শুক্রবারের বিশেষ প্রতিবেদন- বাঁশির টানে বিদ্যালয়ে by আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ

সুজন ইসলাম বড় হয়েছে একটি বেসরকারি সংস্থার আশ্রয়কেন্দ্রে। সেখানেই পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর নিয়ম অনুযায়ী তাকে চলে আসতে হয়। কিন্তু যাবে কোথায়? বাবাকে সে চোখেই দেখেনি। মা অন্যের ঘরনি। সেখানেই যায় সুজন। স্কুলে পড়তে চায়। তাতে সৎবাবা রাজি নন।


পড়তে হলে প্রতি মাসে তাকে ৬০০ টাকা করে পরিবারে দিতে হবে, সাফ জানিয়ে দেন সেই বাবা।
এই শর্তে সুজন ভর্তি হয় রাজশাহীর সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের একটি বিদ্যালয়ে। ছুটি হলেই সে বেরিয়ে পড়ে চকলেট বিক্রি করতে। তাকে ৬০০ টাকা জোগাড় করতে হবে। বিদ্যালয়ের সব শিশু প্রায় একই রকম পরিবার থেকে এসেছে। কাজের চিন্তায় কারও মন বসে না পড়ায়। বিদ্যালয়ের শিক্ষক আইরিন রসুল তাদের মন বোঝেন। এমন দেখলেই থলে থেকে বাঁশি বের করে সুর তোলেন। বাঁশির সুরে তারা বাড়ির কথা ভুলে যায়। পড়ায় মন দেয়। বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ পায়। শিক্ষকেরাও বিনা বেতনেই পড়ান।
রাজশাহী নগরের পঞ্চবটি-খরবনা এলাকায় অবস্থিত এই বিদ্যালয়ের নাম হজরত খাজা শাহ সুফি (রহ.) উচ্চবিদ্যালয়। আইরিন রসুলসহ বিদ্যালয়ে ১০ জন শিক্ষক রয়েছেন। বিদ্যালয়টির উদ্যোক্তা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান আবদুল খালেক। মাস শেষে তিনি শিক্ষকদের ২০০ টাকা করে রিকশা ভাড়া দেন। বছর আটেক আগে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করা হলেও এখনো পাঠদানের অনুমতি মেলেনি। এখানকার শিক্ষার্থীরা আবদুল খালেকেরই প্রতিষ্ঠিত নগরের রানীনগর নৈশ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষা দেয়। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত ১৫০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে এখানে। শিক্ষার্থীদের পাসের হার ৫০ শতাংশের বেশি।
সম্প্রতি বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, আইরিন রসুল বাঁশি বাজাচ্ছেন। তাঁর চারদিকে বসে শিক্ষার্থীরা বাঁশি শুনছে। তিনি জানান, তাদের জন্য তাঁকে প্রতিদিন বাঁশি নিয়ে আসতে হয়। তিনি জানান, বাড়িতে গিয়ে তারা বই খোলার সময় পায় না। সংসারে বাড়তি আয়ের জন্য তাদের সবাইকে কাজ করতে হয়। বাড়িতে একটু পড়াশোনার সুযোগ পেলে তারা আরও ভালো ফলাফল করতে পারত।
শিক্ষকদের কার্যালয়ের জন্য একটি পাকাঘর আছে। তবে শ্রেণীকক্ষের অবস্থা ভালো নয়। একটি লম্বা টিনশেডের নিচে বসে পড়ে তারা। মাঝখানে কোনো দেয়াল নেই। গত বছরের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে এই বিদ্যালয় থেকে একটি দেয়াল পত্রিকা বের করা হয়, যার নাম পৃথিবীর পথে। এতে লেখার পাশাপাশি শিশুদের উপযোগী সুন্দর কিছু স্কেচ করেছে সুজন ইসলাম। সে নিজে টোকাই। তাই টোকাই নিয়ে একটি কবিতা লিখেছে দেয়াল পত্রিকায়, ‘...ডাস্টবিনের খাবার খুঁজি/ পচা-গলা খেয়ে বাঁচি/ রাস্তাঘাটে ঘুমিয়ে থাকি/ ছোট্ট একটি অনাথ শিশু/ নাই যে আমার কোনো কিছু...।’ সবটুকু পড়লে চোখে পানি এসে যায়। স্বাধীনতা দিবসে বিদ্যালয়ে তারা সৈয়দ শামসুল হকের নাটক নূরল দীনের সারাজীবন-এর অংশবিশেষ নিয়ে নৃত্যনাট্য পরিবেশন করে। গত মার্চে এই বিদ্যালয়ের পাঁচজন শিশু ঢাকায় খেলাঘর সম্মেলনে যোগ দেয়।
বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী বিপাশা খাতুন রাজশাহী শিশু একাডেমী আয়োজিত নাট্য প্রতিযোগিতায় গত বছরে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার পেয়েছে। বিপাশা জানায়, তার বাবা নগরে অটোরিকশা চালান। তাতে তাদের সংসার চলে না। সংসারে বাড়তি আয়ের জোগান দিতে তাকে বাড়িতে কাগজের ফুলের মালা তৈরি করতে হয়।
দশম শ্রেণীর ছাত্র মামুন ইসলাম বিদ্যালয় থেকে বাড়ি ফিরে বাবার সঙ্গে ফলের দোকানে কাজ করে। ক্লাসে তার রোল এক। মামুন জানায়, কাজের মধ্যে দিয়েই তাকে পড়াশোনা এগিয়ে নিতে হয়। সে জানায়, আইরিন আপার বাঁশি তাদের প্রেরণা। তিনি তাদের মন খারাপ হতে দেন না।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাদেকুল ইসলাম জানান, বেতন না পেলেও তাঁরা মনের টানেই সুবিধাবঞ্চিত এই শিশুদের পাশে রয়েছেন। সংসার চালানোর জন্য তাঁরা অন্য সময়ে কাজ করেন। তিনি জানান, আইরিন রসুলের বাঁশি শুধু বাচ্চাদের নয়, তাঁদেরও মন ভালো রাখেন।
বিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা অধ্যাপক আবদুল খালেক বলেন, ‘২০০৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত শিক্ষকেরা কোনো বেতন ছাড়াই পাঠদান চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। পাঠদানের অনুমতির জন্য রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান একটি ডিও লেটার দিয়েছেন। কিন্তু নগরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেশি হয়ে গেছে বলে শিক্ষা বোর্ড তা দিচ্ছে না।’

No comments

Powered by Blogger.