বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

সৈয়দ সোহরাব অন্যান্য দিনের মতোই ছিল বৃহস্পতিবারের ভোরটি। সূর্য উঠেছে যথারীতি, ছিল পাখ-পাখালির কলকাকলি, বিদায় শীতে সূর্যের কিরণও বিলচ্ছিল উষ্ণতা। তারপরও এদিনের ভোরটি ছিল একটু আলাদা।
আলোর ঝিলিক যেন আগমনী বসনত্মে গাছের কচি পাতায় পড়ে দূ্যতি ছড়াচ্ছিল, পাখির কলকাকলি গীতিময় মাধুর্য নিয়ে কানে এসে বাজছিল, প্রকৃতির গাছগাছালিও বাতাসে দুলে দুলে যেন তাদের আনন্দ ছড়িয়ে দিচ্ছিল, ব্যসত্ম সড়ক দিয়ে দ্রম্নতবেগে চলে যাওয়া গাড়ির বিকট হর্নও যেন তবলার বোল হয়ে হৃদয়ে বেজে উঠছিল প্রতিটি বাঙালীর। আর এমনটি ঘটছিল, কারণ এদিন ছিল বাঙালীর সবচেয়ে খুশির দিন। জাতি হিসেবে নিজের কলঙ্ক মোচনের দিন। পিতা হত্যার বিচার পাওয়ার দিন। দীর্ঘ ৩৪ বছর পর স্বসত্মির নিঃশ্বাস ছাড়ল জাতি। দায়মুক্ত হয়ে শোকরানা নামাজও পড়ল অনেকে। জাতির কুলাঙ্গার সনত্মানদের ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় মিষ্টি খাওয়াসহ বিলিয়েছেও অনেকে। বুধবার গভীর রাতে ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর থেকেই হাজার হাজার মানুষের ঢল নামে ধানম-ির ৩২ নম্বরে। রাতেই বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীরা। আর বৃহস্পতিবার দিনভর সর্বসত্মরের মানুষের ভিড় ছিল বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে। আনন্দ মিছিলসহকারে অনেকে এসেছে ফুল দিতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগসহ সাধারণ ছাত্ররা বের করেছে আনন্দ মিছিল। অনেক পাড়া-মহলস্নাতে যুবলীগ বের করে আনন্দ মিছিল।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুলেল শ্রদ্ধা জানিয়ে সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী বলেন, প্রধানমন্ত্রী গতকাল (বুধবার) সারা রাত নামাজ পড়েছেন। আগামীকাল (আজ) ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। এদিন রাজধানীর রাসত্মায় টিভি বিক্রয়ের শো রম্নমগুলোতে খবরের সময় দীর্ঘ ভিড় দেখা গেছে। পত্রিকা স্ট্যান্ডগুলোতে পথচারীরা দাঁড়িয়ে পড়েছে ফাঁসি কার্যকর হওয়ার রিপোর্ট। সকলের চোখে-মুখে ছিল স্বসত্মির প্রকাশ। একে অন্যের সঙ্গে আলাপচারিতায় ফাঁসি কার্যকর হতে দেয়ায় বিগত বিএনপি-জামায়াত সরকারের সমালোচনাও করেন অনেকে। নগরীর মিষ্টির দোকানগুলোতে সকাল থেকেই মিষ্টি বিক্রির ধুম দেখা যায়। দুপুরের আগেই অনেক দোকানের মিষ্টি শেষ হয়ে যায়। কারও কারও বাড়িতে ভাল কিছু রান্না করে ফকির-মিসকিনকেও খাওয়ানো হয়। অনেক মসজিদে-মন্দিরে শোকরানা প্রার্থনাও আদায় করা হয়।
বুধবার রাত ১২ টা ৫ মিনিট থেকে ১ টা ৫ মিনিটের মধ্যে ৫ খুনীর ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এ সময় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার প্রাঙ্গণ ছিল লোকেলোকারণ্য। আশপাশের বাড়ির লোকজনরাও ছিল নির্ঘুম। প্রতিটি বাড়িতেই আলো জ্বলছিল। জানালায় ছিল নারী-পুরম্নষের জিজ্ঞাসু মুখ। কখন ফাঁসি কার্যকর হবে এবং কখন কুলাঙ্গারদের লাশবাহী এ্যাম্বুলেন্স বের হবে জেলখানা থেকে? ৩৪ বছর পর জাতি কলঙ্কমুক্ত হচ্ছে। এ সময় জেলখানার সামনে উপস্থিত থাকতে পেরে অনেকে নিজেকে ইতিহাসের অংশ হিসেবেই ভাবছে। এ সময় সেখানে উপস্থিত থাকা মালিবাগের এক যুবক হারম্নন জনকণ্ঠকে বলেন, আমার জীবন সার্থক। কারণ আমি সে সময় উপস্থিত ছিলাম এবং খুনীদের লাশবাহী এ্যাম্বুলেন্সে থুথুও মেরেছি। আমি যদি লাশটাকে জুতো দিয়ে পিটাতে পারতাম, তাহলে আমি আরও তৃপ্তি পেতাম। তবে হারম্নন না পারলেও দুই মহিউদ্দিনের লাশ তাদের গ্রামের বাড়ি গেলে গ্রামবাসী তাতে জুতো নিৰেপ করে এবং এলাকায় লাশ দাফন করতে না দেয়ার জন্য সেস্নাগানও দেয়।
এদিকে দেশবাসীর এখন আকাঙ্ৰা পলাতক বাকি আসামিদের ফাঁসি কার্যকর হলেই তাঁরা ফিরে পাবে সম্পূূর্ণর্ স্বসত্মি। তাই সরকারের কাছে দেশবাসীর দাবি, যত শীঘ্র সম্ভব পলাতক আসামিদের ধরে এনে রায়ের বাসত্মবায়ন ঘটানো হোক।

No comments

Powered by Blogger.