আবারও সুইস সিঙ্গাপুরের সেই সার! by রেজা রায়হান

প্রাক-জাহাজীকরণ পরিদর্শন (প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেকশন) এবং বৈধ জাহাজীকরণ দলিলপত্র (শিপিং ডকুমেন্ট) ছাড়াই সুইস সিঙ্গাপুর গত বছর ২৪ হাজার ৫৭৫ টন ইউরিয়া সার রপ্তানি করে। এটা ছিল ক্রয় চুক্তির লঙ্ঘন। সারও ছিল নিম্নমানের। ফলে বাংলাদেশ রসায়ন শিল্প সংস্থা (বিসিআইসি) ওই সার আর খালাস করেনি।


এরপর ১০ মাস এ সার চট্টগ্রাম বন্দরে খোলা আকাশের নিচে ফেলে রাখা হলে এর মানের আরো অবনতি ঘটে। তবে সারের রপ্তানিকারক সুইস সিঙ্গাপুর দীর্ঘদিনের চেষ্টার পর শিল্প মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করলে সম্প্রতি বিসিআইসি এ সার খালাসের সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে নিম্নমানের এ সার আবার সংবাদ শিরোনাম হয়।
গত মঙ্গলবার সংসদেও এ ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করা হয় এবং শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে সমালোচিত হন। তিনি একপর্যায়ে আশ্বাস দেন, সারের গুণগত মান পরীক্ষার জন্য যে কমিটি গঠন করা হয়েছিল সেই কমিটির সদস্যদের ১৬ সেপ্টেম্বর সংসদীয় কমিটির বৈঠকে উপস্থিত হতে বলা হবে। সূত্র মতে, এ কমিটিই ওই সার খালাসের পক্ষে সুপারিশ করে। যে প্রক্রিয়ায় এ সার আমদানি করা হয়েছে তা ১৯৯৯ সালের 'ফার্টিলাইজার কন্ট্রোল অর্ডার'-এর শর্তের পরিপন্থী বলে কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
২০১১-১২ অর্থবছরে বিসিআইসি ২০ লাখ টন আমদানি লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আন্তর্জাতিক দরপত্রের মা্যধমে আট লাখ টন ইউরিয়া সার আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয় এবং গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রতিটন ৫৮৪ ডলার দরে তিন সরবরাহকারীর সঙ্গে এক লাখ টন ইউরিয়া আমদানির চুক্তি হয়। সুইস সিঙ্গাপুরের সঙ্গে ২৫ হাজার টন ইউরিয়া সরবরাহের চুক্তি হয়। চুক্তির পরপরই গত বছরের ১৭ নভেম্বর হংকংয়ের পতাকাবাহী এমভি মিং ইউয়ান জাহাজ ২৪ হাজার ৫৭৫ টন ইউরিয়া সার নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছায়। ২৭ নভেম্বর থেকে সার খালাস শুরু হয়। বিসিআইসির অভ্যন্তরীণ পরিবহন ঠিকাদার সারের বস্তা মানসম্মত না হওয়ায় তা গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করলে ২৮ নভেম্বর সকাল ৬টায় খালাস বন্ধ হয়ে যায়। পরে ৩০ নভেম্বর বিসিআইসির চট্টগ্রাম অফিসের দুই কর্মকর্তা শিপিং এজেন্ট, পরিবহন ঠিকাদার ও সার্ভেয়ারের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে এমভি মিং ইউয়ান জাহাজ পরিদর্শনে গিয়ে সাদা, হলুদ ও ক্রিম- এই তিন ধরনের সারের বস্তা দেখতে পান। এর ৯৮ শতাংশই হলুদ রঙের বস্তা। তাঁরা দেখতে পান, সব বস্তার এক পাশে চীনা ভাষায় কিছু লেখা (মার্কিং), অন্য পাশে কোনো লেখা ছিল না। এই খালি অংশে সার খালাসকারী কম্পানির লোকেরা কালো কালিতে ইংরেজি ভাষায় শিপিং মার্ক লাগাচ্ছিল, যা ধুলা-ময়লা ও শ্রমিকদের পায়ের দ্বারা বিবর্ণ হয়ে পড়ছিল। এ ছাড়া অনেক বস্তায় হাতে রাবার ও প্লাস্টিক সুতা দ্বারা এবং কিছু বস্তা সাধারণ সুতা (ছয় পার্ট) দ্বারা সেলাই দেখা যায়। জাহাজের চারটি হ্যাচ থেকে নেওয়া ২৪টি বস্তার মধ্যে ১৮টির ওজন সঠিক ৫০ কেজি, তিনটির ওজন এক থেকে তিন কেজি বেশি এবং বাকি তিনটির ওজন মাত্র ৩৭ কেজি পাওয়া যায়। তবে সাদা খালি বস্তায় ইংরেজি মার্কিং দেখা যায়।
সি ওয়ার্ল্ড সার্ভেয়ার নামের একটি প্রতিষ্ঠানও বিসিআইসিকে একই ধরনের তথ্য জানিয়ে বলেছে, ভালো বস্তার ওজন ৫০ কেজির কম এবং কিছু ব্যাগ পরে সেলাই করা হয়েছে।
ভিয়েতনামের হাইপোং বন্দর থেকে জাহাজে তোলা এই ইউরিয়া চীনের বলে দাবি করা হয়। তবে একই জাহাজে তিন রঙের বস্তা ও চীনা ভাষায় মার্কিং থাকার কারণে সংশ্লিষ্টরা ধারণা করেন, গত বছর চীন সরকার সার রপ্তানিতে ১১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে। এরপর শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার জন্যই বিভিন্ন ফ্যাক্টরির চীনা ইউরিয়া চোরাই পথে ভিয়েতনামে এনে জাহাজীকরণ করা হয়েছে। এ জন্যই প্রাক-জাহাজীকরণ পরিদর্শন এড়িয়ে যাওয়া হয়। একই কারণে জাহাজটিতে বৈধ জাহাজীকরণ দলিলপত্রও (শিপিং ডকুমেন্ট) ছিল না। ফলে পরে জাল কাগজপত্র দাখিল করা হয়। এরপর বিতর্কিত এ সারের মান যাচাই ও বৈধতার বিষয় তদন্তে একটি কমিটি গঠন করা হয়।
সূত্র মতে, গত বছরই এ সার খালাস শুরুর জন্য বিভিন্ন মহল থেকে বিসিআইসিকে চাপ দেওয়া হয়।

No comments

Powered by Blogger.