খোলা চোখে- আমেরিকায় নির্বাচন: ছি ছি এত্তা জঞ্জাল (৩) by হাসান ফেরদৌস

ইংরেজ নাট্যকার টম স্টপার্ড একবার বলেছিলেন, গণতন্ত্রের অর্থ ভোট দেওয়া নয়, বরং যে ভোট দেওয়া হলো, তার গণনার নিশ্চয়তা। অন্য কথায়, ভোট না হয় দিলাম, কিন্তু সে ভোট যদি না গোনা হয়, তা হলে সে ভোটের আর মূল্য কী?


স্টপার্ডের এ কথা সম্ভবত ২০০০ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর বলা। পাঠকদের মনে থাকার কথা, সেবার ফ্লোরিডায় জর্জ বুশ ও আল গোরের মধ্যে ভোট গোনা নিয়ে এক মহাকেলেঙ্কারি হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের বিতর্কিত সিদ্ধান্তে বুশকে নির্বাচিত বলে ঘোষণা করা হয়। বিতর্কিত, কারণ বুশ সত্যি সত্যি গোনা ভোটে জিতেছিলেন, না যাঁরা ভোট দিয়েছেন কিন্তু ভোট হিসাবে ধরা হয়নি, সেই কারচুপির জোরে জিতেছেন, সেই তর্ক এখনো শেষ হয়নি।
ভোট গোনা নিয়ে সে কারচুপি ছিল এক যুগ আগের কথা। এ বছর নভেম্বরে এ দেশের মানুষ তাদের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করবে। কারচুপির ভয় যে এবার নেই তা নয়, কিন্তু তার চেয়েও বড় ভয় নির্বাচকেরা সবাই আদৌ ভোট দিতে পারবেন কি না। ভোট দিতে পারলে তবেই না প্রশ্ন উঠবে ভোট গণনার। এ দেশে যেসব অঙ্গরাজ্যে রিপাবলিকান পার্টি এখন ক্ষমতায়, তারা আদা জল খেয়ে নেমেছে যেভাবেই সম্ভব প্রতিপক্ষ ডেমোক্র্যাটদের ভোটকেন্দ্রে যাওয়া আটকাতে। সে জন্য নতুন ভোটার আইডেনটিটি কার্ড বানানোর চেষ্টা চলছে, ছুটির দিনে আগাম ভোটের নিয়ম বাতিল হচ্ছে, ডাকে ভোট দেওয়ার পুরোনো নিয়মেও পরিবর্তনের চেষ্টা হচ্ছে।
এসব চেষ্টার আসল লক্ষ্য একটাই: যেভাবে সম্ভব ডেমোক্র্যাটদের বিজয় ঠেকানো। এই নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন তো হবেই। তা ছাড়া প্রতিনিধি পরিষদের ৪৩৫ আসনে ও সিনেটের ১০০ আসনের এক-তৃতীয়াংশের জন্য নির্বাচন হবে। এখন পর্যন্ত জনমত গণনার হিসাব অনুসারে, প্রেসিডেন্ট পদের প্রতিযোগিতায় ডেমোক্রেটিক দলীয় প্রার্থী বারাক ওবামা সামান্য কয়েক পয়েন্টে এগিয়ে। সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদে অবশ্য হিসাবটা উল্টো, সেখানে রিপাবলিকানরা দৌড়ে এগিয়ে, তবে সামান্য ব্যবধানে। এখন রিপাবলিকানদের চেষ্টা হচ্ছে, হয় এই সামান্য ব্যবধান বাড়ানো, নয়তো প্রতিপক্ষ ডেমোক্র্যাটদের ভোটের বাক্সে ভোটের পরিমাণ কমানো। এই কাজটা সম্পন্ন করার বিশেষ দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন রিপাবলিকান পার্টি নিয়ন্ত্রিত অঙ্গরাজ্যের গভর্নর ও রাজ্য আইন পরিষদসমূহ।
বেআইনি কোনো কাজ নয়, কাগজ-কলমে পুরোদস্তুর আইনমাফিকই সব কাজ হচ্ছে। রিপাবলিকানরা দাবি তুলেছেন ভোটার তালিকায় অনেক ভুল রয়েছে। যাঁরা আইনসম্মতভাবে ভোট দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন না—যেমন অপরাধী হিসেবে সাজাপ্রাপ্ত বা অবৈধ অভিবাসী, তালিকায় তাঁদের নাম ঢোকানো হয়েছে। এর ফলে ভোটের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক অধিকারের অপব্যবহারের আশঙ্কা রয়েছে। তা যাতে না হয় সে জন্যই তাঁরা নানা রকম আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছেন।
শুনলে মনে হবে খুবই নিরীহ প্রস্তাব। যেমন, ওহাইও ও পেনসিলভানিয়ায় আইন হয়েছে ভোট দিতে হলে প্রত্যেককে কোনো না কোনো সরকারি পরিচয়পত্র দেখাতে হবে। এত দিন এই পরিচয়পত্রের প্রয়োজন ছিল না, যে কেউ ভোটার তালিকা অনুযায়ী নিজের নাম শনাক্ত করে ভোট দিতে পারতেন। শহরাঞ্চলে অধিকাংশ মানুষেরই কোনো না কোনো পরিচয়পত্র রয়েছে। কিন্তু গ্রামাঞ্চলে বা নগরকেন্দ্র থেকে দূরে যাঁরা থাকেন, তাঁদের অনেকের কোনো ভোটার পরিচয়পত্র নেই। এসব মানুষের অধিকাংশ হয় বৃদ্ধ, সংখ্যালঘু অথবা অত্যন্ত দরিদ্র। নিজের পকেটের পয়সা খরচ করে, প্রায় পুরোটা দিন ব্যয় করে শহরে এসে পরিচয়পত্র সংগ্রহ করার মতো পর্যাপ্ত অর্থ, সময় অথবা শারীরিক ক্ষমতা তাঁদের অনেকের নেই। এসব মানুষের অধিকাংশই ঐতিহ্যগতভাবে ডেমোক্র্যাটদের ভোট দিয়ে থাকেন। ফলে, আইনি মারপ্যাঁচে যদি তাঁদের পরিচয়পত্র না থাকার কারণে ভোট দেওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা যায়, তা হলে রিপাবলিকানরা সুবিধাজনক অবস্থায় যাওয়ার সুযোগ পান। এ বছরের গোড়ার দিকে পেনসিলভানিয়ার আইন পরিষদে ভোটার পরিচয়পত্র আইন পাস হলে সে রাজ্যের আইনসভার রিপাবলিকান সদস্য মাইফ টুরজাই হাটে হাঁড়ি ভেঙে বলেছিলেন, ‘মিট রমনির জেতার জন্য একটা ব্যবস্থা পাকা করা গেল।’
এ তো গেল এক সমস্যা। কোনো কোনো রাজ্যে এত দিন নিয়ম ছিল নির্ধারিত সময়ের আগে ভোটাররা চাইলে ভোট দিতে পারবেন। কোথাও কোথাও নির্ধারিত সময়ের বেশি ভোট গ্রহণের রেওয়াজ ছিল। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সংখ্যালঘু বা দরিদ্র মানুষ কাজের সময় বাদ দিয়ে তাঁদের সুবিধামতো সময়ে ভোট দিয়ে থাকেন। ভোট প্রদানের সময় যদি দীর্ঘায়িত করা হয়, তা হলে তাঁদের সুবিধা হয়। এখন সেসব বন্ধের পাঁয়তারা চলছে।
ডেমোক্র্যাটরা তো বটেই, নিরপেক্ষ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, আমেরিকায় কোথাও মিথ্যা পরিচয় দিয়ে বা বেআইনিভাবে একাধিক ভোট দেওয়ার কোনো প্রমাণ নেই। এ দেশের আইনে মিথ্যা ভোট দেওয়ার সাজা হচ্ছে পাঁচ বছরের জেল, সঙ্গে সঙ্গে ১০ হাজার ডলার জরিমানা। মাত্র একটা ভোটের জন্য এমন দুষ্কর্ম কেউ করবেন বলে মনে হয় না। ২০০০ সালের পর ভোট কারচুপি নিয়ে বিস্তর জল ঘোলা হয়েছে। নানা রাজ্যে এ নিয়ে সরু চিরুনি দিয়ে দেখার চেষ্টা হয়েছে, আসলে কী পরিমাণ জাল ভোট রয়েছে। দেখা গেছে, সে রকম ভোটের পরিমাণ এত সামান্য যে এ নিয়ে নতুন আইন পাসের কোনো কারণ নেই। সম্প্রতি ডেমোস ও কমন কজ এই নামের দুটি সংস্থা ভোট কারচুপি নিয়ে দীর্ঘ এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তারা জানিয়েছে, দু-চারটি জাল ভোট আটকানোর জন্য এখন যেসব আইন প্রস্তাব করা হচ্ছে, তার ফলে কোনো কোনো রাজ্যে লাখ লাখ লোক ভোট দেওয়া থেকে বঞ্চিত হবেন।
আসলে কী পরিমাণ জাল ভোট হয়, তার গোটা কয়েক উদাহরণ তারা দিয়েছে। ২০০৪ সালে ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্যের গভর্নর নির্বাচনে জাল ভোটের পরিমাণ ছিল শূন্য দশমিক ০০০৯ শতাংশ। একই বছরে ওহাইওতে জাল ভোটের পরিমাণ ছিল মাত্র শূন্য দশমিক ০০০০৪ শতাংশ। বছরে ঠিক এই পরিমাণ মানুষের এ দেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর আশঙ্কা রয়েছে। রিপাবলিকান প্রতিপক্ষ কখনো কখনো মিথ্যা ভোটের যে প্রমাণপত্র দাখিল করেছে, দেখা গেছে সেসব আসলে সাজানো হিসাব। যেমন ২০০০ সালে মিসৌরি অঙ্গরাজ্যে ৭৯টি ভোটারের নামধাম দিয়ে বলা হয়েছিল, যে ঠিকানায় তাঁরা থাকেন বলা হয়েছে, আসলে সেখানে কেউ থাকেন না। কিন্তু পরে যখন সরেজমিনে তদন্ত হলো, দেখা গেল সেসব মানুষ ঠিকই সেখানে থাকেন। আবার বালটিমোরে মৃত মানুষের নামে ভোট পড়েছে বলে দাবি করার পর যখন তদন্ত হলো, দেখা গেল তাঁরা জীবিত, তাঁদের নামে কোনো প্রমাণিত অপরাধও নেই।
সোজা কথায়, ভোট কারচুপির ব্যাপারটা নেহাতই অতিরঞ্জিত। যদি ভোটার তালিকায় কোনো ভুল থেকেই থাকে—যা অসম্ভব নয়—তা ইচ্ছাকৃত বা পরিকল্পিত নয়। দুই প্রধান দলের পক্ষ থেকেই ভোটের আগে আগে দ্বারে দ্বারে গিয়ে ভোটার তালিকাভুক্ত করার নিয়ম রয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয় স্বেচ্ছাসেবকেরা, নয়তো রাজনৈতিক দলের তরুণ কর্মীরা এ কাজটি করে থাকেন। ফলে ভোটার ফরম পূরণ করার সময় ভুলভ্রান্তি থেকে যাওয়া অসম্ভব নয়। তা সংশোধনেরও নিয়ম আছে। তার পরও যদি ভুল থেকে যায়, তা সংখ্যায় এমন বিপুল নয় যে নতুন করে এমন আইন করতে হবে, যার ফলে ন্যায্য ভোটার ভোট দেওয়া থেকে বাদ পড়বেন। কেউ একজন ঠাট্টা করে বলেছেন, ভোটার কারচুপির চেয়ে উড়ন্ত সসারের সংখ্যা বেশি হবে।
সিবিএস টিভি কিছুদিন আগে পেনসিলভানিয়ায় নতুন ভোটার পরিচয়পত্র আইন পাস হওয়ার পর একটি তদন্তমূলক অনুষ্ঠান পেশ করে। তাতে ৯৪ বছর বয়স্ক এক নারী বলেছেন, ‘আমি প্রতিটি নির্বাচনে ভোট দিয়ে এসেছি। কিন্তু এবার ভোট দিতে পারব না। কারণ, আমার ড্রাইভিং লাইসেন্স বা সরকারি কোনো পরিচয়পত্র নেই।’ শুধু পেনসিলভানিয়া নয়, ভোট কারচুপি রোধে নতুন আইন করেছে এমন ১০টি অঙ্গরাজ্যে তদন্ত শেষে সিবিএস জানিয়েছে, গত জাতীয় নির্বাচনে জাল হয়েছে এমন ভোটের সংখ্যা মাত্র ৭৯। লাখ লাখ ভোটের মধ্যে এই সামান্য কটি ভোটের কারচুপি ঠেকাতে এখন যদি নতুন করে আইন করা হয়, যার ফলে অনেক বেশি মানুষ ভোট দেওয়া থেকে বঞ্চিত হবেন, গণতন্ত্রের জন্য তা হবে অনেক বড় হুমকি।
পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই ভোট দিতে হলে কোনো না কোনো পরিচয়পত্র দেখাতে হয়। তাই ভোটার পরিচয়পত্র নিয়ে এই বিতর্ক তাঁদের কাছে কিছুটা অবান্তর মনে হতে পারে। বাংলাদেশেও ভোট দিতে হলে সরকারি পরিচয়পত্র দেখাতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই ভোটার পরিচয়পত্র বানানোর দায়িত্ব সরকারের। এ জন্য বাজেটে আলাদা অর্থ বরাদ্দ করা হয়, সে কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ করার জন্য নির্বাচন কমিশন নিজস্ব কর্মসূচি প্রণয়ন করে। কিন্তু এ দেশে পরিচয়পত্র বানানোর দায়িত্ব ভোটারের নিজের। সমস্যাটা হলো এখানেই। ৯৪ বছরের বুড়ি, তাঁর এমন কী দায় পড়েছে যে নিজের বাড়ি থেকে ৭০ মাইল দূরে শহরে এসে, চার ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে ভোটার পরিচয়পত্র বানাবেন? যেতে-আসতে যে রাহা খরচ চাই, তা-ই বা দেবে কে? আমেরিকাকে অনেকে গণতন্ত্রের মহাস্বর্গ বলে ভাবেন। আমরা কথায় কথায় আমেরিকার উদাহরণ দিই, তার মুক্ত তথ্যব্যবস্থা ও উন্নত আইনের শাসনকে পৃথিবীর জন্য মডেল বলে ভাবি। অথচ সত্যি কথাটা হলো, এ দেশে বরাবরই মানুষের ভোট কেড়ে নেওয়ার নানা চেষ্টা হয়েছে। ৫০ বছর আগেও এ দেশে কালো মানুষের ভোটের অধিকার ছিল না। ভোটের অধিকার ছিল না আদিবাসীদের, এমনকি নারীদের। আয়কর না দিলে বা নিজস্ব বাড়িঘর না থাকলে ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হতো। ইহুদিদেরও নানাভাবে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা হয়েছে। যেমন, নিউইয়র্কে একসময় শুধু শনিবারে নিজের নাম ভোটার তালিকাভুক্ত করা যেত। উদ্দেশ্য, ইহুদিদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা। কারণ, শনিবার ধর্মপ্রাণ ইহুদিদের মধ্যে প্রার্থনা ছাড়া আর কিছু করার রীতি নেই।
ভোট কেড়ে নেওয়ার সেই পুরোনো ট্র্যাডিশন এখনো যে চলছে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এই চেষ্টা যেমন হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদও হচ্ছে। এ দেশে ভোটাধিকার সংরক্ষণ আইন রয়েছে, যা ব্যবহার করে রাজনৈতিক দল বা নাগরিক গোষ্ঠীসমূহ পাল্টা আইনি ব্যবস্থা নিতে পারে। ওবামা প্রশাসনের বিচার বিভাগ ইতিমধ্যে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে গৃহীত আইনের বিরুদ্ধে আদালতের হস্তক্ষেপ চেয়েছে। কোনো কোনো রাজ্যে সাময়িকভাবে হলেও এসব আইন বাস্তবায়ন ঠেকানো সম্ভব হয়েছে। নির্বাচনের মাত্র পৌনে দুই মাস বাকি। এরই মধ্যে সব সমস্যা মিটে যাবে বলে মনে হয় না। ফলে এমন হতে পারে যে নির্বাচনের পর তার ফল নিয়ে টানাহেঁচড়া শুরু হবে, কোথাও কোথাও তা গড়াবে আইন-আদালত পর্যন্ত।
১২ বছর পর আবারও সেই ফ্লোরিডা-কাণ্ড দেখতে হয় কি না, আমেরিকা এখন সে নাটকের অপেক্ষায়।

নিউইয়র্ক
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.