ধর্ষণের ঘটনায় শঙ্কা বাড়ছে

সাম্প্রতিক সময়ে দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে টাঙ্গাইল ও পার্বত্য চট্টগ্রামে স্কুলছাত্রীর গণধর্ষণের ঘটনা দুটি। গত ৬ ডিসেম্বর টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার বোকারইদ গ্রামের একটি বাড়িতে তিন দিন আটকে রেখে ধর্ষণ করা হয় এক স্কুলছাত্রীকে।
আশঙ্কাজনক অবস্থায় মেয়েটিকে প্রথমে টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরবর্তী সময়ে অবস্থার অবনতি হলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মেয়েটি বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে চিকিৎসাধীন। কিন্তু দুর্বৃত্তদের হাত থেকে বাঁচতে পারেনি পার্বত্য চট্টগ্রামের কাউখালীর মেয়েটি। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় তাকে। জাতীয় সংসদ ভবন ও প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেন দেশের বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধি, নারীনেত্রী, সমাজসেবক ও আইনজীবীরা। এ সময় তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন সাধারণ মানুষ, তরুণ ও কিশোরীরা। এই দুটি ঘটনার পরও কয়েক দিনে ফরিদপুরে এক স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের পর হত্যা এবং মানিকগঞ্জে এক কলেজছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনা জনমনে শঙ্কা তৈরি করেছে। কিন্তু এর প্রতিকার কী? জানতে চেয়েছি বিশেষজ্ঞদের কাছে।

বাংলাদেশে ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড
শাহদীন মালিক, আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। ফলে এই আইনই শাস্তি প্রদানের জন্য যথেষ্ট। কিন্তু আইনজীবী হিসেবে আমি মনে করি, এই অপরাধ খুন, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের মতো নয়। ধর্ষণের আলামত সংগ্রহসহ পুরো তদন্তপ্রক্রিয়া পরিচালনা ও পর্যালোচনার জন্য বিশেষ দক্ষ দল গঠন করতে হবে। এই বিশেষ দক্ষ দলকে মানুষের আস্থা অর্জন করতে হবে। এ ছাড়া যিনি ধর্ষণের শিকার হন, তাঁকে যেন পরবর্তী সময়ে আর কোনো অস্বস্তিকর বা অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে না হয়, সে ধরনের পরিবেশ তৈরি করার দায়িত্বও এই বিশেষ দলকে নিতে হবে। অনেক সময় আলামত সঠিকভাবে না পাওয়ায় অপরাধী ছাড়া পেয়ে যায়। সে জন্য দ্রুত এ ধরনের দল গঠন করা জরুরি।

প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন
মালেকা বানু, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ
ধর্ষণের ঘটনায় প্রথমে ভিকটিমের শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। অপরাধীকে শনাক্ত করতে সঠিক তদন্ত ও বিচারপ্রক্রিয়া প্রয়োজন। এসব সঠিকভাবে হচ্ছে কি না, সে জন্য পর্যবেক্ষণ দল থাকতে হবে। সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে ধর্ষণের ঘটনাগুলো প্রতিরোধ করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন সমাজের প্রত্যেক মানুষের একাত্মতা। নারী-পুরুষনির্বিশেষে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের জনপ্রতিনিধিদের সচেতন ও কর্তব্যপরায়ণ হতে হবে। গণমাধ্যমকে আরও শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে হবে।

দৃষ্টান্তমূলক তদন্ত নিশ্চিত করতে হবে
শিরিন হক, সদস্য, নারীপক্ষ
ধর্ষণের ঘটনা নিরোধ করতে প্রথমে এ ধরনের ঘটনার পেছনের মূল বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে হবে। এটি দীর্ঘমেয়াদি সংগ্রাম। আমরা নীতিগতভাবে শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে না। কেননা, কঠিনতম শাস্তির চেয়ে সহিংসতা প্রতিরোধে শাস্তির নিশ্চয়তা বেশি জরুরি। সে কারণে দৃষ্টান্তমূলক তদন্ত ও সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করতে হবে। অপরাধী যে-ই হোক, সে যেন ছাড়া না পায়। পাশাপাশি নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। চিকিৎসক সাজিয়া আফরিনের মতো আর কোনো ঘটনা যেন না হয়, সে জন্য সব কর্মক্ষেত্র নারীর জন্য সুরক্ষিত করতে হবে। দিনে বা রাতে—সব সময়েই যেন নিরাপদ থাকেন নারীরা, সেই পরিবেশ তাঁদের দিতে হবে। আমাদের প্রতিবাদের ভাষার প্রতি খুব যত্নবান হতে হবে। সুচিন্তিত আন্দোলন করতে হবে।

জানতে হবে সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় কেন ঘটছে?
সারা হোসেন, আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
হঠাৎ করে ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে যাওয়া আশঙ্কার কথা। আইন আছে, ফলে শাস্তিও পাবে অপরাধী। এর আগে আমাদের খুঁজে বের করতে হবে, কেন ধর্ষণের ঘটনাগুলো বেড়ে যাচ্ছে। সামাজিক মূল্যবোধ ও মানবিকতার অভাব কেন দেখা দিচ্ছে। এর কারণ কী? এসব কারণ উদ্ঘাটন করতে পারলে সমস্যা অনেক কমে যাবে। কেননা, বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটলে তখন আমরা কিছুদিনের জন্য সচেতন হই, আন্দোলন করি, পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি করি। তারপর সব থেমে যায়। ধর্ষণের ঘটনাগুলো নিরোধ করার জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে মেয়েদের ওপর নানা ধরনের সামাজিক ফতোয়া আসতে পারে। মেয়েদের ঘরের বাইরে যাওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে। এগুলো কোনো সমাধান নয়, বরং মেয়েরা বাইরে বের হলে যেন তাঁদের চলার পথকে কেউ বাধাগ্রস্ত করতে না পারে, সেই নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.