নক রহমান। ফারম্নক রহমান প্রাণে বাঁচতে সেলের ভেতরে দৌড় দেয়। চিৎকার-চেচাঁমেচি করতে থাকে। হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে ফারম্নক রহমান। পরে তাকে জাপটে ধরে জলস্নাদরা। জলস্নাদরা জোর করে তাকে যমটুপি পরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। এ সময় যমটুপি পরতে চায়নি ফারম্নক রহমান। জোরে জোরে কাঁদতে থাকে ফারম্নক রহমান। যমটুপি পরানোর সঙ্গে হাতে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে দেয়া হয়।
শাহরিয়ার রশিদ জলস্নাদ দেখে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে যায়। হাউমাউ করে কান্নাকাটি করতে থাকে। জলস্নাদদের হাত থেকে বাঁচতে সেলের ভিতরে ছুটোছুটি শুরম্ন করে। পরে জলস্নাদরা শাহরিয়ার রশিদকে একপ্রকার জোর করে ধরে ফেলে। এরপর মাথায় কালো যমটুপি পরিয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে দু'হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে পিছনে বেঁধে দেয়। এরপর একপ্রকার টেনে নিয়ে জলস্নাদরা রওনা হয় ফাঁসির মঞ্চের দিকে।
পাশাপাশি দু'টো ফাঁসির মঞ্চে ফারম্নক রহমান ও শাহরিয়ার রশিদকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। এ সময় বাঁহাতে ঘড়ি ও ডানহাতে বিশেষ 'লাল রম্নমাল' নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার তৌহিদুল ইসলাম। দ-িতদের গলায় ফাঁসির রশি ঝুলিয়ে দেয়া হয়। সবকিছু ভালভাবে চেক করে নেয়া হয়। তারপর জলস্নাদদের জন্য বিশেষ সিগন্যাল পড়ে। সব ঠিক। তারপর আসে সেই বিশেষ মুহূর্ত। জলস্নাদের দৃষ্টি থাকে সেই বিশেষ রম্নমালের দিকে। রম্নমাল হাত থেকে ছেড়ে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে জলস্নাদ লিভারে টান দেয়। কার্যকর হয়ে ফাঁসি। এভাবেই প্রথম দফায় দু'জনের ফাঁসি কার্যকর হয় একসঙ্গে। দ্বিতীয় দফায় একেএম মহিউদ্দিন ও বজলুল হুদার ফাঁসি একসঙ্গে একই কায়দায় কার্যকর করা হয়। তবে এৰেত্রে নতুন রম্নমাল ব্যবহার করা হয়। নিয়মানুযায়ী এক রম্নমাল দিয়ে দু'জনের ফাঁসি কার্যকরের বিধান নেই। কিন্তু দু'জনের ফাঁসি একই সময়ে হলে সেৰেত্রে একটি রম্নমালে দু'জনের ফাঁসি কার্যকরের বিধান রয়েছে।
সর্বশেষে মহিউদ্দিন আহম্মেদ আর্টিলারিকে নিতে আসে দু'জলস্নাদ। জলস্নাদ দেখেই মহিউদ্দিন চিৎকার চেঁচামেচি করতে থাকে। এক পর্যায়ে জলস্নাদদের হাত থেকে পালাতে সেলের ভেতরে ছুটোছুটি করতে থাকে। পরে জলস্নাদরা মহিউদ্দিনকে ধরে। এরপর মহিউদ্দিনের মাথায় পরিয়ে দেয়া হয় যমটুপি। এরপর পরানো হয় কয়েদীর নতুন পরিষ্কার পোশাক। তারপর হ্যান্ডকাপ দিয়ে দু'হাত পিছনে বেঁধে ফেলা হয়। হাত বাঁধার পর কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে মহিউদ্দিন। মহিউদ্দিন বলে, আমাকে মাফ করে দেন। আমাকে জেল থেকে ছেড়ে দেন। আমার ভুল হয়ে গেছে। আপনারা আমাকে ছেড়ে দেন, আমি অনেক দূরে চলে যাব। আর কোন দিন এদেশে আসব না। মহিউদ্দিনের এমন ঝামেলায় ৰেপে যায় দু'জলস্নাদ। দু'জলস্নাদ বলেছে, রাসেলকে হত্যার সময় এভাবেই কেঁদে ছিল। তখন তোদের দয়ামায়া কোথায় ছিল! চল! আদালতের হুকুম কেউ তোকে বাঁচাতে পারবে না। আমরা বাঁচানোর কেউ না। এরপর জলস্নাদরা মহিউদ্দিনকে নিয়ে যেতে থাকে ফাঁসির মঞ্চের দিকে। মঞ্চের কাছাকাছি গিয়ে আরেক দফায় কেঁদেকেটে উপস্থিত কর্মকর্তাদের পায়ে পড়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। পরে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃতু্যদ- কার্যকর করা হয় আগের মতো করেই। এৰেত্রে আরেকটি বিশেষ লাল রম্নমাল ব্যবহার করা হয়।
আধাঘণ্টা পর পর জোড়ায় জোড়ায় দু'জন করে ৪ খুনীর এবং সর্বশেষ মহিউদ্দিনের মৃতু্যদ- কার্যকর হয়। পর্যায়ক্রমে ১০ ফুট গভীর চৌবাচ্চা থেকে মৃতদেহ তোলা হয়। এরপর সবার ঘাড়ের, দু'হাত ও দু'পায়ের রগ কেটে মৃতু্য নিশ্চিত করেন ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন। এর আগে রাত সাড়ে ১১টায় খুনীদের পরিবারে কারাবন্দী খুনীদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃতু্যদ- কার্যকরের বিষয় জানানো হয়।
সেই লাল রম্নমাল ও যমটুপি মোট ১২ জন জলস্নাদ বঙ্গবন্ধুর পাঁচ খুনীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃতু্য নিশ্চিত করে। ৫ খুনীর ফঁসি কার্যকর করতে ৩টি বিশেষ লাল রম্নমাল ব্যবহৃত হয়েছে। এসব রম্নমাল সিলগালা করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সংরৰণ করা হবে। রম্নমাল ৩টি রাখা হয়েছে বিশেষ প্যাকেটে। প্যাকেটের গায়ে যাদের ফাঁসি দিতে রম্নমালগুলো ব্যবহার করা হয়েছে সেসব খুনীর নাম লেখা রয়েছে। এছাড়া ৫ খুনীর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে কালো ৫টি যমটুপি। এসব যমটুপিও একই কায়দায় সংরৰণ করা হবে। এসব রম্নমাল ও যমটুপি আজীবন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সংরৰিত থাকবে।
খুনীদের লাশ গ্রামের বাড়ি পাঠানো হয় যেভাবে খুনীদের মৃতদেহ মৃতু্যকূপ থেকে তোলার পর গোসল করিয়ে চাপাতি দিয়ে কফিনে ভরা হয়। রাত দেড়টার দিকে সমসত্ম প্রক্রিয়া শেষ হয়। ৫ খুনীর মৃতদেহ কফিনে ভরা হয়। এরপর একে একে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ৫টি কফিন প্রবেশ করে। রাত দু'টোর দিকে একের পর এক খুনীদের মৃতদেহ কফিনে করে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে যার যার গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হয়।

No comments

Powered by Blogger.