শোক- আপন ফিরেছে তার কড়ইতলায় by আলতাফ শাহনেওয়াজ

‘কী রে...’। ওকে এই ছোট্ট বাক্যটি লেখার পর ওপাশ থেকে ইংরেজি হরফে বাংলা লিখে সে জানাল উত্তরসমেত টুকরো একটি কথা, ‘আছি রে...তুই কই, কেমন আছিস?’ ফেসবুকে ওর সঙ্গে ইংরেজি হরফে বাংলা বাক্য চালাচালি করতে করতে আমার আঙুল ততক্ষণে তাঁকে লিখছে, ‘একদিন আড্ডা মারা যায় না?’ সে বলল, ‘যায়।


কিন্তু আমি তো এখন দূরে থাকি, বলতে গেলে দুনিয়ার বাইরে। শাহবাগে যাওয়া হয় না।’
এ মাসের ৪ তারিখে এভাবে আমাদের কথা চলছিল আঙুল মারফত। কেননা, একই শহরের বাসিন্দা হলেও কারোই এখন আর সময় মেলে না, যার যার ভুবনে ব্যস্ত আমাদের দেখা হয় না দীর্ঘদিন। অগত্যা তাই ফেসবুক চ্যাটিংয়ে আঙুল দাপিয়ে কথার লেজে কথা জুড়ে দিয়ে বলি, ‘একদিন অনেক আড্ডা মারব। দেখা হবে। ভালো থাকিস।’
এরপর আবার দিনের কর্মব্যস্ততা; তারপর শেষ রাতে ঘুম—হেরফের না হওয়া প্রতিদিনের মুখস্থ রুটিন।
প্রাত্যহিক অভ্যাসমতো শেষ রাতের দিকে ঘুমোতে গিয়েছিলাম গত মঙ্গলবারও। পরদিন বুধবার ঘুম থেকে জাগতেই মুঠোফোনে কবিবন্ধুদের বেশ কয়েকটি মিস্ড কল—তারিক টুকু, সফেদ ফরাজী, মেহেদী উল্লাহ। ফিরতি ফোন করলাম টুকুকে। ও-প্রান্ত থেকে ভেসে এল, ‘নয়ন, আপন নেই।’ সফেদকে ফোন দিলাম—‘হূদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে...আজ ভোর ছয়টায়।’ সফেদের কণ্ঠও ভেজা।
সদ্য ঘুম ভেঙে জেগে উঠে দুঃস্বপ্ন দেখছি নাকি! আমাদের বন্ধু কবি আপন মাহমুদ, মাত্র কদিন আগে নানা কথাচ্ছলে যে আমাকে লিখেছিল, ‘আমি তো এখন দূরে থাকি, বলতে গেলে দুনিয়ার বাইরে’; সে নেই! বুধবার ১২ সেপ্টেম্বর সত্যি সত্যিই দুনিয়ার বাইরে চলে গেছে আপন!
১৯৭৬-এর ১ জানুয়ারি জন্ম নেওয়া ওর বয়স এখন মাত্র ৩৬ বছর। আমরাও কেউ মাঝ বয়সে পৌঁছাইনি। তবু আমাদের সবাইকে এখনই স্মৃতি লিখতে হবে! স্মৃতি হাতড়ে এরপর যখন ওর কবিতা পড়ব, দেখব যে ও লিখেছে, ‘বিকেলে আমি নাও থাকতে পারি, নিজের ভেতর থেকে বেরিয়ে পড়তে পারি অযথায়—ঘোষণা ছাড়াই ছড়িয়ে পড়তে পারি দূরে অতীতে।’ আপন তবে আজ অতীত? অকস্মাৎ সবাইকে এতটা অপ্রস্তুত করলি কেন তুই?
কবিতা লিখতে লিখতে লক্ষ্মীপুরের কড়ইতলা গ্রাম থেকে এসেছিল। একইভাবে, গ্রামীণ মফস্বল ভেঙে এসেছিলাম আমরাও। ঢাকার মোকামে বুঝি সোনালি জীবন আছে—এই মোহে এ শহরে এসে দেখা হলো সবার। এরপর উত্তাল বন্ধুত্ব এবং হালকা-পাতলা শত্রুতাও। সেই বন্ধুত্ব ও শত্রুতার মাত্রা এতই গাঢ় যে পরস্পরকে সম্বোধনের ক্ষেত্রে আপনি-তুমি নয়, খুব দ্রুতই আমরা ‘তুই’তে পৌঁছেছি। আপন আমার কয়েক বছরের বড়, কিন্তু ওর সঙ্গে আমার তুই-তোকারি সম্পর্ক। আমাদের সবার তখন একটিই পরিচয়—কবি।
প্রতিদিন সন্ধ্যায় আজিজ মার্কেটে লিটল ম্যাগাজিনের তুখোড় আড্ডা, পিজি হাসপাতালের বহির্বিভাগে দাঁড়িয়ে তর্ক-বিতর্ক, নতুন কবিতার উত্তেজনা এবং বাংলা কবিতার গতিপথ নির্ধারণ—সে সময় এসবই আমাদের বিপ্লবী কর্মকাণ্ড। আর কর্মকাণ্ড শেষে এক কাপ চায়ে দু-তিনজনের ভাগাভাগি চুমুক। ২০০০ সালের প্রথম দিকে, সেই সময় আমি তো বটেই, আমাদের বেশ কয়েকজন তখনো ছাত্র এবং বেকার। যে কজন কর্মজীবী ছিল, আপন তাদের অন্যতম। চা ও অন্যান্য খানাপিনার ক্ষেত্রে ওদের ভূমিকাই ষোলোআনা। তবে এই খানাপিনার বিল মেটাতে অন্যদের চেয়ে আপন আবার আরেক কাঠি সরেস। হয়তো কিছুক্ষণ আগে দুশ্চিন্তায় কপালে ভাঁজ এঁকে বলেছে, কী যে করি, বাড়িতে টাকা পাঠানো দরকার। এখনো বেতন হয়নি। তার পরেও খাবারের বিলটি তাকে মেটাতেই হবে, আমরা না-না করি, তাতে কী! জীবনকে কুড়িয়ে ও উড়িয়ে দেওয়ার মধ্যেই যেন ওর আনন্দ।
বন্ধুদের কবিতা শুনে বলত, ‘আমার হবে না। তোরা প্রত্যেকেই আমার চেয়ে ভালো লিখিস।’ বলা সারা তো ওমনি আনমনে একটা গোপন দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে ফেলল। আমরা কখনো ঠিকঠাক বুঝতে পারিনি সেই দীর্ঘশ্বাসের মর্ম। ওই দীর্ঘশ্বাস কি ওর দূরবাসী মা-বাবার জন্য, ওর অসুস্থ ভাইয়ের চিকিৎসার জন্য, নাকি স্বতঃস্ফূর্ত একটি নিটোল কবিতার জন্য? এ রকম তাড়নাতেই বুঝি ও লিখতে পেরেছে অসংখ্য অনবদ্য কবিতা। পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিল সাংবাদিকতা,আজকের কাগজ ও যায়যায়দিন ঘুরে সে জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক হিসেবে কর্মরত ছিল কালের কণ্ঠে।
২০১১ সালে প্রকাশিত সকালের দাঁড়ি কমা ওর প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ওই বছর প্রথম আলো সাহিত্য সাময়িকীর ‘নির্বাচিত ১০ তরুণ’-এর তালিকায় স্থান পেয়েছিল এটি। প্রথম প্রকাশেই নতুন কবিতার সুবাস বেশ ভালোভাবেই জাগিয়েছিল আপন। ওর কবিতায় জীবন আছে, উত্তাপ আছে। পড়লে মুহূর্তেই যে কেউ হয়তো দেখে ফেলবেন ওর বাবা আবদুর রবকে। আনোয়ারা বেগম—ক্রন্দনরত তাঁর মায়ের মুখটিও মনে পড়বে সবার। আর আমাদের কেবলই মনে হবে, এই মেট্রোপলিটন মাল্টি ধান্দার শহরে বাবার মুখটি মনে করতে পারছি না আমরা। ক্রমাগত ভুলে যাচ্ছি নিজের মায়ের মুখ।
অবশেষে মায়ের কাছে ফিরে গেছে আপন। ফিরে গেছে তার কড়ইতলায়। ঢাকাই বন্ধু আমরা কখনো যাইনি সেখানে, দেখিনি ওর গ্রাম। তবে খুব জানতে ইচ্ছে করে, তোর প্রিয় কড়ইতলায় ঘাসফুলেরা তোর সম্মানে এখন কি ফুটে আছে রে, আপন?
আলতাফ শাহনেওয়াজ

No comments

Powered by Blogger.