বিশেষ সাক্ষাৎকার : ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ-সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত দুর্বল

সাম্প্রতিক হলমার্ক কেলেঙ্কারিসহ সরকারের আর্থিক নীতিমালার বিভিন্ন দিক নিয়ে কালের কণ্ঠের সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তাঁর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন মহসীন হাবিব
কালের কণ্ঠ : হলমার্ক কেলেঙ্কারি নিয়ে সর্বশেষ অর্থ মন্ত্রণালয় চিঠি দিয়েছে সোনালী ব্যাংকে মামলা করার জন্য।


মামলা তো একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ব্যাপার। হয়তো দীর্ঘদিন মামলা চলবে। এর মধ্যে এত বড় অঙ্কের টাকা উত্তোলনের কোনো সুযোগ আছে?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : প্রথমত, সরকার যে মামলা করার কথা বলেছে, আমি মনে করি মামলা একটা করতে হবেই। কারণ এটি একটি ক্রিমিনাল অফেন্স। এটি যদি সাধারণ একটি ব্যাপার হতো যে একজন ব্যবসায়ীকে কিছু ঋণ দেওয়া হয়েছে, কোনো কারণে তার ব্যবসাটা উঠে গেছে বা ওই খাতে আঘাত এসেছে, যার কারণে তার টাকাটা রিশিডিউল করা হলো। কিন্তু এ রকম একটি প্রতিষ্ঠানকে এত বড় একটি অঙ্কের অর্থ ডিসবার্স করা হলো, তার মানে প্রথম থেকেই এর মধ্যে দুর্নীতির একটি যোগসূত্র ছিল। ব্যবসা যা-ই হোক, ব্যবসার তুলনায় দুর্নীতিই এখানে প্রাধান্য পেয়েছে। সুতরাং এখানে ক্রিমিনাল লায়াবিলিটি রয়েছে বলে আমি মনে করি। যারা ঋণ গ্রহণ করেছে, যারা দিয়েছে এবং বাইরে যাদের প্রভাব রয়েছে- এদের সংশ্লিষ্ট সবারই একটি দায় রয়েছে বলে আমি মনে করি। অতএব মামলা করা উচিত। পৃথিবীর সব দেশেই কিন্তু অর্থ আত্মসাতের বিরুদ্ধে মামলা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যেই দুদককে বলেছে বিষয়টি তদন্ত করার জন্য। তার মানে কী, বাংলাদেশ ব্যাংকও চাচ্ছে দুদক তদন্ত করুক এবং একটি দুর্নীতির মামলা হোক। যেহেতু অর্থ আত্মসাতের ব্যাপার রয়েছে। এখন সোনালী ব্যাংকের পক্ষ থেকে মামলা হলে দুদকের জন্য আরো সুবিধা হয়, তাই এখন মামলা করবে। কিন্তু তাদের পক্ষ থেকে একটি ধীরগতি তৈরির চেষ্টা চলবে। এখন আদায়ের বিষয়ে যেমন ব্যাংকের কিছু ক্রাইটেরিয়া আছে সম্পদ অথবা গ্যারান্টি থাকবে এ রকম। আর ব্যবসার বেলায় ক্যাশ ফ্লো থাকে সেটা ভিন্ন বিষয়। কিন্তু এখানে যেটা হয়েছে, নিয়েছে গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজের এলসির জন্য, আবার কিনেছে জমি। কো-ল্যাটারালগুলো যদি ঠিক না থাকে তবে আদায় কঠিন হবে। এ ক্ষেত্রে যদি আদায় করতে না পারে তবে অর্থঋণ আদালতে যেতে হবে। সেটাও একটি জটিল বিষয়। সেখানে যদি রায় হলো, তখন সেটা বাস্তবায়ন করাও কঠিন হয়ে পড়তে পারে। যেমন দেখানো সম্পদ যদি অন্যের হয়, কাগজপত্র ঠিক না থাকে, তাহলে আদায় করা খুবই মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। তারপর যদি উচ্চ আদালতে রিট করে, তখন আরো সময়ের ব্যাপার। অতএব সে প্রক্রিয়ায় এখনই যাওয়া ঠিক হবে না। তার আগে অন্য যে উপায়গুলো আছে, যেমন সরকারের উচিত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা। যারা জড়িত আছে, তাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদও আগে বাজেয়াপ্ত করতে হবে। ধরুন দুই হাজার কোটি টাকা তার কাছ থেকে নেওয়া হলো, তখন সে ভাবতে পারে এটা দিলে বাকিটা মাফ। তা নয়, আগে আদায় করে তাকে বলতে হবে বাকিটা দাও। জড়িতদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বাজেয়াপ্ত করলেও কিন্তু একটা চাপ তৈরি হবে। যেমন আমেরিকায় হয়েছিল বার্নার্ড ম্যাডফের বেলায়। তার সারা জীবনের জন্য জেল হয়েছে, সঙ্গে তার সব সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে এবং সে সম্পদ বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।
কালের কণ্ঠ : আরো একটি বিষয় আমরা দেখতে পাই। যারা ক্ষমতাধর, শক্তিশালী বা যাদের অনেক অর্থের জোর আছে, তাদের ব্যাংক থেকে দীর্ঘদিন ধরেই আগে শত শত কোটি টাকা, এখন হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ হিসেবে দিয়ে দেওয়া হয়। অনেক ক্ষেত্রে এত বড় ঋণের সঠিক কাগজপত্রও থাকে না। অথচ স্বল্প আয়ের বা দরিদ্র একজন মানুষকে মাত্র ২০-৩০ হাজার টাকা ঋণ নিতে বহু জটিলতা, বহু নিশ্চয়তা প্রদানের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। অনেকে ঋণ পাচ্ছেও না। এ ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের জন্য ঋণ সহজলভ্য করতে আপনার কোনো পরামর্শ আছে কি না।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : এটি খুবই দুঃখজনক ব্যাপার যে বাংলাদেশে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দিন দিন বাড়ছে। এটি কিন্তু মূলত হচ্ছে ফাইন্যান্স সেক্টরের কারণেই। এমনকি দেখবেন ইউনূস সাহেব যেটা করতে চেষ্টা করেছিলেন, সেটা দেখুন হঠাৎ করে সরকার নিয়ে নিয়েছে। আর সরকার নিয়ে নেওয়া মানে কী? সরকারি জিনিসের কী অবস্থা হবে তা অনুমেয়। এটা খুবই দুঃখজনক ব্যাপার। এখন দেখবেন ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের ব্যাপারে কথা উঠবে, এটা আপামর জনসাধারণের জন্য ওপেন করে দেওয়ার, যাতে সবাই আসতে পারে। বাংলাদেশে কিন্তু সেটা হয়নি। শুধু ফাইন্যান্সিয়াল সেক্টর এসএমই, তারপর মাইক্রো ক্রেডিট এসব করে। কিন্তু ওই দেখবেন যারা একটু ডায়নামিক, তাদের জন্য প্রচুর সময় লেগে যাচ্ছে তিন লাখ টাকার একটি ঋণ নিতে। এই প্রক্রিয়া দূর হওয়া দরকার। সেন্ট্রাল ব্যাংক অনেক রিফর্ম হয়েছে। এখন কাগজপত্র সহজ করা এবং আনুষঙ্গিক অনেক প্রক্রিয়া বাকি রয়েছে। দেখুন ব্যাংকারদের তরফ থেকেও একটি অনীহা রয়েছে। যারা ছোট তাদের নানা কৌশলে নিরুৎসাহী করছে তারা। তবে এ প্রক্রিয়া সহজ করার সময় এসেছে। শুধু মাইক্রো ক্রেডিট বা এসএমই নয়, পুরো মেইন স্ট্রিম ব্যাংকিং সেক্টরে যারা রিয়াল বা জেনুইন, তারপর মাঝারি ও নিউ ডায়নামিক তাদের নানা রকম সমস্যা হয়। দেখা যায় অনেক সময় কো-ল্যাটারাল ভুয়া দেখিয়ে থাকে। আমাদের দেশে মোদ্দাকথা ফিন্যান্সিয়াল ইনোভিশন তেমন হয়নি। যারা নতুন নতুন উদ্যোগ নিয়ে আসতে চায়, যারা ভেনচার করতে চায়- এগুলোকে দেখবেন ব্যাংকাররা উৎসাহ দেয় না। অতএব মাইন্ডসেটের ব্যাপারও আছে।
কালের কণ্ঠ : সরকারি ব্যাংকগুলোর ওপর সেন্ট্রাল ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ সীমিত। আপনিও এ অভিযোগ করেছেন। কিন্তু তার পরও রাজনৈতিক বিবেচনায় বেশ কয়েকটি ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হলো। এটাকে আপনি কিভাবে দেখছেন। এই নতুন ব্যাংকগুলোর কী প্রয়োজন ছিল?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : নতুন ব্যাংকের ব্যাপারে প্রথম থেকেই আমি নিষেধ করেছি। যে ৪৭টি ব্যাংক আছে, আমাদের অর্থনীতির যে আকার সে তুলনায় ৪৭টি ব্যাংক কিন্তু অনেক। যারা আছে তাদের অ্যাফিসিয়েন্সিটা কী? যেসব ব্যাংক আছে এর প্রত্যেকেই তো এনআরবি নিয়ে কাজ করে, ওয়েজ আর্নার নিয়ে কাজ করে- সেখানে নতুন করে ব্যাংকের দরকারটা কী? অতএব নতুন ব্যাংকের দরকার ছিল না। দ্বিতীয়ত, নতুন ব্যাংক দেওয়ার ফলে সেন্ট্রাল ব্যাংকের ওপর বাড়তি চাপ পড়বে। এই যে নতুন করে ব্যাংকের অনুমতি দেওয়া হলো- এদের সুপারভাইজিংয়ের জন্য সেন্ট্রাল ব্যাংকের তো ক্ষমতা বাড়েনি। আর তৃতীয়ত, সেন্ট্রাল ব্যাংক রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থাকবে সেটা সবাই প্রত্যাশা করে। সম্প্রতি অনুমোদন দেওয়া ব্যাংকগুলো আপনি দেখবেন সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বিবেচনায় দেওয়া হয়েছে। প্রথমে কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক না করেছিল। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে তারাই আবার জাস্টিফিকেশন দিয়েছে। আগের সময়ে আমার ওপরও এমন চাপ ছিল। আমি সেটা না করেছি এবং সক্ষমও হয়েছি। অতএব আমি মনে করি অর্থনীতির কোনো নীতি, কৌশল বাস্তবায়নে রাজনীতির কোনো প্রভাব বা হস্তক্ষেপ কাঙ্ক্ষিত নয়। সঠিক নীতি গ্রহণ করবেন নীতি-নির্ধারকরা। কিন্তু তারপর আর কোনো হস্তক্ষেপ উচিত নয়। ব্যাংকিং ক্ষেত্রে একটা নীতি থাকা উচিত যে লাইসেন্স পেতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রাইটেরিয়া পূরণ করতে হবে। সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংককে বলে দেওয়া হলো যে তোমরা লাইসেন্স দাও। কিন্তু সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংক তখন না বলতে পারেনি, সেটা অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার। বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষমতাকে কারটেইল করা হয়েছে। এ জায়গাটায় কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক রাজনৈতিক প্রভাবটাকে এড়াতে পারেনি। তাদের আরো শক্ত অবস্থান নেওয়া উচিত ছিল। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়। সরকারি ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে লোক নেওয়া হয়েছে। এটা কেমন কথা। পরিচালনা পর্ষদে থাকবেন দক্ষ ও সৎ ব্যক্তিরা। তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকতে পারে। কিন্তু সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে জড়িতরা থাকতে পারেন না।
কালের কণ্ঠ : বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তার প্রায় সবই অর্থনীতিবিষয়ক, অর্থ কেলেঙ্কারি- যেমন পুঁজিবাজার, এমএলএম প্রতারণা নিয়ে লুকোচুরি, হলমার্ক। এর সবগুলোতেই হাজার হাজার কোটি টাকার বিষয় রয়েছে। এ লোপাট অদূর ভবিষ্যতে অর্থনীতিকে প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক। যত দিন যাচ্ছে ততই অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারির মাত্রা বাড়ছে। রাজনীতিতে ভিন্নমত থাকবে, কিন্তু দুঃখজনকভাবে রাজনীতি অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে গেছে। আগে যাঁরা রাজনীতিবিদ ছিলেন তাঁদের মধ্যে জনগণের জন্য কল্যাণমুখী কাজ করা পরহিতব্রত ছিল। সবাই না, তবে বর্তমানে বেশির ভাগ রাজনীতিবিদ অর্থনৈতিক স্বার্থ ছাড়া কিছু বোঝেন না। ফলে অন্যরা, বিশেষ করে আমলা শ্রেণী সুযোগটা গ্রহণ করে। কারণ ওপর থেকেই যখন দুর্বলতা থাকে তখন নিচের দিকের লোকেরা উৎসাহ পায়। অতএব একটার পর একটা ঘটনা ঘটছে। আপনি দেখবেন ধরা পড়ার পর দ্রুত কোনো কঠিন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি বা হয় না। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি নিয়ে কয়েকজনের নাম এসেছে। দুয়েকজনকে অতি দ্রুত ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশনের অধীনে এনে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল। জেল-জরিমানার আওতায় আনা উচিত ছিল। কিন্তু দুদককে তদন্তের ভার দেওয়া, আবার আরেকটি রিভিউ কমিটি করা- এসব করে কালক্ষেপণে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হচ্ছে এবং এসব কেলেঙ্কারিতে দায়ী ব্যক্তিরা এ দীর্ঘসূত্রতার মধ্য দিয়ে আড়ালে চলে যাচ্ছে। আবার আরেকটি কেলেঙ্কারি সামনে আসছে। ফলে পুঁজিবাজারের ওপর আস্থাহীনতা থেকে বের হওয়া যাচ্ছে না। তবে এবার হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে যদি দ্রুত আমরা ব্যবস্থা গ্রহণে না যাই, তাহলে এটি একটি রং সিগন্যাল দেবে। সর্বোপরি বর্তমানে সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত দুর্বল এবং কিছু কিছু ভ্রান্তনীতি রয়েছে। আর্থিক ব্যবস্থা বলতে শুধু ব্যাংকিং নয়, এর মধ্যে পুঁজিবাজার, ইনস্যুরেন্স, এডিপি বাস্তবায়ন, সরকারের কর ব্যবস্থাপনা, সরকারের ব্যয় ব্যবস্থাপনা- সব বোঝাচ্ছি। একদিকে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় করছে, অন্যদিকে বলছে এডিপিতে টাকা দিতে পারছে না। সরকারের ব্যয়ও দিনদিন বাড়ছে। বেতন-বোনাস, বিদেশ ভ্রমণ বাড়ছে। অতএব সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনা এককথায় দুর্বল। অন্যদিকে ভ্রান্তনীতি রয়েছে। যেমন আপনার সেভিংস সার্টিফিকেটের ওপর ট্যাক্স বসিয়ে দিল। সম্প্রতি সরকার কী করছে? যেসব গরিব মানুষের মাত্র এক বা দেড় লাখ টাকা জমা থাকবে তাদের টিন থাকলে ১৫ পারসেন্ট, টিন না থাকলে কম দিতে হবে। ওই সব স্বল্প আয়ের লোকের তো ট্যাক্স দেওয়ারই কথা নয়। একজন মানুষ কষ্ট করে এক-দুই বছরে এক-দেড় লাখ টাকা জমাল, সুদ বাবদ কিছু টাকা পাবে, অথচ আপনি তার ১৫ শতাংশ কেটে নিলেন। একটা অদ্ভুত ব্যাপার। সঞ্চয়ীকে আপনি নিরুৎসাহী করছেন। এগুলো পরিষ্কার ভ্রান্তনীতি। তারপর আজ একরকম সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, কাল আবার সে সিদ্ধান্ত পাল্টে দিচ্ছে। আমি মনে করি, এসব আলাপ-আলোচনা করে করা উচিত। সরকার কাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে জানি না, আর যাদের সঙ্গে আলোচনা করে তারাও কী রকম পরামর্শ দেয় জানি না। তারাও হয়তো সরকারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে।
কালের কণ্ঠ : বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বড় ধরনের সমস্যা তৈরি হলো। এ বিষয়ে আপনার অভিমত কী?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : এটার সঙ্গেও জড়িত সরকারের দুর্বল অর্থব্যবস্থাপনা। বিশ্বব্যাংক যখন অভিযোগ করল, তখনই বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত ছিল। এত বড় প্রকল্প বিশ্বব্যাংক এবং অন্যান্য দাতাসংস্থার আর্থিক সহায়তা ছাড়া বাস্তবায়ন অত্যন্ত কঠিন। আমাদের নিজস্ব সম্পদ বেশি নয়, বিশেষ করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। সেতু ছাড়া আমাদের আরো অনেক প্রকল্প আছে, যা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিতে হবে। একই রকম দেখুন ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন রাস্তা। টাকাই পাচ্ছে না। তারপর এডিপি অর্থায়নে দেখুন ডোনারদের ডিসবার্সমেন্ট হচ্ছে না কিন্তু পাইপলাইনে আছে। এডিপির পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হয়। কিন্তু অস্বচ্ছতা আছে, অদক্ষতা আছে, দুর্নীতি আছে। পদ্মা সেতুর বিষয়ে টেকনিক্যাল দিক দিয়ে কিন্তু বিশ্বব্যাংক না করেনি। তারা বলেনি যে ফিজিবিলিটি নেই বা ওখানে প্রয়োজন নেই। বিশ্বব্যাংক বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন করেছে। এ সমস্যা সহসাই অ্যাড্রেস করা যেত। এ ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির গন্ধ পেয়েছে। সরকার এ বিষয়টিকে গঠনমূলকভাবে না নিয়ে প্রতিবাদের অবস্থান নিয়েছে।
কালের কণ্ঠ : এসব প্রতিবন্ধকতার বাইরে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কী রকম? বিনিয়োগের নতুন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে কি? সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান কেমন?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : দেখুন, বাংলাদেশের মতো দেশে সাধারণ মানুষ, সাধারণ কৃষক থেকে শুরু করে সব পেশায়, মানুষ তাদের নিজস্ব তাগিদে, জীবন নির্বাহের জন্য এবং নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থা উন্নয়নের জন্য কাজ করে থাকে। তারা সরকারের কোনো কর্মকাণ্ড থাকুক বা না-ই থাকুক, নিজেরা ব্যক্তিগতভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারের কাজ হলো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করা, সঠিক নীতি ও কৌশল নির্ধারণ করা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করা, রাজনৈতিক সংঘাত এড়িয়ে চলা এবং জনগণের বৃহৎ অংশ- যারা দরিদ্র, অবহেলিত ও বঞ্চিত, তাদের পথ থেকে সব বাধা সরিয়ে দেওয়া। গত তিন দশকে আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকে যে উন্নতি হয়েছে, সেগুলোর পেছনে যেসব ইতিবাচক কর্মকাণ্ড হয়েছে, সেগুলোকে সুসংহত করে আরো শাণিত করে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। তবেই বর্তমানে বিনিয়োগে যে স্থবিরতা, কর্মসংস্থানের অপ্রতুলতা এবং ক্রমবর্ধমান ব্যক্তিগত আয় বৈষম্য দূর করা সম্ভব হবে।
কালের কণ্ঠ : সরকারের কি অধিক পরিমাণে বিভিন্ন খাতকে প্রাইভেট সেক্টরে ছেড়ে দেওয়া উচিত?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : না। সব বিষয় প্রাইভেট সেক্টরে ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়। এগুলো পশ্চিমা দেশগুলোতে হয়ে থাকে। তবে সরকারে দক্ষ লোকবলের অভাব রয়েছে, অসচ্ছতা রয়েছে। রিক্রুটমেন্ট প্রক্রিয়ায় গলদ আছে। এ ছাড়া সরকারি সংস্থাগুলোতে রিওয়ার্ড অ্যান্ড পানিশমেন্ট সিস্টেম নেই। তা ছাড়া আরেকটি বাধা হলো সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পলিসিগুলোও পরিবর্তন হয়ে যায়। নীতির কনটিনিউটি না থাকলে খুবই মুশকিল। এমনকি ভারতেও দেখুন সরকার পরিবর্তন হলেও নীতি খুব কম পরিবর্তন হয়। আমাদের দেশে সব কিছুর আমূল পরিবর্তন হয়ে যায়। এটি একটি বড় সমস্যা। তবে কিছু সেক্টর আছে যেগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দরিদ্র মানুষের সঙ্গে যুক্ত যেমন স্বাস্থ্য খাত, শিক্ষা খাত, এসব যদি আপনি প্রাইভেট সেক্টরে ছেড়ে দেন, পরিবহন, রেল যদি ছেড়ে দেন তাহলে সাধারণ মানুষের কষ্ট বেড়ে যাবে অনেক। সেটা ঠিক হবে না।
কালের কণ্ঠ : আপনাকে কালের কণ্ঠের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : আপনাকেও ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.