বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক লেখাজোখা ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা by প্রফেসর আবদুল খালেক

দীর্ঘদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা এবং পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা রকম প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেছি, যে কারণে পত্র-পত্রিকায় বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক কোন লেখা বের হলেই গভীর আগ্রহ নিয়ে সে লেখা পড়ে থাকি। গত ৬ সেপ্টেম্বর (২০১২) দৈনিক জনকণ্ঠে প্রখ্যাত সাংবাদিক, দেশবরেণ্য কলাম লেখক স্বদেশ রায়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ লেখা


প্রকাশিত হয়েছে। লেখার শিরোনাম: ‘বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক মৌলবাদী থাবা ও সরকারের নতজানু নীতি।’ লেখকের বক্তব্য অত্যন্ত স্পষ্ট ও তথ্যসমৃদ্ধ। বিষয়বস্তু সময়োপযোগী। জঙ্গী মৌলবাদী শক্তি বাংলাদেশে আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে কত রকমের ষড়যন্ত্র এবং কলা-কৌশলের পথ বেছে নিয়েছে, লেখায় তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ রয়েছে। লেখাটি আমার খুব ভাল লেগেছে এবং বলা যেতে পারে, তাঁর লেখাটি পড়েই আমার আজকের এ লেখাটি লিখতে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছি।
২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি-জামায়াত তথা চারদলীয় জোট সরকার যখন রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়, ধরা যেতে পারে তখন থেকেই বাংলাদেশে জঙ্গী মৌলবাদী গোষ্ঠীর স্বর্ণযুগের সূত্রপাত। বাংলাদেশে নানা নামের জঙ্গী মৌলবাদী সংগঠন রয়েছে। বাংলাদেশের সকল মৌলবাদী সংগঠনের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে আমরা জামায়াতে ইসলামীর নাম উচ্চারণ করতে পারি। জামায়াতের মূল লক্ষ্য বাংলা দেশকে একটি ইসলামী রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করা। সেই লক্ষ্য অর্জনে কৌশলগতভাবে তারা দুটো পথ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায় এক. গণতন্ত্রের পথ, দুই. সশস্ত্র বিপ্লবের পথ। জামায়াত গণতন্ত্রের মাধ্যমে লক্ষ্য অর্জনের পথ বজায় রাখতে চায় চারদলীয় জোটের মাধ্যমে। অপরদিকে সশস্ত্র বিপ্লবের পথ বজায় রেখেছে তারা জেএমবি, হরকত-উল-জিহাদ, বাংলাভাই নামের বিভিন্ন জঙ্গী মৌলবাদী সংগঠনের মাধ্যমে। যে কারণে আমরা লক্ষ্য করেছি, ২০০২ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ পাঁচ বছর জামায়াত-বিএনপি জোট সরকারের আমলে জঙ্গী মৌলবাদী সংগঠনগুলো সরকারের ছত্রছায়ায় নানা রকম সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালিয়ে গেছে। উদাহরণ একই দিনে দেশের ৬৩ জেলায় বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো, দেশের উত্তরাঞ্চলে বাংলাভাইয়ের উত্থান ও ভিন্ন মতের মানুষদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা, সিনেমা হলে এবং আদালত প্রাঙ্গণে বোমা হামলা, বিচারকদের হত্যা, ২১ আগস্টে শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলা, আইভী রহমানসহ আওয়ামী লীগের বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীকে হত্যা, দেশে ইসলামী বিপ্লব ঘটানোর লক্ষ্যে ১০ ট্রাক অস্ত্র আমদানি। এ রকম অসংখ্য উদাহরণ তুলে ধরা যেতে পারে। এ সব ঘটনার সঙ্গে তৎকালীন জামায়াত-বিএনপি জোট সরকারের যে সম্পৃক্ততা ছিল, তা আজ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত।
২০০৮ সালের সংসদ নির্বচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে বিচারের মাধ্যমে জঙ্গী মৌলবাদী সংগঠনের কিছু খুনীকে মৃত্যুদ- দিতে সক্ষম হয়েছে এবং মৌলবাদী সংগঠনগুলোর পৃষ্ঠপোষক জামায়াতে ইসলামের প্রথম সারির নেতাদের কারারুদ্ধ করতে সমর্থ হয়েছে। জামায়াতের এসব নেতা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় বহু নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করেছিল, যে কারণে বর্তমান আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট সরকার যুদ্ধাপরাধী হিসেবে তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে যে সমস্ত মৌলবাদী জামায়াত নেতার গাড়িতে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ওড়ানো হয়েছিল, তাদের কারারুদ্ধ করা এবং বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর বিষয়টি খুব সহজসাধ্য ব্যাপার ছিল না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দৃঢ়তার সঙ্গে বার বার উচ্চারণ করে চলেছেন, তাঁর সরকারের সময়কালের মধ্যেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ শেষ করা হবে। জামায়াত নেতাদের ধারণা ছিল, তাদের স্পর্শ করার সাহস আওয়ামী লীগ সরকারের হবে না। তাদের সে ধারণা আজ মিথ্যা প্রমাণিত। নিজামী সাহেবরা ভেবে রেখেছিলেন, তাঁদের জেলে নিয়ে গেলে চারদিক থেকে সেøাগান উঠবে ‘জেলের তালা ভাঙ্গব নিজামীকে আনব।’ দেশে তেমন কোন সেগান শোনা যায়নি। অথবা বলা যেতে পারে, তেমন সেøাগান দেয়ার মতো সাহস আজ কারও নেই । কারণ জামায়াত আজ জনবিচ্ছিন্ন একটি দল। নানারকম রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জনসাধারণের কাছে জামায়াতকে ‘কাগুজে বাঘের’ পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়েছে। এতসব ঘটনার পরও যদি অভিযোগ করা হয় আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনা সরকার জঙ্গী মৌলবাদীদের প্রতি নতজানু নীতি অবলম্বন করেছে, সেটি দুর্ভাগ্যজনকই বটে।
এবার দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে একটু দৃষ্টি দেয়া যেতে পারে। দেশে বর্তমানে দুই রকমের বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে এক. সরকার পরিচালিত পাবলিক বিশ্বদ্যিালয়, দুই. বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় এখন দেশে সরকার পরিচালিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা কম, তবে তুলনামূলকভাবে সেখানে অস্থিরতা বেশি। সে অস্থিরতা কিছুটা দৃশ্যমান, কিছুটা অদৃশ্যমান। দৃশ্যমান অস্থিরতাপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে এ মুহূর্তে বুয়েট এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অদৃশ্যমান অস্থিরতাপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সংখ্যা অনেক। সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থিরতার কারণ হয়ত একই রকম নয়, তবে কিছু কিছু মিল খুঁজে পাওয়া যাবে।
দৃশ্যমান অস্থিরতাপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এ মুহূর্তে বুয়েট এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আমাদের আলোচনা শুরু করা যেতে পারে। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর সহযোগিতা নিয়ে একটি অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের চেষ্টা চালাচ্ছে এ দুটো বিশ্ববিদ্যালয়। কেউ বলছেন বুয়েট এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপউপাচার্য হটানোর আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে জঙ্গী মৌলবাদী গোষ্ঠীর শিক্ষক, ছাত্রছাত্রীবৃন্দ। কেউ বলছেন আন্দোলনটি রাজনৈতিক। বর্তমান সরকারকে বিব্রত করার জন্য সরকারবিরোধী শিক্ষক, ছাত্রছাত্রীরা এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে। মূল লক্ষ্য সরকার পতন। অনেকের ধারণা, বুয়েটের উপাচার্য এবং উপউপাচার্য অপসারণের আন্দোলন কোন রকম আদর্শিক বা রাজনৈতিক আন্দোলন নয়। বুয়েটের প্রভাবশালী কিছু শিক্ষকের পাওয়া না পাওয়ার ঘটনা থেকে এ আন্দোলনের সূত্রপাত। বিষয়গুলো ভেবে দেখবার মতো, তবে সত্য আবিষ্কারের কাজটি বেশ জটিল। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে বোধ করি এ ব্যাপারে সত্যের কাছাকাছি যাওয়া সম্ভব হবে।
কিছুদিন আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রচ- আন্দোলনের মুখে তৎকালীন কর্মরত উপাচার্য প্রফেসর শরীফ এনামুল কবিরকে এক পর্যায়ে পদত্যাগ করতে হয়। নতুন উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দান করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ প্রফেসর আনোয়ার হোসেনকে। এই নিয়োগের ক্ষেত্রে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং শিক্ষামন্ত্রী অসাধারণ বিচক্ষণতার পরিচয় দেন। প্রফেসর আনোয়ার হোসেন উপাচার্য হিসেবে যোগদানের পর পরই বঙ্গবন্ধুর দেয়া ’৭৩-এর গণতান্ত্রিক অধ্যাদেশ অনুযায়ী সিনেটের মাধ্যমে উপাচার্য নির্বাচনের আয়োজন করেন। মাত্র কিছুদিন আগে উপাচার্র্র্যবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সমস্ত শিক্ষক সিনেটের মাধ্যমে উপাচার্য নির্বাচনের দাবি করেছিলেন, প্রফেসর আনোয়ার হোসেনের পক্ষ থেকে উপাচার্য নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হবার পর পরই আন্দোলনকারী শিক্ষকগণ পিছু হটতে শুরু করেন। উপাচার্য নির্বাচন যাতে না হতে পারে এ জন্য তাঁরা নানা রকম বাহানা করতে থাকেন। কিন্তু প্রফেসর আনোয়ার হোসেন তাঁর সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। উপাচার্য নির্বাচন বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষকগণ কৌশল পরিবর্তন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আগত শিক্ষক প্রফেসর আনোয়ার হোসেন যাতে নির্বাচনে সর্বোচ্চ ভোট না পান, সে লক্ষ্যে তাঁরা সদ্যবিদায়ী প্রফেসর এনামুল কবিরের পক্ষে ভোট প্রদান করে তাঁকে প্যানেলে প্রথম হবার সুযোগ করে দেন। ক’দিন আগে যাঁরা উপাচার্য পদ থেকে শরীফ এনামুল কবিরকে হটানোর আন্দোলন করেছিলেন, বেকায়দায় পড়ে কৌশলগতভাবে তাঁরাই আবার প্রফেসর কবিরের পক্ষে ভোট প্রদান করেছেন। এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, শিক্ষকদের আন্দোলনের পেছনে কোন আদর্শের বিষয় ছিল না। এটি মূলত ছিল শিক্ষকদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং উপাচার্যের পদ দখলের আন্দোলন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আগত শিক্ষক যাতে নির্বাচিত উপাচার্য হতে না পারেন, সে লক্ষ্যে আন্দোলনকারী শিক্ষকগণ শেষ পর্যন্ত মন্দের ভাল হিসেবে নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদায়ী উপাচার্য প্রফেসর এনামুল কবিরকে সর্বোচ্চ ভোট দিয়ে নির্বাচিত উপাচার্য হিসেবে পেতে চেয়েছিলেন। তাঁদের এ কলা-কৌশল বুঝতে কারও অসুবিধা হবার কথা নয়। এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষকদের মুখোশ উন্মোচিত হয়ে গেছে। অনেক চিন্তাভাবনা করে সরকার থেকে নির্বাচনে দ্বিতীয় স্থান পাওয়া কর্মরত উপাচার্য প্রফেসর আনোয়ার হোসেনকেই নির্বাচিত উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দান করা হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্কট উত্তরণের লক্ষ্যে প্রফেসর আনোয়ার হোসেনকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দিয়ে অসাধারণ প্রজ্ঞা এবং দূরদর্শিতার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে প্রফেসর আনোয়ার হোসেন ভাগ্যবানও বটে। তিনি নির্বাচনে অনেক ভোটের ব্যবধানে দ্বিতীয় স্থানে থেকেও উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। কিন্তু ১৯৯৯ সালে কর্মরত উপাচার্য থাকাকালে সিনেটের মাধ্যমে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নির্বাচনে মাত্র দুই ভোটের ব্যবধানে দ্বিতীয় স্থান পাওয়ার কারণে আমাকে উপাচার্য রাখা হয়নি, নিজ বিভাগে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। তারপর দীর্ঘ ১৪ বছরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেটের মাধ্যমে উপাচার্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। হতে পারে আমার নির্বাচনী ফলাফল অন্যদের জন্য শিক্ষণীয় হয়ে আছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর আনোয়ার হোসেন ’৭৩-এর অধ্যাদেশ অনুসারে উপাচার্য নির্বাচন দিয়ে বর্তমান সময়ে এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন। উপাচার্য নির্বাচন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্কট উত্তরণে মহৌষধের মতো কাজ করেছে। আমার বিশ্বাস, দেশের যে সমস্ত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ’৭৩ সালের গণতান্ত্রিক অধ্যাদেশ দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে, সিনেটের মাধ্যমে উপাচার্য নির্বাচন সে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্কট উত্তরণের উত্তম পথ। যে সমস্ত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের অস্থিরতা অদৃশ্যমান রয়ে গেছে, উপাচার্য নির্বাচন না দিয়ে অবশিষ্ট সময় কোন রকমে কাটিয়ে দেয়া হয়ত যাবে, তবে প্রগতিশীল শিক্ষকদের মধ্যে যে ফাটলের সৃষ্টি হয়ে থাকবে, ভবিষ্যতে সে ফাটল মেরামত করা খুব সহজ হবে না।
এরপর বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় প্রসঙ্গ। বিএনপি-জামায়াত জোট রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকাকালে দেশে প্রায় অর্ধশত বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম দেয়। মালিক সবাই প্রায় ব্যবসায়ী এবং শিল্পপতি। এর ফলে অধিকাংশ বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না হয়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়। কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে সার্টিফিকেট বিক্রির অভিযোগ পর্যন্ত শোনা গেছে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার পর মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের অবৈধ ব্যবসা বন্ধের লক্ষ্যে একটি নীতিমালা প্রণয়নের মহৎ উদ্যোগ গ্রহণ করেন। নীতিমালাটি ২০১০ সালের পার্লামেন্ট অধিবেশনে পাস হয়। জাতি আশা করেছিল, নতুন নীতিমালার যথার্থ প্রয়োগের মাধ্যমে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠন-পাঠনের উন্নতি হবে। কিন্তু বাস্তবে তেমনটি ঘটেনি। ২০১০ আইনে শাখা বিশ্ববিদ্যলয়গুলো অবৈধ। অথচ আইন অগ্রাহ্য করে শাখা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আগের মতোই তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। রাজশাহীতে দারুল ইহসান, নর্দার্ন এবং অন্যান্য শাখা বিশ্ববিদ্যালয় স্থানীয় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে, এমনকি মেলার মাধ্যমে তাদের ভর্তি প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা ইউজিসির বাধা-নিষেধকে তারা পরোয়াই করছে না। রাজশাহীতে ছাত্রছাত্রীরা খানিকটা নিরুপায় হয়েই এসব অবৈধ শাখা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে। এর মূল কারণ প্রয়োজনের তুলনায় এখানে বৈধ বিশ্ববিদ্যালয়ের অভাব। ঢাকা মহানগরে বৈধ বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ৪৭ টি, সিলেট মহানগরে ৫টি এবং চিটাগাং মহানগরে রয়েছে ৭টি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু রাজশাহী মহানগরে রয়েছে মাত্র ১টি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়। অথচ রাজশাহী মহানগর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শিক্ষানগরী বলে খ্যাত।
২০১০ আইনের যথার্থ প্রয়োগ থাকলে ঢাকার কিছু বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় আইন ভঙ্গের কারণে এতদিনে বন্ধ হয়ে যাবার কথা এবং দেশে নতুন কিছু ভাল মানের বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠার কথা। উচ্চ শিক্ষার বৃহত্তর কল্যাণ চিন্তা থেকেই ’৭৩ সালে সিনেট কর্তৃক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নির্বাচন আইন এবং ২০১০ বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় আইনসমূহ প্রণীত হয়েছে। আইনগুলোর প্রায়োগিক দিকে তাকালে একটি প্রবাদ বাক্য মনে পড়ে- “ কাজীর গরু কেতাবে আছে, গোহালে নেই।” জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রমাণ করে দিয়েছে, ’৭৩ সালের অধ্যাদেশ অনুসারে সিনেটের মাধ্যমে উপাচার্য নির্বাচনই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিরাজমান সঙ্কট নিরসনের প্রকৃষ্ট পথ। অপরদিকে বেসরকারী বিশ্বদ্যিালয়ের শিক্ষার মানকে উন্নত করা এবং অবৈধ শাখা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বন্ধ করতে হলে ২০১০ আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং বাস্তবায়ন ছাড়া অন্য কোন বিকল্প পথ নেই।

লেখক : সাবেক উপাচার্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.