এক কাজে একটানা নয়

সাম্প্রতিক বাজার রিপোর্ট বলছে, সুখের সরকারি চাকরি নয়, পরিশ্রম বেশি হলেও সাংবাদিকতা বা কর্পোরেট কাজে জেন ওয়াই-এর মন মজেছে বেশি। টাকার প্রশ্ন সেখানে নেই। আছে অ্যাডভেঞ্চার আর মার্কেটে ইন থাকার গল্প। সরকারি চাকরির নিস্তরঙ্গতার মধ্যে জব স্যাটিসফেকশন খুঁজে পায় না ভীষণ দ্রুত এই প্রজন্ম।

আবার কর্পোরেট হাউজে টানা পরিশ্রমের ব্যাপার থাকলেও, এই ইন্ডাস্ট্রি দিয়েছে মনের মতো সব পাওয়ার স্বাধীনতা। কিন্তু পাল্টে পাল্টে কাজে কি অনিশ্চয়তা নেই? তাহলে? আসলে, গতে বাঁধা জীবনের ছক কেটে বেরিয়ে আসার পরামর্শ কিন্তু শরীর বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে মনোবিজ্ঞানী সকলেরই। একটানা কাজের ফল হিসেবে অল্প বয়সে স্পন্ডিলাইটিস থেকে শুরু করে সমস্যা হচ্ছে যৌনজীবনেরও। অন্যদিকে মনের সমস্যাও বড় কম নয়। দ্রুত পাল্টে যাওয়া চারপাশের মধ্যে দিয়ে এক কাজে একটানা মন পড়ে  যাচ্ছে জেন ওয়াই-এর। ফল হিসেবে কাজে গাফিলতি, প্রমোশন আটকে যাওয়া এবং অসহিষ্ণুতাবশত চাকরি ছেড়ে দেয়ার সহজ পথ- আর পরবর্তী ব্যক্তিগত জীবনে এর প্রভাব।
জব কনসালট্যান্ট বা ডাক্তার সবাই-ই তাই বলছেন এককাজে একটানা একেবারে নৈব নৈব চ। না না, তার মানে এই নয় যে, দুম করে বড় ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে কাজ টপকে স্কুলে পড়াতে যেতে হবে। এই ধরনের রদ-বদলে সারা জীবনে কাজের ধরনের সংখ্যা কম পড়ে যেতে পারে। তবে কাজের ফাঁকে বিশ্রাম নিয়ে ল্যাদ না খেতে চাইলে, স্বাদ পাল্টে হেঁটে চলে একটু কলিগের কাজ দেখে বা অফিস ঘুরেফিরে আসলে, মন-শরীর দুইই জং পড়ে যাওয়ার বদলে তরতাজা হয়ে উঠবে।


অফিস ফেরত প্রতিদিনই ঘাড়ে হালকা ব্যথা নিয়ে বাড়ি ফিরছিল শরিফ। সারাদিন ল্যাপটপে মুখ গুঁজে কাজের শেষে রাতে ফের একপ্রস্থ খুটখাট। পেইন কিলারের সাময়িক প্রভাব থেকে ব্যথার রূপ চিনতে একটু দেরি করে ফেলার উপহার সেই ঘাড়ে চেপে বসেছে আজীবনের জন্য। সম্প্রতি স্পন্ডিলাইটিস ধরা পড়ার পর শরিফের নতুন  গলার গয়নাটা যে কী, তা বুঝতেই পারছেন।

প্রকৃতির হাবভাবের মতো রঙ পালটানো সময়ে কোনো জিনিসেই জান লড়িয়ে আঁকড়ে বসে থাকা চলবে না যে। বসের প্রিয়পাত্র হতে কিউবিকলে ঢোকা ইস্তক সেই যে একটানা ল্যাপটপে ঘাড় গুঁজে থাকা, তার পরিণাম শরিফের মতো এ প্রজন্মের অনেক তরুণেরই হয়েছে। কিন্তু ব্যস্ত সময়ে এসব দোহাই মানবে কে? নম্বর আর প্ল্যানিংয়ের চক্করে চোখমুখ গুঁজে না পড়ে থাকলে পাশের জন তরতর করে উপরে উঠে যাবে তো। কিন্তু ওই পাশের জনের উত্তরণে নিজের দিক থেকে নজর যাতে না সরে তাই এত আয়োজন আর কী। বর্তমান ভেজালের যুগে শরীর আর সেই মহাশয় নেই যে, যা সওয়ানো যাবে তাই সইবে। তাই ডাক্তাররা বলছেন, কাজের ফাঁকে হাটাহাটি বা খানিক গানের ব্রেক শরীর ও মাথাকে ঝকঝকে করবে। পাল্টে দেবে জীবনধারাও।

এই যেমন বেসরকারি ব্যাঙ্কের কাস্টমার সার্ভিস ম্যানেজার শারমীন ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা জানাচ্ছেন, “সপ্তাহে ছয় দিন হাড়ভাঙা খাটুনির শেষে নিজের দিকে নজর দেয়ার সময় কোথায়? বিয়েটাই ভেস্তে যাচ্ছিল। আমরা দুজনেই প্রাইভেটে কাজ করি। অফিসে ৯-১০ ঘণ্টা কাজের পরে শরীরও কোনো সাড়া দেয় না। সব মিলিয়ে একটা অদ্ভুত ইরিটেশন। চাকরিটাই ছাড়ব ভাবছিলাম। শেষে এক বন্ধুর পরামর্শে কাজের সময় ভাগ করলাম। সকাল-বিকেল হাঁটাহাঁটি পারব না। অফিসেই যতটুকু হয়। কাজের মাঝে বোর লাগলেই আমি জোকসের বই পড়ি। মন পালটে যায়। আবার বাড়ি ফেরার সময় কানে গান গুঁজে দিই। অন্য রকম ফ্রেশনেস পাই।”

এতো গেল কেজো লোকের কথা। সদ্য কলেজ পাশ করা তীর্ণা জানাচ্ছেন, “আমি এক কাজ বেশিদিন করতেই পারব না। কোনো ইন্টারেস্টই পাব না। লেখালিখির মাঝে শব্দ কম পড়ে যাবে। তার চেয়ে যখন যেটা করতে ইচ্ছে করছে, তখন সেটা করা উচিত আমার মতে।”

বেশ তো, যারা প্রতি মুহুর্তে মন পাল্টাচ্ছেন, তারা না-হয় এভাবেই কাজ পাল্টালেন। আসল কথা তো ভালো থাকা। যার চাবিকাঠি একমাত্র আপনারই হাতে। শুধু সাধু সাবধান-‘জব হপার’-এর তকমাটা একবার সেঁটে গেলে কোনো জায়গাই কিন্তু কাজ দেবে না।

No comments

Powered by Blogger.