সময়ের কথা-শওকত ওসমানের গ্যাসের চুলা এবং মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজার by অজয় দাশগুপ্ত

মন্ত্রীরা কোটা চাইবেন। শাসক দলের এমপিরা বলবেন, আমাদের কোটা দিতে হবে। সরকারি অফিসের লোকেরা বলবেন, যতই মন্ত্রী-এমপির সুপারিশ থাকুক আমাদের বখরা চাই-ই। নইলে যেতে দেওয়া হবে না। গরিবের সামান্য বিধবা ভাতা বা ভিজিএফ কার্ড পেতে যদি ঘুষ দিতে হয়, তাহলে যেখানে মালয়েশিয়ায় চাকরি শুধু নয়, ব্যয় এক-দেড়


লাখ টাকা কমে যাবে_ অথচ কোনো ঘুষ দিতে হবে না_ এ তো আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার চেয়েও বেশি। এত সুখ সইবে কি? গরিবের পেটে কি ঘি সহ্য হয়? এমনটি হলে সেটা তো হবে শওকত ওসমানের বাড়িতে বিনামূল্যে গ্যাস সংযোগ লাগিয়ে দিয়ে হাতে একটি ধন্যবাদসূচক পত্র ধরিয়ে বলা, যাতে লেখা_ আগামী এক দশক আপনাকে গ্যাস ব্যবহারের জন্য কোনো বিল পরিশোধ করতে হবে না


ঢাকা শহরে প্রথমে রান্নাঘরের চুলায় গ্যাসের সংযোগ পেয়েছিলেন বরেণ্য সাহিত্যিক ও শিক্ষক শওকত ওসমান। এ 'সাহসিকতার পুরস্কার' হিসেবে টানা কয়েক বছর তার কাছ থেকে গ্যাসের কোনো বিল নেওয়া হয়নি। এটা প্রায় ৫০ বছর আগের ঘটনা। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও সিলেট অঞ্চলে শেল অয়েল কোম্পানি গ্যাস পেয়েছে [এই গ্যাসের মালিকানা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে সরকারের মালিকানায় নিয়ে দূরদর্শী এক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ]। কিন্তু শেলের হাতে মজুদ গ্যাসের কীভাবে ব্যবহার হবে? তখনও বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র কিংবা ইউরিয়া সারের উৎপাদনের জন্য প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহার এ দেশে শুরু হয়নি। এমনটি যে সম্ভব, সেটাও জানা ছিল না। অতএব, সরকারের সিদ্ধান্ত রান্নার জন্য গ্যাস সরবরাহ করা হবে। কিন্তু কেউ ভয়ে গ্যাস নিতে চায় না_ যদি গ্যাসের বিস্ফোরণে ঘরে আগুন ধরে যায়? শহরবাসীকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য মাইকিং করা হতে থাকে। এর সপক্ষে বড় যুক্তি ছিল যে_ এতে দুর্ঘটনার শঙ্কা নেই। লাকড়ি, কেরোসিনের স্টোভ বা বৈদ্যুতিক হিটারের তুলনায় ব্যয় প্রায় নামমাত্র। বাড়ি বাড়ি পাইপলাইনে গ্যাস পেঁৗছে দেবে সরকার। অবশেষে রাজি হলেন শওকত ওসমান সাহেব_ সরকার ও গ্যাস বিতরণ কর্তৃপক্ষের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। জীবনে তিনি অনেক ঝুঁকি নিয়েছেন। বাড়িতে গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে নিলেন পথিকৃতের ভূমিকা। তার বাড়িতে গ্যাসের চুলায় রান্না করা দেখতে ভিড় জমাল অনেক নারী-পুরুষ। আইয়ুব খানের 'উন্নয়নের' চিত্র জনগণের সামনে তুলে ধরতে বিশেষ ডকুমেন্টারি তৈরি হয়েছিল এবং তাতে স্থান পেল শওকত ওসমান সাহেবের রান্নাঘর। এটা দেখানো হতে থাকল সিনেমা হলগুলোতে_ চলচ্চিত্র প্রদর্শনের ঠিক আগে। শওকত ওসমানের পরিবারের সদস্যরা পকেটের টাকা ব্যয় করে টিকিট কিনে দলবেঁধে গেলেন সিনেমা হলে।
এ ধরনের গ্যাস-সংযোগ পাওয়া এখন সিনেমার গল্প মনে হয় না?
দুই দশক আগে রংপুরের কাউনিয়া রেলস্টেশনে একবার ট্রেন বদল করেছিলাম। ওই স্টেশনের চায়ের দোকানে একটি এনামেল শিটে বিজ্ঞাপন দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাই। বিষয় ছিল চায়ের উপকারিতা। ব্রিটিশ আমলে চা-পানে জনসাধারণকে আকৃষ্ট করার জন্য সর্বত্র এ ধরনের বিজ্ঞাপন দেওয়া হতো। হাটবাজারে ঢোল দিয়ে চায়ের উপকারিতা বলা হতো। প্রধান 'উপকারিতা' ছিল_ চা পান করলে কোনো 'অপকার' হয় না। চায়ের সঙ্গে বিস্কুটও মিলত ফ্রি বা ফাও। আহা! এখন যে চা মহার্ঘ বস্তু!
সরকার বলে যে ফাও কিছু মেলার দিন শেষ। তবে তা কেবলই জনসাধারণের জন্য। কিংবা আরও স্পষ্টভাবে বলা যায় আমজনতার জন্য। ফাও খাওয়ার লোকের অভাব আদৌ নেই বাংলাদেশে। আর ফাওয়ের পরিমাণ কী মাত্রায় হতে পারে তার নজির তো হাতের কাছেই_ হলমার্ক! তবে এ ধরনের গুরুতর অন্যায়-অনিয়ম আরও অনেকে করে চলেছে। আমরা শেয়ারবাজারের কথা জানি। পদ্মা সেতুর 'সম্ভাব্য দুর্নীতির' কথা শুনছি। একাধিক দায়িত্বশীল ব্যক্তি বলেছেন_ পদ্মা সেতুর মতো ২০ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পে ৪-৫ হাজার কোটি টাকা কিছু লোকের 'পকেটে' ঢুকলে পাবলিকে কিছু টেরও পায় না। অর্ধেক অর্থ আত্মসাৎ হলে হৈচৈ হবে। যমুনায় যে সেতু হয়েছে তার নির্মাণ ব্যয় ছিল প্রায় চার হাজার কোটি টাকা। এর কন্ট্রাক্ট কারা পেয়েছিল, সেটা নিয়ে জাতীয় সংসদে কোনো আলোচনা হয়নি। সংবাদপত্রে কিছু লেখা হয়নি। তখন শাসকরা বুদ্ধিমান ছিলেন যে! বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসে ঠাট্টা করতে শুনেছি_ ঠিকাদারের সব বিল পাস করাতে হতো সেখানে। এ প্রক্রিয়ায় কার কার কপাল ফিরেছে কেউ জানে না। সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া একবার বলেছিলেন, বিশ্বব্যাংকের মতো দাতারা বাংলাদেশের দুর্নীতি নিয়ে অভিযোগ করে। কিন্তু তাদের দুর্নীতি নিয়ে কে বলবে? আমরা তাদের কাছে হাত বাড়াই নানা প্রয়োজনে। তাই সব কথা বলতে পারি না। মাহবুব জামানের সঙ্গে যৌথভাবে 'সাম্রাজ্যবাদের শৃঙ্খলে বাংলাদেশের অর্থনীতি' নামে একটা বই লিখেছিলাম আশির দশকের শুরুতে। তাতে 'দাতাদের' অর্থায়নে একাধিক বড় প্রকল্পের বিদেশি উপদেষ্টাদের পেছনে বাংলাদেশকে কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয় তার অনেক উদাহরণ দেওয়া হয়েছিল। সামান্য যোগ্যতা নিয়ে যেসব 'বিদেশি কনসালট্যান্ট' নিয়োগ পেয়ে আসে, তাদের বেতন ও অন্যান্য সুবিধার পরিমাণ আকাশছোঁয়া।
মার্কেট ইকোনমি বা বাজার অর্থনীতি পাবলিকের অনেক সুবিধা কেড়ে নিয়েছে। রান্নার গ্যাসের দাম বৃদ্ধি এর মধ্যে অন্যতম। এখন সরকার কিংবা গ্যাস কর্তৃপক্ষ বিনামূল্যে গ্যাস দিতে পারে না। তারা বাজার মূল্য অর্থাৎ উৎপাদন ব্যয় প্লাস লাভ দাবি করে। বিদ্যুতের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা। কিন্তু একটু হিসাব যারা করতে জানেন তারা বলবেন, পাবলিককে সরকারের দুর্নীতি এবং ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের মাত্রাতিরিক্ত লাভের জন্যও দণ্ড দিতে হয়। বিদ্যুৎ প্রকল্প যে ব্যয়ে হওয়ার কথা তার চেয়ে বেশি দেখানো হয়। রেললাইন কিংবা সড়ক পথ নির্মাণের জন্য ব্যয় ধরা হয় বেশি করে, যাতে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরকারি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী, ঠিকাদার ও রাজনৈতিক দলের লোকজনের বখরা পেতে সমস্যা না হয়। এভাবে ব্যয় বাড়লে তার প্রভাব পড়ে যাত্রী ভাড়ায়। কোনো সরকারি হাসপাতালের জন্য কেনাকাটা করার প্রয়োজন হলে তার জন্য ব্যয় ধরা হয় বাড়িয়ে। এর ফলে হাসপাতালে রোগীকে বাড়তি অর্থ দিতে হয়।
উদাহরণের তো শেষ নেই। আমাদের দেশে সম্পদ সীমিত। লোক অনেক বেশি। তারপরও আরেকটু ভালো থাকা সম্ভব হতো সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের। কিন্তু সরকার যেভাবে চলে তাতে অল্প কিছু লোক ভালো থাকে_ বাকিরা ভালো থাকে না। কিংবা আরও স্পষ্ট করে বলা যায় যে, তাদের ভালো থাকতে দেওয়া হয় না।
এটাই তো মন্দ রাজনীতির খেসারত। তবে এ জন্য বেশিরভাগ মানুষের কাছে প্রধানত দায়ী হয় সরকার। প্রশাসনের লোকজন এবং ব্যবসায়ীরা থাকে আড়ালে। মালয়েশিয়ায় নতুন করে বাংলাদেশের শ্রমবাজার উন্মুক্ত হওয়ার বিষয়টিই ধরা যাক। এ বাজার ফের উন্মুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে এবং তার কৃতিত্ব সরকারের। এখন লোক গেলে সেটা নেওয়া হবে সরকারের সঙ্গে সরকারের চুক্তি অনুযায়ী। ম্যানপাওয়ার এজেন্টদের বলা হচ্ছে_ তফাত থাক। তোমাদের দুর্নীতির কারণে বাজার হারিয়েছি। আর নয়। শ্রমমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলছেন, মাত্র ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা মাইগ্রেশন চার্জ নেওয়া হবে। আর যারা চাকরি নিয়ে ওই দেশে যাবে তাদের যাতায়াতের বিমান ভাড়া বহন করবে তাদের নিয়োগকর্তা। এটা বাস্তবায়িত হলে তার চেয়ে খুশির খবর আর কিছু হতে পারে না। যারা এমনকি হাড়ভাঙা খাটুনির লেবার হয়ে চাকরি নিয়ে যাবে তাদের জনপ্রতি ব্যয় কমবে এক থেকে দেড় লাখ টাকা। কিন্তু সরকারি অফিসের লোকজন যাদের রিক্রুট করবে, তাদের কাছ থেকে ঘুষ দাবি করবে না, সে নিশ্চয়তা কোথায়? মন্ত্রীরা কোটা চাইবেন। শাসক দলের এমপিরা বলবেন, আমাদের কোটা দিতে হবে। সরকারি অফিসের লোকেরা বলবেন, যতই মন্ত্রী-এমপির সুপারিশ থাকুক আমাদের বখরা চাই-ই। নইলে যেতে দেওয়া হবে না। গরিবের সামান্য বিধবা ভাতা বা ভিজিএফ কার্ড পেতে যদি ঘুষ দিতে হয়, তাহলে যেখানে মালয়েশিয়ায় চাকরি শুধু নয়, ব্যয় এক-দেড় লাখ টাকা কমে যাবে_ অথচ কোনো ঘুষ দিতে হবে না_ এ তো আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার চেয়েও বেশি। এত সুখ সইবে কি? গরিবের পেটে কি ঘি সহ্য হয়? এমনটি হলে সেটা তো হবে শওকত ওসমানের বাড়িতে বিনামূল্যে গ্যাস সংযোগ লাগিয়ে দিয়ে হাতে একটি ধন্যবাদসূচক পত্র ধরিয়ে বলা, যাতে লেখা_ আগামী এক দশক আপনাকে গ্যাস ব্যবহারের জন্য কোনো বিল পরিশোধ করতে হবে না। গ্যাসের চুলা জ্বালাতে কোনো সমস্যা হলে আমাদের জানাবেন এবং দ্রুত তা দূর করে দেওয়া হবে। এ জন্যও কোনো অর্থ ব্যয় করতে হবে না। যদি শ্রম ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় এই 'সামান্য অর্থে' মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কর্মী পাঠাতে পারে তাহলে তা জনশক্তি রফতানির বাজারে রীতিমতো বিপ্লব সাধন করবে। সৌদি আরব, কুয়েত, বাহরাইনসহ অন্যান্য দেশে কর্মী পাঠানোর ব্যয়েও এর প্রভাব পড়বে। চারদিকে মন্ত্রীর ধন্য ধন্য পড়ে যাবে। গোটা সরকার প্রশংসিত হবে। কিন্তু বাস্তবে সেটা ঘটবে কি? অনেকের ধারণা যে, এই প্রক্রিয়াটি ভণ্ডুল করায় প্রথমে বাগড়া আসবে খোদ সরকারের ভেতর থেকে। সরকারি দলের লোকেরা কম ব্যয়ে লোক পাঠিয়ে মানুষের প্রশংসা অর্জনকে বড় করে দেখবে না, বরং নগদ লাভই বড় হয়ে উঠবে। প্রশাসনের লোকজনের যোগসাজশে তারা কর্মী রিক্রুট থেকে শুরু করে পদে পদে প্রভাব বিস্তার করবে এবং শেষ পর্যন্ত দেখা যাবে_ যেই লাউ সেই কদু। ব্যয় পড়বে আগের মতোই। এমন পরিস্থিতি যাতে সৃষ্টি হয় সে জন্য নেপথ্যে কলকাঠি নাড়বে আদম রফতানি খাতের পাকা খেলোয়াড়রা। তারা সোনার ডিম পাড়া হাঁসকে সরকারের হাতে তুলে দেবে, এটা ভাবার মতো মূর্খতা আর কিছুই হতে পারে না। সততার নতুন যুগে বাংলাদেশ, সেটা ভাবতে ভালোই লাগে। কিন্তু কথার চেয়ে কাজ করা যে অনেক কঠিন। বর্তমান মহাজোট সরকার প্রায় চার বছর আগে যখন জনগণের ম্যান্ডেট পেয়েছিল তখন 'সত্যের পথে চলব'_ এমন অঙ্গীকার করেছিল। কিন্তু তা রক্ষা করা যায়নি। বলা যায়, সে জন্য আন্তরিকতার অভাব ছিল এবং এখন পর্যন্ত তাতে দৃশ্যমান পরিবর্তন নেই। মালয়েশিয়ায় মাত্র ৩০-৪০ হাজার টাকায় লোক যাবে_ এটা দারুণ এক চ্যালেঞ্জ। সরকার তাতে জয়ী হলে মস্ত বাহবা পাবে। অন্যথায়, ব্যর্থতার পাল্লা আরেকটু ভারী হবে। দেখা যাক, কী হয়।

অজয় দাশগুপ্ত : সাংবাদিক
ajoydg@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.