রঙ্গব্যঙ্গ-ছাত্রলীগ by মোস্তফা কামাল

নিয়াজ অতি দরিদ্র ঘরের সন্তান। ওর বাবা একজন কাঠমিস্ত্রি। মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয় সে। রেজাল্টের কারণেই সবার দৃষ্টিতে পড়ে। সাহায্যের হাত বাড়ায় গ্রামের অনেকেই। কিন্তু বাবা কাঠমিস্ত্রি হলে কী হবে! তাঁর আত্মসম্মানবোধ বেশ টনটনে। তিনি কারো সাহায্য নিতে রাজি হলেন না।


নিজেই কষ্ট করে ছেলের পড়ার খরচ জোগালেন। তাঁর কথা, ছেলে মানুষ হলে নিশ্চয়ই তাঁকে দেখবে। তখন তাঁর সব দুঃখকষ্ট ঘুচবে।
নিয়াজ উচ্চ মাধ্যমিকেও অসম্ভব ভালো রেজাল্ট করল। তারপর সে ভর্তি হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে। ভবিষ্যতে সে একজন কূটনীতিক হবে- সেই আকাঙ্ক্ষা থেকেই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে ভর্তি হয়। নিয়মিত ক্লাস করে। থাকে আজিমপুর সরকারি কলোনির একটি বাসায়। এক কর্মকর্তার ছেলেমেয়েকে পড়ায়। বিনিময়ে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা।
নিয়াজ নিজের পড়াশোনার ব্যাপারে খুবই সিরিয়াস। একসময় ভাবে, হলে উঠবে। পড়াশোনায় আরো বেশি মনোযোগ দেবে। হলে না উঠলে পড়াশোনা ভালো হবে না। বিষয়টা নিয়ে সে তার এক শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে। ওই শিক্ষক তাকে জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিট পেতে হলে ছাত্রলীগ নেতাদের ধরতে হবে। তা ছাড়া সিট পাওয়া যাবে না।
নিয়াজ বিস্ময়ের সঙ্গে বলল, বলেন কী স্যার! ছাত্রলীগের কাউকে ধরতে হবে! ওদের খুব ভয় লাগে। ওদের কাছে আমি যেতে পারব না। তা ছাড়া ওদের কাউকে আমি চিনিও না।
তাহলে তো তোমার সিট হবে না।
না হলে আর কী করব!
শোনো, আমি একজনের কাছে আমার একটি ভিজিটিং কার্ড দিয়ে পাঠাচ্ছি। তুমি যাও। আমার কার্ডটা তাঁর হাতে দেবে। কাজ হবে কি না আমি নিশ্চিত না।
নিয়াজ জানতে চাইল, লোকটা কে?
ওনার পরিচয় পরে জানবে। এখন বলা যাবে না। কাজ হলে বলব।
নিয়াজ সেই লোকের কাছে গেল। লোকটি শিক্ষকের কার্ডটি হাতে পেয়ে বললেন, স্যার পাঠিয়েছেন, ভালো কথা। তুমি কি কোনো সংগঠন করো?
জি না।
কেন?
এমনি।
ছাত্রলীগ পছন্দ করো?
জি না।
কেন?
ছাত্রলীগ তো শুধু মারামারি করে। আদর্শের রাজনীতির পরিবর্তে তারা এখন হল দখল, ক্যাম্পাস দখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি- এসব নিয়ে ব্যস্ত। আমি তো ওসব পছন্দ করি না।
রাজনীতি পছন্দ করো?
জি না।
কেন? রাজনীতি আবার কী করল?
রাজনীতি চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজির ট্রেনিং দেয়। তা ছাড়া রাজনীতিকরা দেশের কল্যাণে কিছু করেন না; শুধু নিজের স্বার্থ দেখেন।
রাজনীতির ব্যাপারে এ রকম ভ্রান্ত ধারণা তোমাকে কে দিল?
কেউ দেয়নি। পত্রিকায় খবর পড়ে পড়ে আমার এই ধারণা হয়েছে।
তোমার ধারণা ভুল! এত দিনে রাজনীতির ব্যাপারে তোমার যে ধারণা হয়েছে তা সবই ভুল। এখন থেকে জেনে রাখো, রাজনীতিই দেশের কল্যাণ করতে পারে। রাজনীতি ছাড়া গতি নাই।
নিয়াজ বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সে কিছু বলে না। তার কাঁধে হাত রেখে ওই ছাত্রনেতা বলেন, তুমি আমাকে চেনো?
জি না।
আমি রিয়াজ, রিয়াজুল হক (কাল্পনিক নাম)। ছাত্রলীগের সভাপতি।
ছাত্রনেতার পরিচয় জেনে নিয়াজ ভয়ে একেবারে কুঁকড়ে যায়। ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে সে এত কিছু বলেছে! এখন তার কথা ফিরিয়ে নেবে কী করে। সে কাঁচুমাচু করে বলে, আমার ভুল হয়ে গেছে। স্যরি, আমাকে মাফ করবেন। আর কোনো দিন এ রকমভাবে বলব না।
রিয়াজুল হক বললেন, ভুল তোমার হয়নি। তুমি যা বলেছ সবই সত্য। আমাদের হৃত ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করতে তোমাদের মতো ছেলেদের দরকার। তুমি কালই সিট পাবে। তুমি ছাত্রলীগে যোগ দাও।
স্যরি।
কেন, স্যরি কেন?
আমি ছাত্রলীগে যোগ দিতে পারব না।
কেন?
আমি রাজনীতি করব না।
কী করবে?
পড়াশোনা করব।
পড়াশোনা আমরা করছি না! পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে রাজনীতি করবে। ছাত্ররাজনীতি কি আর ফুলটাইম হয়? পার্টটাইম। সময় সময় মিছিল-মিটিংয়ে আসবে।
দেখেন, আমি খুব দরিদ্র ঘরের সন্তান। রাজনীতি করে সময় নষ্ট করা আমার পক্ষে সম্ভব না। আমাকে মাফ করবেন।
তুমি না বললে তোমার সিট খুব দরকার!
জি, খুব দরকার। কিন্তু দাসখত দিয়ে সিট নিতে চাই না। আমাকে শুধু দোয়া করবেন। আমি যাই।
কোথায় যাবে? দাঁড়াও।
নিয়াজের চোখে-মুখে ভয় আর আতঙ্ক। সে কী করবে ঠিক বুঝতে পারছে না। সে কি দৌড় দেবে? তার কথা শোনার পর নিশ্চয়ই রিয়াজুল হকের মেজাজমর্জি ঠিক নাই!
রিয়াজুল হক অনেকক্ষণ ধরে নিয়াজের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, তুমি কাল জহুরুল হক হলের ৩১০ নম্বর রুমে উঠবে। আমি বলে দিচ্ছি।
স্যরি। আমি তো আপনাকে বললামই, আমি ছাত্রলীগ করতে পারব না!
তোমাকে ছাত্রলীগ করতে হবে না। তুমি স্পষ্টভাষী, সাহসী। এটা আমার ভালো লেগেছে। এ জন্যই তোমাকে আমি সিট দেব। তুমি পড়াশোনা করো। বড় হও।
নিয়াজ অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.