খসড়া অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা ‘ডিজিটাল বাংলাদেশের সঙ্গে সাংঘর্ষিক’

অক্টোবরের মধ্যে সরকার অনলাইন গণমাধ্যম ‘নিয়ন্ত্রণে’ নীতিমালা চূড়ান্ত করতে যাচ্ছে। এ নীতিমালা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার বর্তমান সরকারের ঘোষণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলেছেন গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ও অনলাইনের সঙ্গে যুক্ত সম্পাদকগণ। এ বিষয়ে একটি খসড়া ইতিমধ্যে তৈরি করা হয়েছে।
ওই খসড়ার ভিত্তিতে আগামী ১০ দিনের মধ্যে মতামত দিয়ে অনলাইন গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের বলা হয়েছে।
খসড়ায় বলা হয়েছে, অনলাইন গণমাধ্যমের লাইসেন্স নেয়ার ক্ষেত্রে এককালীন পাঁচ লাখ টাকা তথ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দিতে হবে। পরে প্রতি বছর ৫০ হাজার টাকায় লাইসেন্স নবায়ন করতে হবে। গতকাল তথ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনলাইন গণমাধ্যমের সম্পাদক ও প্রতিনিধিদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে বৈঠক করেন তথ্য সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন। বৈঠকে খসড়া নীতিমালার কপি উপস্থিত সম্পাদকদের সরবরাহ করা হয়।

মন্ত্রণালয়ের করা নীতিমালয় অসঙ্গতি থাকায় বৈঠকেই এর বিরোধিতা করেন সম্পাদক ও অনলাইন গণমাধ্যম প্রতিনিধিরা। তারা জানিয়েছেন, ‘নিয়ন্ত্রণ’ আরোপের উদ্দেশ্যে এই নীতিমালা করা হলে দেশের অনলাইন গণমাধ্যমের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। একই সঙ্গে সরকার ‘ডিজিটাল’ বাংলাদেশ গড়ার যে লক্ষ্য নিয়েছে এই খসড়া সরকারের এই লক্ষ্যের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, খসড়া নীতিমালা চূড়ান্ত করার আগে সবার মতামত নেয়া হবে। খসড়ার বিষয়ে ১০ দিনের মধ্যে লিখিত মতামত জমা দেয়া যাবে।

এ বিষয়ে টিভি ব্যক্তিত্ব মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, অনলাইন গণমাধ্যম ব্যাপক জনপ্রিয় একটি মাধ্যম। মুক্ত ও স্বাধীনভাবেই এই গণমাধ্যমকে চলতে দেয়া উচিত। আর্থিক বা অন্য কোন কারণে নিয়ন্ত্রণ আরোপ হলে অবাধ তথ্য প্রবাহ ব্যাহত হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, সরকার যে পদ্ধতিতে নীতিমালা করতে যাচ্ছে এই পদ্ধতিটিই ভুল। নীতিমালা করার আগে যারা এই অনলাইন গণমাধ্যমের সঙ্গে জড়িত তাদের সঙ্গে আলোচনা করে মতামত নিয়ে খসড়া তৈরি করা উচিত ছিল। কিন্তু তা না করে খসড়া করে তার ওপর মতামত দেয়ার জন্য বলা হয়েছে। এছাড়া লাইসেন্স নেয়া এবং নবায়নের জন্য যে পরিমাণ অর্থের কথা বলা হয়েছে তা অনেকটা নিয়ন্ত্রণ আরোপের মতোই।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বৈঠকে অংশ নেয়া বাংলানিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক আলমগীর হোসেন বলেন, নীতিমালার যে খসড়া আমাদের দেয়া হয়েছে এটি চূড়ান্ত হলে তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে তথ্যের প্রবাহ যেভাবে বাড়ছে তা থেমে যাবে। অনলাইন গণমাধ্যমের নীতিমালা না থাকলেও যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই গণমাধ্যম কার্যক্রম চালায়। তারা যে ডোমেইন ব্যবহার করে সংবাদ বা তথ্য প্রকাশ করে ওই ডোমেনই কোম্পানির কাছে তাদের সব ধরনের তথ্য দেয়া থাকে। যে কেউ যখন তখন তা দেখতেও পারে। অন্যদিকে সরকার যে নীতিমালা করতে চাইছে তা কিসের ভিত্তিতে করতে চাইছে, অন্য কোন দেশে এ ধরনের নীতিমালা আছে কিনা তাও তো দেখতে হবে। তিনি বলেন, নীতিমালা হলে সবার সঙ্গে আলোচনা করেই তা করতে হবে।
বৈঠকে অংশ নেয়া প্রাইম খবরের প্রধান সম্পাদক এসএম মেজবাহ উদ্দিন জানান, সরকার তথ্যের অবাধ প্রবাহের বিষয়ে যে বক্তব্য দিচ্ছে নীতিমালার খসড়া এই বক্তব্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এই খসড়া চূড়ান্ত হলে তথ্যের অবাধ প্রবাহ ব্যাহত হবে। এ বিষয়ে বৈঠকে তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে খসড়ার ওপর লিখিত মতামত দিতে বলা হয়েছে। আমরা এ বিষয়ে আমাদের লিখিত মতামত দেবো। তিনি বলেন, সবার সঙ্গে আলোচনা করেই খসড়া চূড়ান্ত করতে হবে।

মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বিডিনিউজের সোশ্যাল অ্যাফেয়ার্স এডিটর বেবী মওদুদ, বাংলানিউজ  টোয়েন্টিফোর.কম-এর এডিটর ইন চিফ আলমগীর হোসেন, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক এহসানুল করিম হেলাল, আইএনবির ব্যারিস্টার জাকির হোসেন, পিটিবি নিউজের আশিস কুমার দে, প্রাইম খবরের প্রধান সম্পাদক এসএম মেজবাহ উদ্দিন, অল হেডলাইন নিউজ-এর নিউজ করেসপন্ডেন্ট সালিম সামাদ, ঢাকানিউজ২৪.কম-এর এমজে ইসলামসহ অনলাইন গণমাধ্যমের ১১জন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন।

এছাড়া এতে সাংবাদিক নেতাদের মধ্যে বিএফইউজে সভাপতি ইকবাল সোবহান চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল ভূঁইয়া, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ওমর ফারুক, সাধারণ সম্পাদক শাবান মাহমুদ উপস্থিত ছিলেন।

তথ্য সচিবের সঙ্গে ছিলেন বিজ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কামালউদ্দিন, তথ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আবুল হোসেন ও এসএম হারুন-অর-রশিদ, পিআইডি’র অতিরিক্ত মুখ্য তথ্য কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন প্রমুখ।

সভায় খসড়া নীতিমালা নিয়ে আলোচনার সময় অনলাইনের পক্ষে অংশ নেয়া প্রতিনিধিরা ৫ লাখ টাকা জমা ও ৫০ হাজার টাকা নবায়ন ফি নির্ধারণের বিষয়টির বিরোধিতা করেন। সংবাদপত্রের ক্ষেত্রে এ নিয়ম না থাকলেও অনলাইনে এমনটি কেন থাকবে, এমন প্রশ্ন তোলেন তারা। তারা খসড়া নীতিমালায় লাইসেন্স নবায়নের বিষয়টি বাতিল ও জাতীয় রেগুলেটরি কমিটিতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি রাখার দাবি জানান।

সভায় তথ্য সচিব বলেন, আমরা নীতিমালার মাধ্যমে অনলাইন গণমাধ্যমের বিকাশ বাধাগ্রস্ত করতে চাই না। বরং নীতিমালাকে বিকাশের সহায়ক করতে চাই।

কমিউনিটি রেডিওর নীতিমালাকে ভিত্তি ধরে এ খসড়া নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। সরকারি হিসেবে সারাদেশে ২০০ অনলাইন সংবাদপত্র রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, অনলাইন সংবাদ মাধ্যম পরিচালনার জন্য দেশে কোন আইন, নীতিমালা ও অধ্যাদেশ নেই। সে কারণে নীতিমালা জরুরি। তিনি জানান, বিভিন্ন  দৈনিক পত্রিকার অনলাইন সংস্করণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আলাদাভাবে আলোচনায় বসা হবে।

খসড়ায় যা আছে: নীতিমালার খসড়ায় বলা হয়েছে, অনলাইন গণমাধ্যমের লাইসেন্স নেয়ার জন্য এককালীন পাঁচ লাখ টাকা তথ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দিতে হবে। প্রতি বছর ৫০ হাজার টাকা ফি দিয়ে এই লাইসেন্স নবায়ন করতে হবে। সরকার প্রয়োজনে লাইসেন্স ফি পুনর্নিধারণ করতে পারবে।

মেয়াদ শেষ হওয়ার ৩০ দিন আগে লাইসেন্স নবায়নের জন্য আবেদন করতে হবে। কোন কারণে নির্দিষ্ট সময়ে লাইসেন্স নবায়নে ব্যর্থ হলে পাঁচ হাজার টাকা সারচার্জ জমা দিয়ে সর্বোচ্চ দুই মাসের মধ্যে লাইসেন্স নবায়ন করা যাবে। আগ্রহী প্রতিষ্ঠানকে নির্ধারিত ফরমে তথ্য মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে পাঁচ হাজার টাকার অফেরতযোগ্য ব্যাংক ড্রাফট বা পে-অর্ডার জমা দিয়ে আবেদন ফরম সংগ্রহ করতে হবে। আবেদনের সঙ্গে ‘আর্নেস্ট মানি’ বাবদ অফেরতযোগ্য দুই লাখ টাকা ব্যাংক ড্রাফট বা পে-অর্ডার জমা দিতে হবে। লাইসেন্স পাওয়ার পর এ আর্নেস্ট মানি জামানত হিসেবে গণ্য হবে। খসড়ায় বলা হয়, কোন অনলাইন গণমাধ্যমের মালিক বা পরিচালক সরকারের অনুমতি সাপেক্ষে একাধিক অনলাইন গণমাধ্যমের মালিক বা পরিচালক হতে পারবেন। সরকারের পাওনা পরিশোধে ব্যর্থ হলে, বিটিআরটির দেয়া শর্ত ও নীতিমালার শর্ত ভাঙলে এবং সরকারের নির্দেশ না মানলে লাইসেন্স স্থগিত বা বাতিল করা হবে।

এছাড়া অনলাইনে সমপ্রচারিত বিষয় (কনটেন্ট) ৯০ দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করতে বলা হয়েছে নীতিমালার খসড়ায়।

অনলাইন গণমাধ্যম পরিচালনা (খসড়া) নীতিমালা ২০১২

সূত্র: মানবজমিন

No comments

Powered by Blogger.