বিনিয়োগ আহরণে অনন্য সাফল্য by এম এ খালেক

যে কোন দেশের দ্রুত এবং সুষম অর্থনৈতিক উন্নয়নে শিল্পায়নের কোন বিকল্প নেই। বিশেষ করে দেশটি যদি বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশ হয় তাহলে তো কথাই নেই। অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব সাধিত হবার পর বিশ্বের অধিকাংশ অর্থনীতিবিদ এক বাক্যে এটা স্বীকার করে নেন যে, একমাত্র শিল্প খাতে


বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের মাধ্যমেই একটি দেশ দ্রুত এবং সুষম অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করতে পারে। বিশেষ করে দ্রুত বর্ধনশীল জনসংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খাদ্য এবং অন্যান্য চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে শিল্পায়নের কোন বিকল্প নেই। কৃষির ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল কোন দেশ কখনই দ্রুত এবং কাক্সিক্ষত মাত্রায় অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করতে পারে না। কারণ কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পায় গাণিতিক হারে। অন্যদিকে শিল্প উৎপাদন এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় জ্যামিতিক হারে। তাই দ্রুত বর্ধনশীল জনসংখ্যার খাদ্য ও অন্যান্য চাহিদা পূরণের জন্য শিল্প উৎপাদনের ওপর জোর দেয়া ছাড়া কোন বিকল্প নেই। কোন দেশ যদি শিল্প খাতে কাক্সিক্ষত মাত্রায় উন্নতি অর্জন করতে পারে তাহলে জনগণের নিত্য চাহিদা এবং খাদ্যের যোগান আমদানির মাধ্যমেও পূরণ করা সম্ভব। বিপুল পরিমাণ খনিজ সম্পদে পরিপূর্ণ দেশ ব্যতীত বিশ্বে সম্ভবত একটি দেশের নামও উল্লেখ করা যাবে না যারা শিল্পায়নকে অবজ্ঞা করে উন্নয়ন সাধন করতে সমর্থ হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বব্যাপী সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দার কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিনিয়োগ বন্ধ্যাত্ব দেখা দিয়েছিল। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে স্থানীয় এবং বিদেশি বিনিয়োগ হ্রাস পেতে শুরু করে। এই বিনিয়োগ বন্ধ্যাত্ব ইতোমধ্যেই কেটে যেতে শুরু করেছে। অর্থনৈতিক মন্দার সময় বিশ্বব্যাপী পণ্য মূল্য, বিশেষ করে খাদ্য পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে এ সময় বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় চাল এবং গম উৎপাদনকারী দেশে উৎপাদন ব্যাপকভাবে হ্রাস পাবার কারণে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। অনেক দেশে খাদ্য নিয়ে দাঙ্গা শুরু হয়। এ সময় বিনিয়োগও হ্রাস পায় অস্বাভাবিকভাবে। এ কারণে বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে দীর্ঘমেয়াদী উৎপাদন হ্রাসের একটি আশঙ্কা দেখা দেয়। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো স্থানীয়ভাবে পুঁজি বিনিয়োগ করতে পারছিল না। আবার বিদেশি পুঁজি আহরণ করবে সে অবস্থাও ছিল না। কারণ উন্নত দেশগুলোও তাদের উদ্বৃত্ত পুঁজি তৃতীয় বিশ্বের দেশে সঞ্চালন করতে পারছিল না। কিন্তু আশার কথা এই যে, পরিস্থিতি ইতোমধ্যেই কিছুটা হলেও উন্নতি হয়েছে। উন্নত দেশের বিনিয়োগকারীরা তাদের উদ্বৃত্ত পুঁজি নিয়ে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে আসতে শুরু করেছে।
কোন দেশে যদি স্থানীয় বিনিয়োগ আশানুরূপ না হয় তাহলে সেই দেশে বিদেশি বিনিয়োগ আসে না। তাই প্রতিটি দেশই চেষ্টা করে কিভাবে স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগে আগ্রহী করে তোলা যায়। স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে আগ্রহী হলে বিদেশী বিনিয়োগকারীরাও সে দেশে বিনিয়োগ করতে উৎসাহী হয়। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা একটি দেশে বিনিয়োগের আগে তাদের পুঁজির নিরাপত্তা এবং পর্যাপ্ত লাভের বিষয়টি বিশেষ বিবেচনায় রাখে। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট দেশের কার্যকর বিনিয়োগ পরিবেশ কেমন তাও তারা বিবেচনা করে। কিছুদিন আগেও আমাদের স্থানীয় বিনিয়োগ প্রায় নিগেটিভ পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। কিন্তু ইতোমধ্যেই সে অবস্থা থেকে উত্তরণের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। কিছুদিন ধরেই বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। ব্যাংকিং সেক্টরে তারল্য সঙ্কট এবং অন্যান্য সমস্যা থাকা সত্ত্বেও দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। এটা স্থানীয় বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যেমন সত্যি তেমনি বিদেশি বিনিয়োগের জন্যও সমভাবে প্রযোজ্য। গত অর্থবছরে (২০১১-২০১২) শিল্পখাতে স্থানীয় বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা। এটা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৮ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা বেশি। আগের বছর মোট ১ লাখ ৩ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছিল। ২০০৯-১০ অর্থবছরে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৮৫ হাজার কোটি টাকা। স্থানীয় বিনিয়োগ বৃদ্ধির এ প্রবণতা যে কোন বিচারেই উল্লেখের দাবি রাখে।
যদিও ব্যাংকিং সেক্টর থেকে বর্তমানে ঋণ পাওয়া বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্থানীয়ভাবে ব্যাংক ঋণ গ্রহণ করতে গেলে কম করে হলেও ১৭/১৮ শতাংশ সুদ দিতে হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে এই সুদের হার আরও বৃদ্ধি পায় নানা সার্ভিস চার্জের নামে। স্থানীয় বিনিয়োগ বৃদ্ধির পাশাপাশি বিদেশী সরাসরি বিনিয়োগও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। বাংলাদেশকে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা তাদের পুঁজি বিনিয়োগের উপযুক্ত ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেবার একটি বড় কারণ হলো এখানকার বিশাল বাজার। বিশাল জনসংখ্যা অধ্যুষিত একটি দেশের বাজার দখল করার জন্য অনেকেই উদগ্রিব। একজন অর্থনীতিবিদ কিছুদিন আগে প্রসঙ্গক্রমে বলেছিলেন, কানাডায় প্রতি বছর যে সংখ্যক গাড়ি বিক্রি হয় বাংলাদেশে তার চেয়ে অনেক বেশি গাড়ি বিক্রি হয়। কারণ কানাডার জনসংখ্যা বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম। এখানকার বিশাল বাজার এবং স্বল্প বিনিয়োগে বিপুল পরিমাণ লাভের সম্ভাবনা তাদের হাতছানি দিয়ে ডাকে।
বাংলাদেশ ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে পুরো মাত্রায় এবং যুক্তরাষ্ট্র হতে সীমিত পরিসরে জিএসপি সুবিধা পেয়ে আসছে। এই জিএসপি সুবিধার আওতায় বাংলাদেশ এই দু’টি অঞ্চলে পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধা লাভ করছে। কোন বিদেশি কোম্পানি যদি বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে এবং পণ্য উৎপাদনের পর তা রফতানি করে তাহলে তারাও জিএসপি সুবিধা লাভ করে থাকে। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের নিকট থেকে জিএসপি সুবিধা লাভ করে ঠিকই কিন্তু তৈরি পোশাক সামগ্রিকে এই সুবিধার বাইরে রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের নিকট থেকে তৈরি পোশাকের জন্য জিএসপি সুবিধা আদায় করার। এটা অর্জিত হলে বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্যে রীতিমতো বিপ্লব সূচিত হবে।
বাংলাদেশ যে এখন বিদেশী বিনিয়োগের একটি উপযুক্ত ক্ষেত্র হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে এটা কোনভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। কারণ তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ দেশ, এমনকি শক্তিশালী ভারতেও বিদেশী বিনিয়োগ হ্রাস পাচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ঘটছে উল্টো ঘটনা। বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত বছর বাংলাদেশ মোট ১১৩ কোটি ৬৩ লাখ ডলারের বিদেশী সরাসরি বিনিয়োগ আহরণ করতে সমর্থ হয়েছে। এটা কোনো একটি নির্দিষ্ট বছরে সর্বোচ্চ বিদেশী বিনিয়োগ আহরণের ঘটনা। এর আগের বছর বিদেশি বিনিয়োগ আহরণের পরিমাণ ছিল ৯১ কোটি ৩৩ লাখ মার্কিন ডলার। গত বছর বাংলাদেশে যে বিদেশী বিনিয়োগ এসেছে তার দেশভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করেছে মিসর, যার পরিমাণ ১৫ কোটি ২৩ লাখ ডলার। আগের বছর মিসরের বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল মাত্র শূন্য দশমিক ৩০ ডলার। দ্বিতীয় স্থানে ছিল যুক্তরাষ্ট্র, তাদের বিনিয়োগের পরিমাণ হচ্ছে ১১ কোটি ৭৭ লাখ ডলার। আগের বছর তাদের বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৫ কোটি ৬৫ লাখ ডলার। তৃতীয় স্থানে রয়েছে নেদারল্যান্ড। তাদের বিনিয়োগের পরিমাণ হচ্ছে ১১ কোটি ৬৭ লাখ ডলার। আগের বছর এদের বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল কোটি ৪৯ লাখ ডলার। চতুর্থ স্থানে ছিল যুক্তরাজ্য, যাদের বিনিয়োগের পরিমাণ হচ্ছে ১১কোটি ৬৩ লাখ ডলার। আগের বছর তারা বিনিয়োগ করেছিল ১০ কোটি ৫৬ লাখ ডলার। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পঞ্চম এবং ষষ্ঠ স্থানে ছিল যথাক্রমে দক্ষিণ কোরিয়া ও হংকং। তাদের বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১১ কোটি ৩০ লাখ ডলার ও ১০ কোটি ৪৮ লাখ ডলার। আগের বছর এ দু’টি দেশের বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৪ কোটি ডলার ও ৬ কোটি ৪৮ লাখ ডলার। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান ছিল সবার শেষে। তাদের বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ২ কোটি ৫৭ লাখ ডলার। আগের বছর ভারত মোট ৪ কোটি ৩১ লাখ ডলার বিনিয়োগ করেছিল। একই সময়ে পাকিস্তান বাংলাদেশে মোট ৭ কোটি ৫ লাখ ডলার বিনিয়োগ করে। আগের বছর তাদের বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১ কোটি ৮৮ লাখ ডলার। খাতভিত্তিক পর্যালোচনায় দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ এসেছে টেক্সটাইল ও বস্ত্র খাতে। এ খাতে মোট বিনিয়োগ এসেছে ২৭ কোটি ২০ লাখ ডলার। আগের বছর এ খাতে বিনিয়োগ এসেছিল ১৪ কোটি ৫১ লাখ ডলার।
ব্যাংকিং খাতে বিদেশী বিনিয়োগ এসেছে ২৪ কোটি ৮২ লাখ ডলার। আগের বছর এ খাতে মোট ১৬ কোটি ৩০ লাখ ডলারের বিনিয়োগ এসেছিল। বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পেট্রোলিয়াম খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ হচ্ছে ২৩ কোটি ৮২ লাখ ডলার। আগের বছর এ খাতে মোট বিনিয়োগ এসেছিল ৯কোটি ২০ লাখ ডলার। শীর্ষ ৬টি খাতের মধ্যে সবচেয়ে কম বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে কৃষি ও মৎস্য খাতে। এ খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল, ০৫৫ কোটি ডলার। আগের বছর এ খাতে বিনিয়োগ এসেছিল ১ কোটি ৩৬ লাখ ডলার।
বিদেশী বিনিয়োগ আহরণের এই ধারা আমাদের অবশ্যই আগ্রহী করে তোলে। কিন্তু এতে আত্মতৃপ্তি লাভের কোনো সুযোগ নেই। কারণ আমাদের দেশে যে বিদেশী বিনিয়োগ আসছে তার পরিমাণ অতি সামান্য। বাংলাদেশ যদি চলতি অর্থবছরের বাজেটে ঘোষিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ৭ দশমিক ৩ শতাংশ হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে চায় তাহলে তাকে অবশ্যই বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
চলতি অর্থবছরে অন্তত ৬৪ হাজার কোটি টাকা নতুন বিনিয়োগ দরকার হবে। স্থানীয়ভাবে এত বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ অর্জন করা সম্ভব নয়। তাই আমাদের বিদেশী বিনিয়োগের প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে। তবে সেখানেও কথা রয়েছে। যেনতেনভাবে বিদেশী বিনিয়োগ আহরণের কোন কারণ নেই। আমাদের জাতীয় স্বার্থ বিবেচনা করেই বিদেশী বিনিয়োগ আহরণ করতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.